রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩

(১৮৯) অন্ধকারের দিনগুলি

 (১৮৯) অন্ধকারের দিনগুলি 

অন্ধকারটা  ঘন অন্ধকারময়

  বর্ষার গভীর রাতে যখন নিশাচর  প্রাণীছাড়া আর সবাই গভীর নিদ্রায় আছন্ন। পরিপূর্ন পুকুরে জলজ প্রাণীরা  বর্ষার  বন্দনায় রাতের নীরবতাকে ভেঙ্গে  তাদের অতি পরিচিত ঘ্যাঙর ঘ্যান শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত করতো।  আর ঠিক  সেই সময়ে ব্রাহ্মণরা বৈদিক মন্ত্র আর তাদের অতিপ্রিয় সোমকে যজ্ঞে  উৎসর্গ করে মহাবিশ্বের কল্যাণ কামনায় স্বর্গীয় সত্তাকে আত্মিকভাবে   সেদিন আহবান জানাতো ।  

কখনও  অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো থেকে  আনন্দের রসদ  আবার তার নিষ্ঠুর স্নেহের মূর্ছনায় কাতর প্রাণ-  এই ছিল সেদিনের নিসর্গের কাছ থেকে মানুষের পাওনা।  কতনা ভালো-মন্দের মিশ্র অনুভূতি - আকাশ, রাতের তারা, চন্দ্র, সুগভীর রাত্রি, সূর্য, ঊষাকাল, ঝড়-বৃষ্টিকে  ইত্যাদিকে নিয়ে  কতনা  শিশুর মতো বিস্ময়,  প্রশ্ন অনেক ছিল কিন্তু সেসবের সব  উত্তর সেদিন মিলতো না।  
 
একটুকরো জমিন আর তাকে ঘিরে বন জঙ্গল ও  জলে ঘেরা গ্রাম, সেখানেই ঋগ্বেদের যুগে মানুষের বাস। পাশের জঙ্গলের পশু আর চারপাশে নিত্য ঘুরে বেড়ানো  সাপ , বিছা ও অন্যান্য দংশক প্রাণীদের  ছিল অবাধ আনাগোনা।  এটাই যথেষ্ট ছিল সেদিনের মানুষের   ভয় ও অন্ধকারময় জীবনের  স্থায়ী কারণ।   

অরণ্যানী সূক্ত -  
ঋগ্বেদের কবির কন্ঠে বেজে উঠেছিল সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষায় অরণ্যকে গুটিকয়েক জিজ্ঞাসা -
"হে অরণ্য ! তুমি দেখতে দেখতে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাও। তুমি যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তা তো পরিমাপের বাইরে। এ যেন তোমার সীমাহীন রোমাঞ্চকর যাত্রা। তুমি কি পথ ভোলা এক পথিক ?  যদি সত্যিই হারিয়ে থাকো তোমার গ্রামের পথ,  তবে পথ মধ্যিই প্রশ্ন করো,  ' আমার  গ্রামটা কোথায় '?  আচ্ছা অরণ্য! সত্যি করে বলোতো  , তোমার একা একা থাকতে ভয় করে কিনা ? "
 " হে অরণ্য ! আবার যেন শুনি, তোমার অন্দরের  প্রাণীকুলের কেউবা বৃষের ন্যায় শব্দের ধন্বী তুলে  কিছু প্রকাশ করতে চাইছে ,  আবার  চী চী শব্দে  অপর আরেক প্রাণী বোধ হয় তার যোগ্য  উত্তর  দিচ্ছে। সেই স্বর যেন মুমূর্মুহ বীণার ঝংকারে তোমার প্রাণের কথাকেই   যেন বর্ণনা করছে।  কল্পনার পর্দায় ভেসে উঠছে তোমার অরণ্যে কতনা গাভী চড়ে বেড়ানোর ছবি। সন্ধ্যা যে ঘনিয়ে এলো,  সারি দিয়ে না জানি কত শকট  বিশাল অট্টালিকার  উন্মুক্ত দ্বার দিয়ে তাদের পরিচিত সুর করে একে একে বেরিয়ে আসছে।   আর সেই সময়ে যেন  দূর থেকে  আওয়াজ ভেসে এলো, তবে কি কেউ সেই গাভীদের ঘরে ফেরার এলান দিচ্ছে ? আবার ভেসে আসছে কারোর   অরণ্য থেকে গাছ থেকে কাঠ কাটার শব্দ ?    
সন্ধ্যাবেলা অরণ্যের অন্তরে আসলে যে কিসের শব্দ বাজছে, সেটি একমাত্র তোমার আবাসিকরাই  জানেন। সর্ব জীবের নির্ভয় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে এই অরণ্য যদি কোন অন্য কোন হিংস্র পশুর পদচিহ্ন না পরে। তোমার অফুরন্ত ফলফলাদির সম্ভার রক্ষা করবে প্রাণীদের তীব্র ক্ষুধা নামক শত্রুর হাত থেকে। "  

