(১৭৩)  কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত  (৫ম  পর্ব )


চতুর্থ পর্বের পর ০০০০০০০০ 

রাগ মালকোষ 

  এসেছে তো সেই ক্ষণ,  যেই ক্ষনে ঘুমায় পৃথিবী,  চাঁদের  বুড়ি তখন চুপি চুপি তার  চরকাতে সুর বাঁধে , আবার, প্রিয়া মিলনের উপযুক্ত এই সময়ে  কোন দুর্দম প্রেমিক  ঘরের দরজার শিকল তুলে শ্বাপদ সংকুল  ঘন বনের  মধ্যে দিয়ে  দীর্ঘ পদ যাত্রা শুরু করে। কোথায় যেন বেজে উঠে সংগীত প্রেমীর অঙ্গুলি  লেহনে  তানপুরার পুরুষালি সুর, সে তখন নিচু গলায় আবাহন করছে রাত্রিকে তার  সাথে মিলিত হতে।  দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে রাজকুমারী ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর মুখে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পরে।  এই রাতেই প্রাণী ধীরে ধীরে সারাদিনের  দুরন্ত ইন্দ্রিয়গুলি শান্ত হলে স্বপ্নের সাথে কথা বলে।  বহু দূর থেকে চৈতন্য এ সবই নজরে রাখে। 

নিশীথের এই  নির্জনতা আর  মেঘের সাথে চাঁদ আর তারাদের লুকোচুরির খেলা  দেখতে দেখতে রুক্মিণীবাই  কখন যেন সে মেঘ হয়ে   গিয়েছিলো,  তা সে নিজেই জানেনা।

      ঘুমন্ত হংসরাজের   বাহূ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে,  আকাশের ভেসে যাওয়া মেঘদের হাতছানিতে  মাঠঘাট পেরিয়ে কখন যেন  নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলো ।  হঠাৎই  হংসরাজের আহবান নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ  করে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে রুক্মিনীর কর্ণকুহরে এসে বাঁশির সুরে বেজে উঠলো।   

 ঊর্ধ্বাকাশ বিহারী মন যেন  ছন্দে ফিরলো মর্তের  ডাকে। এই তো সেদিন পর্যন্ত এই আওয়াজের উৎসমুখটা একেবারেই অজানা-অচেনা ছিল।  আজ সেই শব্দটা যেন হাজার ঘোড়ার রথের  হ্রেষার  ধ্বনিতে  তোলপাড় করে দিলো রুক্মিনীর অন্তরকে।    

কি  সুর ঝংকৃলো  আজি   আমারই   তন্ত্রিতে 

 জীবনে এই স্বাদটা রুক্মিনীর মতো নগরনন্দিনীদের কাছে ভীষণই এক  অচেনা অনুভূতি। একেই বোধহয় প্রেম বলে। প্রেম প্রকৃতিরই দান,  কখন কার কাছে কিভাবে  এসে নীরবে আশ্রয় করে , সেই দিনক্ষণ কেউই জানেও না, বুঝতেও পারেনা।

     আত্মা ছাড়া কেউই এই জগতে চিরস্থায়ী নয়, আর যখন প্রেমকে পার্থিব বস্তু বলে মানুষ ভুল করে তখন সেই অনন্তকে বস্তু বলে আঁকড়ে ধরে। সেখানেই প্রেমের উপর আরোপিত হয় বস্তুধর্ম , আর যেই সে বস্তু হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখনিই শঙ্কা উঠে তাকে হারানোর, বিরহ হচ্ছে হারিয়ে যাবার শেষ পরিণতি সম্পর্কিত ধারণা।    প্রেম যদি অনন্ত হয়, তাহলে সেই অনন্তকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা কারোর নেই, তাই বিরহই একমাত্র  প্রেমের প্রকাশ। 

    প্রেম আর তৃষ্ণা যেন সমার্থক। প্রেম যেখানে অপূর্ন , তৃষ্ণা সেখানে আরও গভীরে।   ভক্ত যেমন ঈশ্বর লাভে পাগল, ঠিক তেমনি মানুষও পাগল প্রেমকে খুঁজতে।  জীবনের বাঁকগুলিতে একই প্রেম   দেখা দেয় বহুরুপে, তাই প্রেমের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে মানুষ  বিভ্রান্ত হয়ে যায়।    তাই তো মানুষ ভুল করে ভোগকে আঁকড়ে ধরে।  ভোগ তো অপূর্ন তৃষ্ণার প্রতিমূর্তি , যা কখনই পূরণ হবার নয়। তাই না পাওয়ার বেদনাই থেকে যায় প্রেমের রূপ ধরে।  

