(১৮৫) পুরাণের গতিশীলতা
(১৮৫) পুরাণের গতিশীলতা
আজ যখন অন্ন ধর্মের সমার্থক হয়ে রাষ্ট্রীয় বাতাবরণকে কৃত্তিম আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে, তখন আরো বেশি করে ইতিহাস থেকে সত্যকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা আজ ভীষণ প্রয়োজন। প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের ভিত্তি প্রস্তরটা স্থাপিত হয়েছিল ধর্মের উপর। সেই পরম্পরার আজও কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। পুরাণের স্থায়িত্ব এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বলে, আজও তার প্রতি অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস অমলিন।
পূর্ববর্তী ব্লগ (১৮৪) অমরত্বের ব্যঞ্জনার পর ০০০০০০
দর্শন করার সাথে দর্শনের সংযোগ
যা কিছু শিল্প, সাহিত্যকলার মূল সৃষ্টিটা আবর্তিত হয় প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। সেই প্রকৃতিকে কে কিভাবে দেখেছিল এবং তাতে করে মনের ভাবনার সাথে চাক্ষুস উপলদ্ধির মিশ্রনের উপস্থাপনাটা দর্শক দেখে থাকে। ভারতীয় পৌরাণিকরা মূলতঃ দার্শনিক পরে ইতিবৃত্তকার। তাই ঋষিরা কখনই নিজেদেরকে দার্শনিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত করে পুরাণটা লেখেন নি। আর কাব্য যেখানে বস্তু প্রকাশের মাধ্যম, সেখানে কবির সৃজনশীলতা ফুটে তো উঠবেই।
যেমন, কোন বর্ষাকে যদি বর্ণনা করতে হয়, তাহলে হিন্দুরা বলবে এটা বরুণদেবই জল বর্ষণ করছেন। কেননা , হিন্দু পুরাণে বরুণদেবকেই এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। গুজরাটের ভুজের বিধ্বংসী ভূমিকম্পকে যদি পুরাণকারগণ ভাষায়িত করেন, তাহলে, তাঁরা বলবেন, সংকর্ষণাত্মক রুদ্র গুজরাটবাসীদের উপর ভীষণ রেগে গিয়ে রুদ্ররূপী বলভদ্র ভুজ ধংস করে দিয়েছেন। এখানে রুদ্র, যিনি ধংসের প্রতিমূর্তি, তার এই সঙ্কর্ষন সংক্রান্ত কাজের ভার বলভদ্রের উপর ন্যাস্ত, শুধু তাই নয়, বলভদ্রের মৃত্যুর তিনি বেঁচে থাকবেন 'বলভদ্র' ব্র্যান্ড হিসাবে।
কীর্তিযস্য স জীবতি
আজকের দিনে যেমন "ডায়নামিক ম্যানেজমেন্ট" , "অর্গানাইজেশনাল মোটিভেশন" , "আপলিফ্টমেন্ট" , "পারফরম্যান্স " বলে শব্দগুলি আছে , সেযুগেও সমাজে মানুষের প্রমোশন হতো তার পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে। কিভাবে একজন সাধারণ মানুষ তার কর্মের বিকাশের কারণে সমাজকতৃক দেবতা আওয়ার্ডে ভূষিত হতো, তার অজস্ত্র উদাহরণ বেদে আছে।
গতিশীল সামাজিক ব্যবস্থাপনা
সমাজ ব্যক্তিসত্তাকে প্রাধান্য দিতো। একই পদমর্য্যাদায় যদি কোন ব্যক্তি একই জায়গায় দীর্ঘদিন থেকে যায়, তাহলে সমাজ নামে সংগঠনটি এগিয়ে যায় না। ব্যক্তিরাই সমাজকে গতিশীল নদীর মতো এগিয়ে নিয়ে যায়। আর এই গতিই সমাজের মলিনতা ধুয়ে মুছে দেয়।
