অন্ধজনে দেহ আলো (১৫৪)

 অন্ধজনে দেহ আলো  (১৫৪)

 সংকট কারে কয় - এর পরে ০০০০০

        আজ শনিবার, বাইরে কাল রাত্রি থেকে অবিরাম বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। হিউস্টনে এইরকম বৃষ্টি হয়েই থাকে , তার পরেই শুরু হবে ঝির ঝির করে বরফ পরা।  সৃঞ্জনী ঘরের রুম হিটারটা চালিয়ে দিল। অনিন্দ্য বন্ধ জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের প্রকৃতিকে নির্লিপ্তভাবে দর্শন করে যাচ্ছে। এমন সময় ঘরের ইন্টারকমের ফোনটা বেজে উঠলো, মাসিমা ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট নিয়ে অপেক্ষা করছেন। 
         মা অসময়ে চলে যাবার পর সৃঞ্জনী যা কিছু আবদার তা মা'র   মতো সবই পূরণ করতেন মাসিমা।  তাই মাসিমার সাথে সৃঞ্জনীর বন্ডিংটা অন্য জায়গায়।  ছোটবেলা বেশ মনে আছে,   এরকম বৃষ্টিঝরা দিনে মায়ের হাতে  খিচুড়ি রান্নার কথা আজকের দিনটা  বেশ মনে করিয়ে দিচ্ছে।  সৃঞ্জনী মাসিমার কাছে আবদার করলো দুপুরে খিচুড়ি রান্না করার। 
        বরাবরই সৃঞ্জনী যে কোনো বিষয়ের অবতারণা হলে তাকে গুরুত্বের সাথে বিচার করার চেষ্টা করে।   যতক্ষন বিয়বস্তুর সাথে যুক্তির মেলবন্ধন না ঘটে, ততক্ষন সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কের মতো সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ঠিক উত্তরের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। গতকাল মেশোমশায়ের পুঁজিবাদের সংকটের চেহারাটা মার্ক্সীয় দর্শনের দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, তাকে ধরে এনে সৃঞ্জনী ভারতীয় দর্শনের ফরম্যাটে ফেলে দিয়ে কফির টেবিলেই শুরু করে দিলো। 
        দেখতে দেখতে প্রায়  নয়টা বছর হয়ে গেল আমরা ভারতবর্ষকে ছেড়ে এসেছি, কেননা আমাদের মানসিক অভাব পূরণের  জন্য প্রয়োজনীয়   সংস্থান আমাদের মতো  গরিব দেশের রান্নাঘরে মজুত ছিল না। যে ভাবে সন্তান কামনায় ব্যাকুল পিতামাতা জন্ম না দিয়েও কাগজের বৈধতার বলে পালক পিতা হয়ে যায় , তেমনি আজ আমরা এই আমেরিকার বৈধ সন্তান। এই দেশটির নিজস্ব কোন সংকৃতিকে বহন না করার জন্য সবার কাছে দেশটি উন্মুক্ত এবং সবাই এখানে স্থান করে নেয়।  এই দেশটির চাহিদা আছে  হিউমান ক্যাপিটালের আর আমাদের ক্ষমতা আছে তাদের প্রয়োজন মেটাবার। তাই  চাহিদা আর যোগানের সুক্ষ টিউনিংয়ের মাধ্যমে আমরা  একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছি।   
        ভারতের স্বাধীনতার পূর্বের চেহারা আমরা দেখিনি কিন্তু তার পরবর্তী চেহারাটা যা আমাদের কাছে যা ফুটে উঠেছে, তাতে দেখছি জন্মলগ্ন থেকে সুতিকায় আছন্ন দেশ মাতৃকা। অতি  কষ্টে তার সন্তানদের লালনপালন করছেন। অথচ এমনটি হবার  কথা ছিল না। 
         দেশ মাতৃকার শস্য-শ্যামলা বাগানটিতে দেশি ও বিদেশী কতিপয়  প্রাণী যথেচ্ছারভাবে এখনোও  লুটেপুটে খেয়ে যাচ্ছে তার সাথে যোগ্য সংগত করে যাচ্ছে যাদের এই  দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা  সরলচিত্তে  পাহারাদার হিসাবে মনোনীত করেছিল। 
        এত কিছু থাকা সত্ত্বেও দেশমাতার পরনে মলিন শাড়ি আর হাতে ভিক্ষার ঝুলি, কেননা তার সন্তানেরা কেউবা অনাহারে, কেহবা আধপেটা খেয়ে শুধু মাত্র তাদের অস্তিত্বটাকে টিকিয়ে রেখেছে।