"না সৎ ন অসৎ "-
সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টিকে নিয়ে আদি থেকেই  মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা ছিল। এটি যে একটা মৌলিক প্রশ্ন সেটি বৈদিক ঋষিরা  বুঝতে পেরেছিলেন। যেহেতু এটি স্থূল বস্তু নয়, তাই সে ইন্দ্রিয়ের ধরা ছোয়ার বাইরে। ইন্দ্রিয়ের আয়ত্ত্বের বাইরে বলে সে সুক্ষ বস্তু।  আবার সে দেখা না দিলেও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু  তাকে  প্রত্যক্ষ করা যায়না বলে, তাই সে বিচারের বাইরে, আর যাকে বিচার করা যায় না, তাকে কিসের ভিত্তিতে সত্য বস্তু বলে বর্ণনা করা যায় ? আবার অন্যদিকে সে  অব্যক্ত অথচ তার অস্তিত্বের কথাও  অস্বীকার করা যায় না তাই তাকে অসত্যও বলা যায় না। তবে বোঝা যায়  মানুষের বুদ্ধি এবং  উপলদ্ধি  দিয়ে।  
 "সোহহমম্মি" অর্থাৎ আমিই সেই আত্মা - আমি এবং আমার আত্মা এক এবং এই আত্মা সর্বব্যাপী। এই উপলদ্ধিটা ঋগ্বেদের দেবীসূক্তে ঋষিরা ব্যক্ত করেছেন।     

দেবতার প্রয়োজনীয়তা কিংবা প্ৰয়োজনীতার তাগিদে সৃষ্টি  - 
আসলে মানুষের খাদ্যাভাব আর মৃত্যুর ভয়টা প্রথম দিন থেকে জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।   
রহস্যের  আবর্তে মোড়া  প্রকৃতির ইন্দ্রজালে  বার বার ভিরমি খেয়ে ক্লান্ত মানুষ কোথাও একটু বিশ্রামের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল। কে দেবে তাদের  আশা, কেইবা  দেবে  ভরসা, কে দেখাবে পরিত্রানের উপায় ,  তাই এই অনিশ্চিত জীবনের ভার দেবতা নামক  এক কল্পিত শক্তির উপর অর্পণ  করা ছাড়া উপায়ন্তর কিছু ছিলনা। এই অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভরতা মানুষের অন্ধকারময় জীবন থেকে সেই যে  একদিন শুরু  হয়েছিল আজও সেটা একইভাবে প্রবাহিত।   

ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -০১/০১/২৪

rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

২টি মন্তব্য:

Ani বলেছেন...

খুব ভালো লাগলো লেখাটা। একটা অদ্ভুত জগৎ ছিলো তখন তবুও সেই খাদ্য আর বাঁচার চেষ্টার মনোভাব এখনো অটুট।

Sabita বলেছেন...

Khub khub valo laglo

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...