১৭২ জাতের নামে বজ্জাতি

 ১৭২ জাতের নামে বজ্জাতি  



রামকিঙ্কর ভট্টাচার্যী মশাই অতি মাত্রায় সাত্ত্বিক হিসাবে গ্রামে পরিচিত। স্বপাক করে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করেন। কারোর ছোয়া ছুয়ি খান না।  জাতি ও বর্ণের গৌরবে তিনি ভীষণ গৌরবান্বিত।  অন্তত গ্রামের মানুষেরা একথা বলে থাকেন।  এহেন ভট্টাচার্যী মশাইয়ে ভীষণ ইচ্ছা হলো শহরে ভ্রমণ  করতে যাবেন।  

বেশ কয়েক বছর হলো ওনার স্ত্রী গত হয়েছেন, কিন্তু স্ত্রী সঙ্গের সুপ্ত ইচ্ছাটা মাঝে মাঝেই অন্তরে নাড়া চারা করে মনটাকে উদ্বেলিত করে তোলে। সেই অপূর্ন ইচ্ছার হাত ধরে তিনি ইতিউতি নজর আন্দাজ করতে করতে গণিকালয়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। 

শ্রাবনের সন্ধ্যা, মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে বর্ষা মৃদুমন্দ লয়ে বাতাসটাকে বেশ শান্ত করে দিয়েছে কিন্তু ব্রাহ্মণের মনটি আজ যে  বড়োই অশান্ত। যদিও ছাতা তার নিত্য দিনের সঙ্গী কিন্তু আজ সেটা পরিচিত মানুষের নাগাল থেকে আত্মরক্ষার জন্য অন্যতম হাতিয়ার। মাথায় অল্পসল্প চুলের বিদায়ের পর সঙ্গবদ্ধ বাকি চুলের মধ্যে থেকে বেশ প্রশস্ত টিকি-টি নজর কাড়ার মতো।  পরনের  ধুতি পাঞ্জাবীর সাথে এই টিকি-টি যুক্ত হয়ে স্বমহিমায় যেন তার বর্ণকে চিনিয়ে দিচ্ছে। 

সন্ধ্যা থেকেই এই দশ ফুট চওড়া রাস্তাটা হাতে টানা রিক্সা আর পথ চলতি পথিকে ভারাক্রান্ত।  খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এক পথিককে জিজ্ঞাসা করে বসলো--
-- ভাই, এখানে ব্রাহ্মণ গণিকা কোথায় পাওয়া যায় ?
--পথিকটি পাড়ায় দীর্ঘদিনের আবাসিক, আজ পর্যন্ত  শোনেনি , কেউ এসে   কোন গণিকাদের পেডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন করেছে। 
 - উত্তর মেলেনি। 
-ভট্টাচার্যী মশাই বুঝতে পারলেন, ধর্মঘট ডাকার সময় যেমন ধর্মঘটীরা অত্যাবশ্যক সার্ভিস বলে কিছু কিছু জায়গায় ছাড় দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি সমাজের মাথারা বিশেষ কতগুলি জায়গায় জাতিভেদ, বর্ণভেদ প্রযোজ্য নয় বলে ঘোষণা করেছিলেন। কেননা দিনান্তে ওটাই  তাদের শান্তিবন। 

এই ঘটনাটি চায়ের দোকানে হরিদার মুখ থেকে শোনা। ব্যাস ! আর যায় কোথায় একের পর এক প্রতিক্রিয়ার ঝড় নেমে এলো। 

অবিনাশ বলল ,  যৌনতার প্রশ্নে পুরুষ জাতি,ধর্ম, বর্ণকে ঘরে রেখে আসে। কামার্ত মুনিরাও যখন বৈজ্ঞানিক  ধর্ষণে ( যেমন, পরাশর মুনি মৎস কন্যা সত্যবতীর সাথে মিলনের পূর্বে  তাকে কনভিন্স করেছিল কিংবা সূর্যদেব কুন্তীকে বলে ছিল সোনার বর্মে মোরা পুত্র সন্তান উপহার দেবে সঙ্গে ফ্রি হলো কুমারীত্ব, এই  প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিমরাজি কুন্তীর সাথে মিলন করেছিল)   উদ্দত হয় তখন কি সেই নারীর কুন্ডলি মিলিয়ে কি মিলিত হয়েছিলো ? প্রাচীন সাহিত্যগুলি  তার সাক্ষী। সমাজের সিলেবাসের বাইরে কোন সমালোচিত কাজটি  শাসক কিংবা ক্ষমতাবান পুরুষদের দ্বারা সংগঠিত হয়, তখন তাকে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়।  এইরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। 

সূর্যদেবের ইপ্সিত মিলন এবং তার পরে মিলনের চিহ্নকে  মুছে ফেলে  পুনরায় কুমারীত্ব ফিরিয়ে দেবার ঘটনাটি আগামীদিনে সাদা ও কালো রাজনীতির মধ্যে একটা সুক্ষ ফারাককে ইঙ্গিত করে।  "যেমন বেণী তেমন রবে চুল ভেজাবো না"।  
  
 বিমল বললো, মহাভারতে আমরা দেখছি রাজপুরুষদের পুত্র সন্তানের অভাব পূরণে "নিয়োগ পদ্ধতিকে" ধর্মের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছিল।  যার ফল স্বরূপ বেদব্যাস কর্তৃক নিয়োগ পদ্ধতিতে ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুরের আগমন। 