মানব জীবনে প্রেমের অনুভতি 
জীবের সংসারে আলাদা করে প্রেমকে চিহ্নিত করা যায় না, আর যাঁকে আলাদা করা যায় না, সে তো উপাসনার বস্তু হতেই পারেনা।  যাঁকে সাধনা করা যায় না , তাঁকে লাভ করবেই বা  কি করে?  বস্তু জগতে প্রেম সবকিছুর মধ্যে থেকেও নাম ও রূপের গোলকধাঁধায়     মানুষকে বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে ।  
 
সে  আমারে পাগল করেছে 

    প্রজাপতি কি  থেকে জানতো, কোন ফুলের সাথে তার সখ্যতা হবে ?  তাই তো প্রেম জীবনের এক অনিবার্যতা।   চিনতে না পেরে হোঁচট খাওয়টা  তো অন্ধত্বেরই  লক্ষণ, তাই  সেই অর্থেই প্রেম অন্ধ।    

     সচেতনভাবে কোন হৃদয়ের দেয়া নেয়া , আর যাই হোক সেটাকে  জাগতিক প্রেম বলা যাবে না, সেটা কসমেটিক প্রেম। যেখানে থাকবে একরাশ দিশাহীন পথ, প্লটহীন গল্প, কতগুলি নির্বুদ্ধিতার ধারাবাহিকতা , মানে ছাড়া কথা, একই বৃত্তে বারবার ঘোরা , মনের দরজার চাবি হারিয়ে ফেলা, আবার কাল্পনিক বিয়োগের কথা ভেবে বালিশের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নিজের কাছে নিজের  বিরহকে কান্নায়  প্রকাশ(কেননা আগের দিন প্রেমাস্পদের কথার মানে বোঝেনি ) ইত্যাদিই  হচ্ছে প্রেমের সঠিক লক্ষণ। আর এই উপসর্গগুলি প্রথম অবস্থা থেকেই  যদি অনুপস্থিত থাকে তবে ভেবে  দেখতে  হবে, সেটার অভিমুখ অন্যত্র,  নিশ্চই সেটা প্রেম নয়, প্রেমের মতো দেখতে অন্যকিছু ।   

দিনের শেষে ঘরে ফেরা 

নিজের অবস্থান আর আগামী দিনে সমাজ থেকে নির্বাসিত নারী কি ভাবে সংসারের মূলস্রোতে ফিরে আসবে, সেই  কথা ভেবে রুক্মিণী অকপটে হংসরাজকে উজাড় করে দিল তার সংশয়ের  কারণ । 

-     এই সমাজে  পরিচয় যাদের  গণিকা হিসাবে।  দেহদানের পরিবর্তে অর্থ কিংবা  উপহারের মাধ্যমে যার পরিণতি , তাই এই পেশাটাকে  বাণিজ্য বলা যায় । মা- দিদিমাদের মুখে শোনা , সমাজ পত্তনের সময় থেকে গণিকাবৃত্তিকে সমাজ স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। 

     দেশের সৈনিকরা যেমন বৈদেশিক  আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে থাকে,  ঠিক তেমনি পুরুষের কামান্ধতায়  পরিবার তথা  সমাজকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো গণিকারা দাঁড়িয়ে আছে সমাজকে বাঁচাতে, পাশের বাড়িকে রক্ষা করতে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিক একদিনই মৃত্যু বরণ  করে  কিন্তু গণিকারা প্রত্যেক দিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে, সেই যন্ত্রনা নিয়ে আবার পরের দিন মৃত্যুর মুখমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। 

  একদিন যাঁরা পরিবারের নাড়ির সাথে যুক্ত  ছিল, অজানা কোন অপরাধে তাদের সমাজের মাতব্বরেরা উদ্বাস্তু করে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এই ছুড়ে ফেলার এক পরম্পরা তৈরি করে রেখেছে। আস্তাকুড়ের জঞ্জালের মধ্যে যেমন অন্যান্য প্রাণী তাদের বাঁচার রসদ খোঁজে, ঠিক তেমনি কিছু   কামার্ত মানুষেরা যাদের  ঘরে থাকা সঞ্চিত কুঁজোর জলে  তৃষ্ণা মেটে না তারা ঘরের বাইরে এই আস্তাকুড় স্বরূপ  জলাশয়ে তৃষ্ণা মেটাতে আসে। এখানেও রুক্মিণীদের  প্রেমের মৌলিকত্ব বাস্তব সমস্যার সাথে মিলেমিশে নতুন এক যৌগিক প্রেমের জন্ম নিলো। তাই জীবনের ভাবি চেহারাটিকে  উপলদ্ধি করে হতাশ হয়ে রুক্মিণী  অশ্রু সিক্ত নয়নে   হংসরাজের বুকে মাথা লুকালো। 
  