        আমাদের জন্মাবধি শাসক হিসাবে যাদের দেখেছি, তাদের গায়ের রং আমাদেরই মতো। শুভ্র  রঙের শাসক দীর্ঘদিন ভারত ছেড়ে চলে গেছে, তাদের আমরা দেখিনি। কিন্তু তাদেরকে  অনুসরণ এবং অনুকরণের করার প্রবণতা আমাদের পাহারাদাররা এখনো  ভুলতে পারেনি।   তাইতো আমরা একই জায়গায় রয়ে গেলাম।     তাই স্বাধীন হয়েও আজ আমরা পরাধীন। 
         ঠিক তার পাশাপাশি  যখন এদেশে এসে দেখলাম,  ধর্ম চারণ করতে চার্চে আর কেউ যায়না। চার্চগুলি আজ আর্থিক অনটনে বিক্রিত হয়ে যাচ্ছে , সেখানে আমাদের দেশে গন্ডায় গন্ডায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কিন্তু উন্নত দেশগুলির অনুসরণে শিক্ষা  , অফুরন্ত কাঁচামাল আর মানুষের শ্রমের যেখানে কোন ঘাটতি নেই, সেখানে  নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছেনা। আর হবেই বা কেন ? পুঁজিপতিরাতো  ভয় পেয়ে গেছে, নতুন করে শিল্প গড়ার । 
        দেশের কর্ণধাররা তো  কতিপয় মানুষ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি চালাতে গেলে ভীষণ  অসহায় বোধ করে, কিন্তু এত মানুষকে নিয়ে দেশ চালনাটা কি করে তাদের সহজ কাজ হয়ে উঠলো, তা জানিনা। অবশ্য তাদের চালাতে হয় কতিপয় অন্ধ অনুরাগী  আর অবাধ আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে। তাদের বলা হয়, আমাদের কাজটা তোমরা দেখ বিনিময়ে তোমাদের যা যা দেশের সম্পদ ভালো লাগে তা  নিয়ে নাও। 
         ইংরেজদের ফেলে যাওয়া মানুষের মধ্যে  বিভেদের তৈরির  পরম্পরাকে মূলধন করে দেশ এগিয়ে চলেছে। যেভাবে রাষ্ট্র অনৈতিক কাজকে মান্যতা দিতে পারে, ঠিক সেই ভাবেই তারা  অনৈতিকতাকে দূরে ঠেলে  নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
             রাষ্ট্র একটা সংগঠন, তার একটা অভিমুখ থাকা উচিত, সেটা আজও অজ্ঞাত।   কতিপয় মানুষের স্বার্থ রক্ষা করাটা  রাষ্ট্রের অভিভাবকদের  কাজ নয়। সেখানে এক রকম জোর করে এই সহিষ্ণু জাতিকে এই মূল্যবোধের অধঃপতন থেকে উদ্ধার করার  গুরু দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব  দেশের কর্ণধাররা সাধারণ মানুষের উপর একরকম জোর করে  চাপিয়ে দিচ্ছে। 
            পাশ্চাত্যের মানুষ  যখন বাইরের পৃথিবীতে গভীর ভোগ সমুদ্রে নিমজ্জ্মান হয়ে জীবনের লক্ষ্যকে হারিয়ে দিকবিদিক শূন্য হয়ে শান্তির পিপাসায় ক্লান্ত তখন ভারতের দর্শনই দেখিয়ে যাচ্ছে তাদের মুক্তির পথ।  সেই পথের দিশারী  ভারতীয় দর্শন  তার  বিশালতাকে নিয়ে  ক্রমশ বিশ্ব মানচিত্রে স্বীয় জায়গা করে নিয়েছে ।
         তাই আজ দেখা যায় ২০০ বছরের পরাধীন ভারতের সেই নেটিভদের রচিত  শান্তিমন্ত্র এখন রানী এলিজাবেথের অন্তিম বিসর্জনে পঠিত হচ্ছে।
