মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬তম পর্ব ) ১৬০

 মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬তম  পর্ব ) ১৬০


            কাব্য সবসময় সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য মাধ্যম। সেটা হতে পারে নৈস্বর্গিক প্রকৃতির বর্ননা  অথবা নারী দেহের সুগভীর ছন্দ। সবক্ষেত্রেই কাব্য সমানভাবে সাবলীল। 

            যেমন  ভাষা দিয়ে ছবিকে বোঝানোর জন্য রূপকের যেমন যথেচ্ছ ব্যবহার করতে হয়, ঠিক তেমনি  নারী দেহের পুখানুপুংখ অঙ্গ-প্রতঙ্গের বৈচিত্রটাকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে রূপকের দরজায় কড়া নাড়তেই হবে। 

আবার ঠিক যেমন, একটা চিত্রশিল্পী ছবির বিভিন্ন অংশকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রঙের ব্যবহার করে থাকেন। তাই  উপস্থাপনার স্বার্থে কোথাও রূপকটি ভীষণ কঠিন, আবার কোথাও নরম, বা কোথাও শ্লীলতার মাত্রাকে অতিক্রম করতে হয়নি আবার কোথাও  সাহিত্যের অলঙ্কারের ভূষণে অশ্লীল শব্দকে আড়াল করে পরিবেশন করেছে। সেইখানে  অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজতে গিয়ে  পাঠককে বেশ নাজেহাল হতে হয় বৈকি।

             সাবেকি রূপকের ব্যবহার সংকৃত সাহিত্যের অতি প্রচলিত দৃষ্টান্ত। সেই  আবর্তে পাঠক বেশ চিন্তান্বিত হয়ে পরে কুয়োর অতলে গিয়ে রত্ন উদ্ধার করতে। অনেক ক্ষেত্রে ধরেই  নেওয়া হয় পাঠকের  উদ্ধার করা অর্থ যাইই হোকনা কেন সেটাই  কাব্যের মূল ভাব। 

             সাহিত্য যদি সামাজিক জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যিই থাকা উচিত। পাঠক যা পড়ে থাকে  তা অন্য কারোর অভিজ্ঞতার বর্ননা। কবির ভাবনার ইঙ্গিত হয়তবা মিলবে কিন্তু  ভাষ্যকারের  ভাবনাটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে পাঠকের কাছে , অবশ্য সেটা  যদি যুক্তিগ্রাহ্য বিষয়বস্তু হয়।   

        কাব্যিক রং আর সৃষ্টির তুলির টানে মহামতি ব্যাসদেব যাজ্ঞসেনীকে মহাভারতের পটভূমিতে  প্রস্ফুটিত যৌবনা নারী হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন।  তার শৈশব, কৈশোরের বর্ণনাকে উপেক্ষা করে অযোনীজাত প্রাপ্ত বয়স্কা নারী হিসাবে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। তার সৌন্দর্যের এবং ব্যক্তিত্বের পরিচয় সে তো বহুল চর্চিত ও  ইতিহাসবন্দিত বটে।  

কাব্য এইখানেই মহাকাব্য হয়ে উঠেছে। পাঠকের মনে জন্ম দিয়েছে অনুসন্ধিৎসারের।  পাঠক বরাবরই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত।  তারা কালও ছিল আজও আছে।  একদল বিনা মন্তব্যে মেনে নেয় অলৌকিকতাকে সত্য হিসাবে আবার আরেক দল, যদিও তারা সংখ্যায় নগন্য, তারা প্রমান ছাড়া বিশ্বাস করতে চায়না। সমস্যা হল এই দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠককূলকে নিয়ে। 

            পৃথিবীর ইতিহাসে যা কিছু সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তার কিছুনা কিছু কারণের জন্য এই কার্য্যটা করতে হয়েছিল।   মহাভারত রচনার পিছনে অন্যতম উদেশ্য  ছিল সমাজে 'পুরুষার্থে' র ( ধর্ম, অর্থ, কাম , মোক্ষ )  প্রতিষ্ঠা। ধর্মকে  উজ্জ্বল করতে গেলে  অধর্ম নামক অন্ধকারকে পাশাপাশি রাখতে হবে। সেই অধর্মের বাহক ছিল কৌরবরা। তাদের বিনাশের জন্য আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিযোগীদের  দরকার হয়ে পড়েছিল। এই শক্তিটি ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্মিলিত শক্তি। সেই শক্তির একটি অংশ ছিল পাঞ্চাল রাজা দ্রুপদ।  যিনি কৌরবদের ধংসের প্রত্যাশী ছিলেন।  রাজনৈতিক কারণে দ্রুপদ রাজার মিত্র ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। আগামী দিনে কৌরবদের ধংসের নায়ক ও নায়িকারা এই দ্রুপদ বংশ থেকেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। 