ক্ৰমশঃ 

৯/০৮/২০২৩ পর্যন্ত   ১৭৩ টি  ব্লগ পোস্ট করা  হয়েছে 

আত্মদর্শনমূলক ব্লগ - 

  • ওপারের সংগীত 
  • ঐকতান 
  • সভ্যতার নামে  প্রহসন 
  • নাড়ী ছেড়ার গান 
  • আত্মত্যাগ কখনো কখনো আত্মহত্যার সামিল হয় 
  • দলিতের সভ্যাভিমান 
  • একটি প্রান্তিক মানুষের মৃত্যু সভা 
  • ২১শে ফেব্রুয়ারীর মূল্যবোধ  (১৫২)
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
জীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি  মানুষের সংগ্রামের কথা   -
  • চে গুয়েভারা দ্য রেভলিউশনারী আইকন অল দ্য টাইম ( ৪টি পর্বে )
পৌরাণিক - বিশ্লেষণমূলক  
  • আমি মহাভারতের পৃথা (১৭টি পর্বে )
  • ব্যাসদেবের জীবনের অপ্রকাশিত ঘটনা 
  • মহাভারতের রাজনীতি ও নারীদের নীরব বলিদান (৬ টি পর্বে )
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৬টি পর্বে )
নগর দর্পন -
  • ধর্ম ও শাসক 
  • সমাজের রাজন্যবর্গ 
  • হালচাল 
  • সহাবস্থান 
  • নারদের মর্তে ভ্রমণ ( ১৮+৬=২৪ টি পর্বে )
  • মনীষীরা কি আজকের রাজনীতির কাঁচামাল 
  • ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই এই সুন্দর ভুবনে 
  • রজ্জুতে সর্প দর্শন 
  •  কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত (১-৪ পর্ব )
নিছক প্রেমের গল্প -
  • বনবিতান 
দর্শন, ইতিহাস ও রাজনীতি  আশ্রিত   ব্লগ -
  • অহংকারের রসায়ন (৮টি পর্ব - এখনো চলছে )
  • আসা আর যাওয়া 
  • সংঘর্ষ 
  • উত্তর মীমাংসা 
  • আগামী 
  • আমরা বাস করি আনন্দে 
  • সৃষ্টির মুলে দন্দ্ব 
  • অখন্ড যখন খণ্ডিত হয় 
  • কোথায় পাব তারে 
  • গোলক ধাঁধা 
  • চির যৌবনা 
  • রূপ ও স্বরূপের লুকোচুরি 
  • একটি অক্ষরের গল্প 
  • মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৫ টি পর্বে -এখনো চলবে )
  • সরণি 
  • পরম্পরা 
  • মেলবন্ধন 
  • সন্ধিক্ষণ 
  •  অনুভূতির বহুগামিতা
  • অসুখ 
  •  সংকট কারে কয় 
  • অন্ধজনে দেহ আলো   
  • প্রেমহীনতা কি  সামাজিক ব্যাধি  
  • ১৬২ হিউস্টনের  ডাইরি (১০ তম পর্ব )
  • ১৬৩   রাম কি এখনও  বনবাসে আছেন ?
  • ১৬৪ হ রে ক রে ক  ম বা (১)
  • ১৬৫ এক্সটেন্ডেড মহাভারত 
  • ১৬৬  স্মাইল রিপ্লেসমেন্ট প্রজেক্ট (১ম )
  • ১৬৭  হাসির  পুনঃস্থাপন (২) 
  • ১৬৮ আমাকে দেখুন 
  • ১৬৯  বিয়ে কি নারীর  নিরাপত্তার না শোষনের পাকাপাকি হাতিয়ার ?
  • ১৭০ আর কত গুন থাকলে তাকে  জাতীয় নায়ক  বলা যায়  
  • ১৭১  ভাবমূর্তির রকম ফের-
  • ১৭২  জাতের নামে বজ্জাতি (আই ওপেনার )
  • ১৭৩ কুরুক্ষেত্রে  একটি  বিনিদ্র রাত (৫ম  পর্ব )






  

মন্তব্যসমূহ

My new blog বলেছেন…
Bujhte para Jay na ko othay montobyo likhbo।
My new blog বলেছেন…
Mk ontyobyo yto korchi kintu kothay jachhe bujhte parchi na।
My new blog বলেছেন…
Montyobyo ta korchi kintu kothay jachhe bujhte parchi na।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়