     আজকের পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম শক্তি চীন , বস্তুতান্ত্রিক সাফল্যের শৃঙ্গে উঠতে গিয়ে ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে মূল্যবোধকে। তার হৃত মূল্যবোধকে সমাজে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার মন্ত্র তাদের জানা নেই কিন্তু তারা জানে কোথায় পাওয়া যায়।  প্রাক্টিসিং বেদান্তই পুনরুজ্জীবনের মন্ত্র আর বিবেকানন্দের সেই ঐতিহ্যকে বহন করে চলছে রামকৃষ্ণ মিশন। 
        চীনের প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক তাই আজ সহযোগিতা চাইছে রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে তাদের   ছাত্র ও  যুবাদের মধ্যে  মূল্যবোধকে জাগ্রত করার।   অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের শাসকরা ভীষণ সচেতনভাবে সেই মানুষ গড়ার কারিগরদের দূরে সরিয়ে রেখেছে।
         শাসকের অনেক উদ্বেগ জাগানো কাজের  মধ্যে অন্যতম ছিল  শ্রী শ্রী  রামকৃষ্ণের  এই প্রেমহীন পৃথিবীতে মানুষকে ভালোবাসতে শেখানো  আর বিবেকানন্দর ভেদকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং সার্বজনীন ধর্মাচারের আহবান । ভিত্তি যেখানে ভেদাভেদ আর মানুষে মানুষে ঘৃণা ছাড়ানো, সেখানে ব্রিটিশরা কেন এনাদের  প্রাধান্য দেবে ?  সেই ব্রিটিশ শাসকদের  পরম্পরা আজও অনুসৃত হচ্ছে, অপসৃত হয়নি।  
         প্রবৃত্তি নয় নিবৃত্তিই একমাত্র মুক্তির , শান্তির পথ। এই পথই সারা দুনিয়া আজ আকৃষ্ট, সেখানে  পাশ্চত্যের পরিত্যাক্ত দর্শনের অনুরাগী হয়ে ভারতীয় পুঁজিবাদ ও শাসক দিশাহীন। সামন্তব্যবস্থার গর্ভজাত পুঁজিবাদ তার জন্মলগ্ন থেকেই দিশাহীন। জন্মান্ধ পুঁজিবাদের  প্রতি করুণা ছাড়া সৃঞ্জনীর আর কিছুই নেই।  

 বি: দ্রঃ  ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও  কমেন্ট করুন'       


 ব্লগার -রবীন মজুমদার

মহাভারতের যাজ্ঞসেনী- ৬৭ তম  অধ্যায় (১৩৫)

Searching for hidden Truth (৩৯) 

০৩/০৩/২০২৩ পর্যন্ত  ১৫৪ টি  ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
  • ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল্যবোধ  (১৫২)
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ২৩ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 
  • সন্ধিক্ষণ 
  •  অনুভূতির বহুগামিতা
  • অসুখ 
  •  সংকট কারে কয় 
  • অন্ধজনে দেহ আলো   





 

  

মন্তব্যসমূহ

Ani বলেছেন…
ভালো লাগলো দেশের অন্ধকার দিক আর তার প্রতিকারের দিকনির্দেশ।
চালিয়ে যাও।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়