যেমন , প্রথমে ইন্দ্র নামে একজন মানুষ ছিল. কালক্রমে সে স্বীয় কাজের মাধ্যমে দেবতা হিসাবে পরিগণিত হয়।
কর্মক্ষমতা ও সাংগঠনিক প্রেরণাই ছিল ব্যক্তির মান উন্নয়নের সোপান
যেমন , ইন্দ্র দেবতা হিসাবে তার কর্মক্ষমতাবলে সূর্য নাম্মকিত জোতিস্ক হয়ে যান। শুধু দেবতাদের রাজা হিসাবে' ইন্দ্র' নামটা একটা ব্র্যান্ড হয়ে যায়। তাই সবথেকে প্রাচীন বেদ, ঋগ্বেদে অধিকাংশ মন্ত্রই ইন্দ্রের নামে, তার পরে অগ্নি।
বর্তমানে তারকা কথাটি ভীষণ প্রচলিত শব্দ। এই কথাটির গূঢ় অর্থ নিহিত আছে পুরাণের সাম্মানিক উপাধিতে। কোন এক সময়ে এই পৃথিবীতে তাঁরা জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। স্বীয় কীর্তিতে ভূলোক, দ্যুলোক, গোলক ছাপিয়ে নক্ষত্রলোকে বিরাজমান হয়েছেন। সপ্তর্ষিমন্ডলের নামাঙ্কিত নক্ষত্ররা কোন না কোন সময়ে এই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে নিজেরা অলংকৃত হয়েছেন তারকা বিশেষনে।
ইতিহাস রচনার একটি নির্ভরযোগ্য উপাদান পুরাণ
কালকের পুরাণ আজকের ইতিহাস। যুক্তিপূর্ণ বর্ণনা আর বিজ্ঞানসম্মত গঠন প্রণালীকে বর্তমানে বিদেশী রাষ্ট্ররাও অনুসরণ করে তাদের ইতিহাস রচনা করছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আধুনিক কালে অক্সফোর্ড ইতিহাস ইংল্যান্ডের ইতিবৃত্ত রচনা করার জন্য ভারতীয় পুরাণের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কি নেই ভারতীয় পুরাণে, শুধু মানুষের কাহিনীতে নিজেকে সীমাবদ্ধ না করে, কবে কখন প্লাবন, ভূমিকম্পের মতো ঘটনাকেও যত্ন সহকারে লিপিবদ্ধ করেছে।
বিষয়বস্তুতে রংয়ের ছিটেফোঁটা
পুরাণ কখনই ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস নয়। তিনটি স্তর থেকে উঠে আসা নিখুঁত ঘটনাবলীই পুরাণ। রাজ্যস্তরে মাগধগণের দ্বারা যে ইতিবৃত্ত সংগঠিত হয় তা আবার সত্যান্বেষী সূতগনের দ্বারা পরীক্ষিত এবং প্রয়োজনে সংশোধিত হয়ে ঋষিগণের দ্বারা লিপিবদ্ধ হয়। আজকের মতো পেইড ঐতিহাসিকদের দ্বারা ইতিহাসকে বর্তমানকালে শাসকের মনগড়া ইতিহাসের মতো সেদিন তৈরি হতো না। তবে, সেদিনের ঋষিরা একটি আদর্শ সমাজ গঠনের কথা মনে রেখে পুরাণ সংকলন করেন। হিন্দু ধর্মের অন্যতম মূল আদর্শ ছিল মোক্ষ। এই মোক্ষকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে কিছু অলংকার দ্বারা সুশোভিত করতে হয়েছিল পুরাণকে। কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে, সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও ওনারা জানতেন, যে ধর্মের মৃত্যু হবে না এবং তাকে আঁকড়ে ধরে পুরাণের আদর্শ ও লক্ষ্য বেঁচে থাকবে।
ক্রমশঃ
মন্তব্যসমূহ