যখন শাসকের কোন নীতি থাকেনা তখন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে। আর এই  দেশটা  তো জন্ম লগ্ন থেকে এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়ে জীবন শুরু করছে। সেখানে এটা তো ভীষণ সহজ  কাজ। 

 অশোক  বলল আচ্ছা, জাত পাত , বর্ণ ,ধর্মের যদি এতই বিভাজন  থাকে তবে ধর্মের ভিত্তিতে, বর্ণের ভিত্তিতে   গণিকালয়, শ্মশান ঘাট, চিকিৎসা কেন্দ্র, হোটেল, রেস্টুরেন্ট,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়  ইত্যাদি  আলাদা আলাদা করে তৈরি করা হয়না কেন ?  বিপদের ধর্ম এক আর  বিপদমুক্ত হলে আবার ধর্ম আলাদা হয়ে যায়।  

ধর্মের উঁচু ভাব হলো মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ,ভালোবাসা, পরের উপকার করা , অপরকে ঈর্ষা না করা , নম্র হওয়া, আমিত্ব বর্জন করা। আর নিচু ভাব হোল 'ধর্ম' নামটিকে নিয়ে সাইন বোর্ড বানিয়ে ভেদাভেদকে প্রতিষ্ঠিত করা। 
  হরিদা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, শোন কোনটাকে প্রমান সহকারে সত্য বলে মানতে হবে তার মৌলিক বা প্রাথমিকভাবে কতগুলি পরীক্ষা আছে আর সেই পরীক্ষাগুলি পাশ করলে তাকে সত্য বলে গ্ৰহণ করা যায়। আমাদের মূল প্রশ্ন বা বিষয় হলো প্রচলিত ধর্ম বলে যে সমস্ত ব্যাখ্যাকে আমরা জানি, তার মধ্যে কোনটি সত্য আর কোনটা মিথ্যা। সত্যকে গ্রহণ করতে হবে আর মিথ্যাকে ত্যাগ করতে হবে। এটাই আমাদের মুখ্য বিষয়। 
যা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয় তার অস্তিত্ব অবশ্যিই ক্ষনিকের। আজ যেটার উৎপত্তি হয়েছে কাল সেটা ধংস হয়ে আবার নতুন কোন ব্যাখ্যা নিয়ে অবতীর্ন হয়, ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে, তাহলে তাকে কি সত্য বলা যায় ? অবশ্যিই বলা যায় না।  তাহলে সেটা অবশ্যিই মিথ্যা। 
পাশাপাশি, যার কোন পরিবর্তন হয়না, যার কোন ধংস  নেই, যে  শাশ্বত, চিরন্তন সেই-ই  আমাদের সনাতন ধর্ম। যার ভিত্তিই হচ্ছে পরধর্মসহিষ্ণুতা। 
ভারতীয় দর্শন  বলেছে, প্রকৃতিতে সৃষ্টির সাথে সাথে তিনটি গুণ নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে  অবতীর্ণ হয়। সত্ত্ব গুণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে  ধর্মজ্ঞানী বা সৎ মানুষ হিসাবে। রজঃ গুণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে রাজসিক বা অহংকারী হিসাবে আর তম গুনকে মানুষের তামসিক বা অন্ধকার হিসাবে।  
যে মানুষ তার অন্তপ্রকৃতিতে এই বিবিধ গুনের সমারোহ নিয়ে বসবাস করছে, তাকে তো বিভেদের মন্ত্রে দীক্ষিত করা যায় না। 
যেখানে অদ্বৈত বেদান্ত বলছে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে একই আত্মা বিরাজ করছে, তাকে বিভেদের পাঠ যারা পড়াচ্ছে তারা হচ্ছে বেদান্ত বিরোধী। অর্থাৎ সনাতন  ধর্ম বিরোধী। 
সব দেশেই এই ধরনের ত্রুটি আছে, সেখানে ধর্মের কোন দোষ নেই, আছে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে অজ্ঞানতা।  

 ০৭/০৮/২০২৩ পর্যন্ত   ১৭২ টি  ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
  • ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল্যবোধ  (১৫২)
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ১৮+৬=২৪ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
  •  কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত (১-৪ পর্ব )
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন, ইতিহাস ও রাজনীতি  আশ্রিত   ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 
  • সন্ধিক্ষণ 
  •  অনুভূতির বহুগামিতা
  • অসুখ 
  •  সংকট কারে কয় 
  • অন্ধজনে দেহ আলো   
  • প্রেমহীনতা কি  সামাজিক ব্যাধি  
  • ১৬২ হিউস্টনের  ডাইরি (১০ তম পর্ব )
  • ১৬৩   রাম কি এখনও  বনবাসে আছেন ?
  • ১৬৪ হ রে ক রে ক  ম বা (১)
  • ১৬৫ এক্সটেন্ডেড মহাভারত 
  • ১৬৬  স্মাইল রিপ্লেসমেন্ট প্রজেক্ট (১ম )
  • ১৬৭  হাসির  পুনঃস্থাপন (২) 
  • ১৬৮ আমাকে দেখুন 
  • ১৬৯  বিয়ে কি নারীর  নিরাপত্তার না শোষনের পাকাপাকি হাতিয়ার ?
  • ১৭০ আর কত গুন থাকলে তাকে  জাতীয় নায়ক  বলা যায়  
  • ১৭১  ভাবমূর্তির রকম ফের-
  • ১৭২  জাতের নামে বজ্জাতি (আই ওপেনার )



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়