(১৮৪) অমরত্বের ব্যঞ্জনা

(১৮৪)  অমরত্বের ব্যঞ্জনা 


খুব সংক্ষেপে পূর্ববর্তী ব্লগ  "গ্রিনরুমের অন্দরে"র পর -----    শিবের বহুমুখী প্রতিভার অল্পবিস্তর  আভাস দেওয়া হয়েছে।  আগামী দিনে তার সৃষ্টির বদান্যতায় স্বর্গ, মর্ত ও পাতালবাসীরা মুক্ত হবে দানবের হাত থেকে।  এতবড় একটা কর্মকান্ডের জন্য একটু তো দীর্ঘসূত্রতা হবেই। ।  এই কাহিনীর পিতৃত্বের দাবিদার পুরাণ। যদিও এই পুরাণকে সংকীর্ণ অর্থে  "মাইথোলজি " আখ্যা দিয়ে  ইংরেজ ঐতিহাসিকরা ভারতীয় পুরাণের মাহাত্মকে ক্ষুন্ন করতে উদ্যোগী। পুরাণের  অন্দরমহলে না প্রবেশ করলে সাহেবদের মতো আমাদেরও মনে হবে কি এক গাঁজাখুরি গল্প। তাই পুরাণের  হাত ধরে পুরাণে  ফিরে  যাওয়াটাই পুরাণের প্রতি সুবিচার হবে। 

কর্ম দিয়ে যখন ভবি ভোলেনা , তখন তাকে ধর্ম দিয়ে ভোলাও ।।

পুরাণের  সত্যতার যাচাইয়ের প্রক্রিয়া 

একসনয়ে ভারতবর্ষ ছিল বহু ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। প্রত্যেক রাজাদের সভায়  মাগধ নামে  একজন ইতিবৃত্তকার থাকতেন, তাদের কাজই ছিল রাজাদের বংশ পরিচয় থেকে শুরু করে তাদের কীর্তিকলাপকে সংরক্ষিত করে রাখা।  

ঠিক তার পাশাপাশি সূত নামক একশ্রেনীর সম্প্রদায় ছিল, যাঁরা বংশ পরম্পরায় তৎকালীন সময়ের  রাজরাজাদের আদ্যোপান্ত থেকে শুরু করে  প্রথিতযশা মহাত্মাদের খবরাখবর নিজেদের কাছে রেখে দিতেন।  পুরাণের বহু জায়গায় এই সূতদের সত্যের পালক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।   

যজ্ঞই ছিল সেই মঞ্চ, যেখান থেকে রাজ্যস্তরের ইতিহাস গিয়ে জাতীয় ইতিহাসের সাথে মিলে যেত।  সেই যজ্ঞে যেমন রাজা ও ঋষিরা, নানা দেশ থেকে আমন্ত্রিত অতিথিরা যেমন  থাকতেন, তার সাথে সূত এবং মাগধরাও থাকতেন। সেই যজ্ঞানুষ্ঠানে যখন কোনো মাগধরা তাদের সংগৃহিত ইতিবৃত্ত পড়তেন, সেখানে রাজানুগ্রহবশত যদি কোন সত্যের অপলাপ ঘটতো, সেখানে সূতগণ সংশোধন করে দিতেন। সেই কারণে, সূতদের সত্যপরায়ণ বলা হতো।  এই কাহিনীগুলিকে লিপিবদ্ধ করাই ছিল এক শ্রেণীর ঋষিদের কাজ। এই গ্রন্থ গুলিই সময়ের সাথে পুরাতন হয়ে পুরাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা শুনবে, যা দেখবে, তাকেই কোনরকমের পরিবর্তন ছাড়াই লিখতে হবে।  এটাই পুরাণ লেখার আদর্শ। 

পুরাণের শ্রেণীবিন্যাস (হায়ারার্কি)

সৃষ্টি থেকে প্রলয় আবার প্রলয়ের পর সৃষ্টি, নিরন্তর এই সময়ের আনাগোনা।  এর মধ্যে যেমন আছে  রাজ্য ও সমাজের যাবতীয় ঘটনাবলী, ঠিক তার পাশাপাশি প্রকৃতি কখন কোথায়  মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়েছে তাকেও আলোকপাত করা হয়েছে। এই সমস্তু তথ্যই ছিল তৎকালীন ইতিবৃত্তে।  কালের নিয়মে সেই ঘটনাবলী পুরোনো হয়ে গিয়ে পুরাণ নামে চিহ্নিত হয়েছে।  এই নামের প্রকান্তরে কিন্তু সে কখনই তার ঐতিহাসিক চরিত্রটাকে হারিয়ে বসেনি, বরং কিছু সংকীর্ণমনা অনৈতিহাসিক  আর সাধারন মানুষের বস্তুর গভীরে না যাবার মানসিকতায় বার বার পুরাণকে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছে।  

 বিষ্ণু পুরাণ ও বায়ু পুরাণ সবথেকে পুরানো পুরাণ।  বায়ু পুরাণে একটি শ্লোকের বাক্যবিন্যাসের মধ্যে পুরাণের ইমারতটা দাঁড়িয়ে আছে, 

সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মণ্বন্তরানি চ। 

বংশানুচরিতং চেতি পুরানং পঞ্চলক্ষনম্ ।।

 শ্লোকের অর্থের মধ্যেই পুরাণের লক্ষণগুলি বলা আছে। সর্গ , প্রতিসর্গ , বংশ , মন্বন্তর ও বংশাণুচরিত এই পাঁচটি  উপসর্গ থাকলে তাকে পুরাণ বলা যায়। সারা বিশ্বের সৃষ্টিকে সর্গ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে।  প্রলয়কে বলা হচ্ছে প্রতিসর্গ।  যেখানে রাজা থেকে শুরু করে নামকরা ঋষি, দেবতা ও অসুরদের বংশবৃত্তান্তের বর্ণনা দেওয়া আছে তাকে বলা হচ্ছে বংশ। কালকে নির্ধারণ করার জন্য যেমন, বঙ্গাব্দ, খ্রিস্টাব্দ , শতাব্দী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, ঠিক তেমনি মন্বন্তর বা মনুকাল হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।   রাজরাজারা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের  সৃষ্টি থেকে শুরু করে তাদের  কীর্তিকলাপের যাবতীয় সম্ভার বংশ ও বংশাণুচরিতে লেখা আছে। 

বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পুরাণকারেরা কিছু যে অতিরিক্ত  শূন্য ডানদিকে বসিয়ে সেই সব বিখ্যাত রাজাদের  কিছু অলংকার সহযোগে  তাদের  প্রতি  শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ফেলেছিলেন তা অনস্বীকার্য, তথাপি সহস্র  বানাবার তিনটি "০০০" বাদ দিলে আসল সংখ্যাটি বেরিয়ে আসবে।  উদাহরণস্বরূপ  বলা যায় , রামচন্দ্রের রাজত্বকালকে ১১,০০০ বছর  হিসাবে দেখানো হয়েছে।  আসলে রামচন্দ্র ১৫ বছর বয়সে সীতাকে বিয়ে  করেন, ২৭ বছর বয়সে বনে গেলেন এবং ৪২ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে  ১১ বছর রাজত্ব করে তিনি পরলোক গমন করেন।  এই রকম কিছু রঞ্জকে অতিরঞ্জিত আছে পুরাণ কিন্তু সে তার কৌমার্য্যকে শত বাধা  বিপত্তি সত্ত্বেও  অমলিন রেখেছে। 

 অমরত্বের সাধনায় পুরাণ

যজ্ঞের আগুনে পরীক্ষিত হয়ে যার পবিত্রতা অক্ষুন্ন, সেই পুরাণকে অমরত্ব দিতে না পারলে সব প্রচেষ্টাই বৃথা। ভারতীয় ঋষিরা, যারা পুরাণকে রচনা করেছিলেন, তাঁরা বাস্তবতার নিরিখে  অনুসন্ধান করে দেখলেন, একমাত্র ধর্মই একটা প্রলয়কাল পর্যন্ত তার দেহ ধারণ করে থাকে। মানুষের অস্তিত্বের সাথে ধর্ম একাত্ব হয়ে আছে। ধর্মের সাথে মেলবন্ধনই একমাত্র  পুরাণের বেঁচে থাকবার অবলম্বন। বহু আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পথ নির্দেশনা যখন সমাপ্ত হলো, তখন প্রয়োজন হলো তাকে বাস্তবায়িত করা।  ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস এবং সেটি বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখেনা। যুক্তি সেখান থেকে কয়েক যোজন দূরে। তাই সেই ফাঁকটি পূরণের জন্য অলৌকিকতার  দ্বারটি অবারিত।  পুরাণকে আশ্রয় করে নতুন করে  ধর্মশাস্ত্রের রচনা হলো এবং এর সঙ্গে পুরাণ পেলো তার ইপ্সিত অমরত্ব। তাই এখনো ভারতীয়দের মধ্যে পুরাণকে কানে শোনা , পুরাণকে ভক্তি সহযোগে পাঠ , ব্রাহ্মণকে পুরাণ  দান করার মধ্যে মানুষ পুণ্যের খোঁজ করে। 

ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -২০/১২/২৩

rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়