        আগামী দিনের নায়ক আর নায়িকাদের গড় মানুষের থেকে বেশী উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে মিথ গঠনের প্রয়োজনীতা ছিল। (যেই কারণে আজকের দিনে সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনে প্রচার যন্ত্রের মাধ্যমে জনমানসে নেতার মুখকে তুলে ধরা হয়ে থাকে )

ঋগ্বেদে অগ্নির পথ কৃষ্ণ কালো হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে। কৃষ্ণ  হলো সেই পথ যা অগ্নি হয়ে বনের মধ্যে দিয়ে যায়, বাতাস তাকে উত্তেজিত করে, তখন আগুনের শিখা তার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে সামনে থাকা সবকিছুকে ধংসস্তুপে পরিণত করে এগিয়ে যায়। তারপর, রেখে যায় একরাশ কালো ধোঁয়ায় মোড়া এক বিস্তীর্ন পথ প্রান্তর।  

 সেই অগ্নি  আবার নিকষ কালো অন্ধকারের বুক চিরে এক উজ্জ্বলতার প্রদর্শন করে। 

যাজ্ঞসেনীর আরেক নাম কৃষ্ণা ( যে আগুনে পুড়ে কৃষ্ণ আকার ধারণ করেছে ) যারা ক্ষত্রিয় হয়েও ক্ষত্রিয় ধর্ম  পালন করেননি, তাদের কাছে তিনি ধংসের প্রতিমূর্তি। এই ভয়ংকরতার লক্ষণ একমাত্র অগ্নির মধ্যেই দেখা যায়। ঠিক সেই কারনটা মনে রেখে  ব্যাসদেব চরিত্রগুলির শৈশবকে পাঠকের সামনে লুকিয়ে রেখে চরিত্রগুলির পুনর্নির্মাণ করে  যজ্ঞ থেকে সরাসরি মহাভারতের মঞ্চে নিয়ে এলেন।  

            মহাভারতের আদিপর্ব, সভা পর্ব, ঋগ্বেদ, বৃহদারণ্যক উপনিষদ, শতপথ ব্রহ্মন  ও মনিয়ারের ব্যাকরণে যে যে সংষ্কৃত শব্দগুলির অর্থ পাওয়া যায়। যেমন, বেদী  শব্দের অর্থ একটা উঁচু মাটি দিয়ে তৈরী  বলিদানের উদ্দেশ্যে, বেদীকে নারীর কোমর হিসাবেও বর্ননা করা হয় , বেদিকা শব্দের অর্থ বিছানা (বাৎসায়নের কামসূত্রে ) , যজ্ঞ অর্থাৎ বলি , কর্ম  , অগ্নিকে ব্যবহার করা হয়েছে আগুন, অগ্নিহোত্র , কাম , যৌনতা, যৌন স্বাধীনতা এবং যৌন মিলনের রূপক হিসাবে, যজ্ঞের পর  বীর্য নিঃসরণের  রূপক হিসাবে ঘৃতকে  ব্যবহার করা হয়েছে। 

 প্রত্যেক শব্দ তার নিজ অর্থ বহন করে থাকে কিন্তু শব্দগুলির অর্থের অভিমুখ  যদি একই  বস্তুর নির্দ্দেশ করে তাহলে, সেই গোটা রূপকটার গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা করলে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, দ্রৌপদী এবং ধৃষ্টদ্যুম্নর স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই  জন্ম হয়েছে। 

 ব্লগার -রবীন মজুমদার

 বি: দ্রঃ  ভালো লাগলে শেয়ার করুন , কমেন্ট করুন , ফলো করুন আর খারাপ লাগলেও  কমেন্ট করুন'   

 

০৩/০৪/২০২৩ পর্যন্ত   ১৬০টি  ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
  • ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল্যবোধ  (১৫২)
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ১৮+৬=২৪ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
  •  কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত (১-৩ পর্ব )
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন আশ্রিত ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 
  • সন্ধিক্ষণ 
  •  অনুভূতির বহুগামিতা
  • অসুখ 
  •  সংকট কারে কয় 
  • অন্ধজনে দেহ আলো   
  • প্রেমহীনতা কি  সামাজিক ব্যাধি  

  


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল