১৬৯ বিয়ে কি নারীর নিরাপত্তার না শোষনের পাকাপাকি হাতিয়ার ?

১৬৯   বিয়ে কি নারীর  নিরাপত্তার না শোষনের পাকাপাকি হাতিয়ার ?



আজকের আড্ডায়  রাজেশকে নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করতে শুরু করলো, কেননা গত কালই রাজেশের পাকা দেখা হয়ে গেল, সামনের অশ্বিন মাসে ওর বিয়ে। দীর্ঘ চার বছরের প্রেমপর্বের ইতি পায়ে এখন শিকল পড়তে হবে।            

      আশীষ বলে উঠলো, বিয়ে মানে কি প্রেমের  দেয়ালে শেষ পেরেকটা পরে গেল ?  বৈধতার প্রাক সম্পর্কে যে একটা রোমাঞ্চ আছে, তার উপর সিল মোহর পরে গেলে, মনে হয় অলক্ষ্যে কে যেন সবসময়ে নজর রাখছে।              

সতীশ বলল ওই দেয়ালের ওপারে কি আছে জানিস ?  আবার নিজেই বলে উঠলো, আস্ত একটা ঘানি। আগে যেমন সম্পর্কের মধ্যে ১০০ ভাগ ছিল শুধুই প্রেম, এখন সেই ১০০ ভাগের জায়গায় দায়িত্ব, কর্তব্য, সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারার কুশলতা , সংসারের ভার বহনের আসুরিক ক্ষমতা,  এর প্রত্যেকটার উপর আলাদা আলাদা নম্বর আছে  আর এই সব পরীক্ষা দেবার চাপে প্রেম একদম কোনঠাসা অর্থাৎ তুমি বাস্তবে কতখানি স্বার্থক  প্রেমিক বা প্রেমিকা  তা নির্ভর করছে কম্পালসারি সাবজেক্টে  কতখানি সফলতা  পেয়েছো তার উপরে। 

 এ যেন আতস কাঁচের তলায় পারফরম্যান্সকে বিশ্লেষণ।  তাই জন্যই বিয়েটা হচ্ছে দৃষ্টি উন্মোচনের পালা। অর্থাৎ যে প্রেমকে  নিয়ে তুমি আগে কুয়োতে বাস করছিলে, এবার তুমি সাগরে গিয়ে পড়বে।  

আড্ডার সর্বকালের মধ্যমনি হরিদা একটু  অস্বস্তিতে  পরে যাচ্ছিলেন।  এরা সবই বিয়ের মতো একটা মোস্ট সেনসেটিভ টপিকের উপর যদি সবই  বলে দেয় তাহলে তার দিকে সবার আকর্ষণ থাকবে কি করে ? 

এবার ছো মেরে টপিকটা কেড়ে নিলো হরিদা। বিয়েটা যেমন তেমন ব্যাপার নয়, এর এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে।  নর-নারীর অবাধ সম্পর্ককে সামাজিক বৈধতা দেবার নামই বিয়ে। 

 যদি তোরা জানতে চাস , তবে আমার সাথে তোরাও  পিছিয়ে যা কয়েক হাজার বছর  পিছনে। সময়কালটা মহাভারতের আদিপর্ব।   এমনিই একদিন সকালে ঘরের উঠানে ঋষি উদ্দালক ও তার পুত্র শ্বেতকেতু এবং শ্বেতকেতুর মা বসে ছিলেন। এমন সময় এক আগুন্তুক এসে শ্বেতকেতুর মা'র হাত ধরে আকর্ষণ করে তাকে নিয়ে চলে যায়। 

এই আকস্মিক ঘটনায় স্তম্ভিত শ্বেতকেতু তার পিতার কাছে জানতে চায় , কেন এই পরপুরুষের আকর্ষনে তার মা চলে গেলেন।  ঋষি উদ্দালক ভীষণ নির্বিকার হয়ে পুত্রকে উত্তর দিলেন, এটাই সমাজের রীতি।  সমাজে নারীর যেমন স্বাধীনতা আছে তার পছন্দের মানুষের সাথে কিছুদিনের জন্য চলে যাবার আবার পুরুষের ও সেই স্বাধীনতা আছে যে কোন নারীকে কিছুদিনের জন্য তার কাছে রাখার। অর্থাৎ পারিবারিক কোন বাধ্যবাধকতা নেই। 
শ্বেতকেতু, প্রথম সেই মানুষ যিনি সুদীর্ঘ সময় ধরে যুক্তি তর্কের অবতারণা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন এই বিবাহ রীতির। প্রত্যেকে নারীর একজন পুরুষকে নিয়ে  পারিবারিক জীবন অতিবাহিত  করতে পারবে, আর সেটাই বিবাহ নামে  পরিচিত। এটাতো গেল সামাজিক দিক। 
-  সমর বলে উঠলো,  আরে হরিদা বিয়ের আবার কত দিক আছে ? মনে মনে বললো , তোমার জ্ঞান আছে বলে, কোন টপিক বললেই মেমরি থেকে ডাউনলোড করে দাও । 
    হরিদা একটু বিরক্তির সুরে বলল, সেই যে  সিলেবাসের লক্ষণ  রেখাটা  তোদের ছোটবেলা থেকে টেনে দিয়েছে, তার বাইরে তোরা তো কখনও  যাস না, পাছে শাসক নামক রাবনের কাছে মার্কড  হয়ে যাস। ওরা  তো জানে, সিলেবাসের মধ্যে থাকলে তাদের বিপদ নেই , কেননা যা যা ইনগ্রেডিয়েন্ট দিয়ে সিলেবাস তৈরি হয়েছে , তাতে করে  সাবালক হয়ে  সে এক গৃহপালিত মানুষ ছাড়া আর কিছুই হবে   না। তার বাইরে গেলে ওদের বিপত্তি। জ্ঞান বাড়লে তো  ওদের পাত্তা দিবি না। 

    যাকগে, এর পিছনে যে অর্থনৈতিক কারন আছে, সেটাই তোদের বলবো। সমাজ একদিন গোষ্ঠী এবং কৌমতে বিভক্ত ছিল। তখন গোষ্ঠীর মধ্যে নারী কোন বিশেষ পুরুষের অধীনে থাকতো না। পুরুষের নারী নির্বাচন বা নারীর পুরুষ নির্বাচন সম্পূর্ণটাই নিজ নিজ ইচ্ছার অধীন। তারপরে, এলো যৌথ পরিবার, সেখানেও অনিয়ত্রিত নারী-পুরুষের মিলন। 
বৈদিক সাহিত্যে  এমন নজীরও দেখা যায় যে ,  অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত অর্থ যা নিজ শ্রম ছাড়া নিচের তলার শ্রমজীবী মানুষের পরিশ্রমের উপযুক্ত মজুরি না দেওয়াতে যে  লাভ হয়েছিল, সেই অর্থ এক শ্রেণীর মানুষের ঘরে ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হয়। তারাই সেই ধনকে বংশ পরম্পরায় ভোগের কারণের জন্য উত্তরাধিকারের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পরে। সেই কারনে তারা পরিবারে নারীর এক স্বামীর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে। যাতে করে পুরুষ জানতে পারে যে সন্তানটি একমাত্র তারই। তাই বন্দী করে রাখতে হবে নারীকে। নারী আর পূর্বের মতো স্বাধীনতা ভোগের অধিকার হারিয়ে অন্তঃপুর নিবাসী হয়ে উঠলো।  গৃহ কর্ম, চাষ-আবাদ এবং পুত্র উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। এল বিয়ে নামক এক নারীদের শোষনের  স্থায়ী বন্দোবস্ত কিন্তু পুরুষরা সেখানে স্বাধীন ।  

   চলবে  ...

০৪/০৮/২০২৩ পর্যন্ত   ১৬৯ টি  ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
  • ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল্যবোধ  (১৫২)
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ১৮+৬=২৪ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
  •  কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত (১-৪ পর্ব )
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন, ইতিহাস ও রাজনীতি  আশ্রিত   ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 
  • সন্ধিক্ষণ 
  •  অনুভূতির বহুগামিতা
  • অসুখ 
  •  সংকট কারে কয় 
  • অন্ধজনে দেহ আলো   
  • প্রেমহীনতা কি  সামাজিক ব্যাধি  
  • ১৬২ হিউস্টনের  ডাইরি (১০ তম পর্ব )
  • ১৬৩   রাম কি এখনও  বনবাসে আছেন ?
  • ১৬৪ হ রে ক রে ক  ম বা (১)
  • ১৬৫ এক্সটেন্ডেড মহাভারত 
  • ১৬৬  স্মাইল রিপ্লেসমেন্ট প্রজেক্ট (১ম )
  • ১৬৭  হাসির  পুনঃস্থাপন (২) 
  • ১৬৮ আমাকে দেখুন 
  • ১৬৯  বিয়ে কি নারীর  নিরাপত্তার না শোষনের পাকাপাকি হাতিয়ার ?







মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
ভীষণ যথার্থ বিশ্লেণধর্মী আলোচনা।নারী ঠিক ততটাই স্বাধীনতা পেয়ে এসছে যতটা পুরুষ নিজের সুবিধার্থে তাকে দিতে চেয়েছে।আলোচনা আরো চলুক ।আশায় রইলাম।

Unknown বলেছেন…
ভীষণ যথার্থ বিশ্লেণধর্মী আলোচনা।নারী ঠিক ততটাই স্বাধীনতা পেয়ে এসছে যতটা পুরুষ নিজের সুবিধার্থে তাকে দিতে চেয়েছে।আলোচনা আরো চলুক ।আশায় রইলাম।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়