(১৮৭) প্রবচনের গল্প হলেও সত্যি
(১৮৭) প্রবচনের গল্প হলেও সত্যি
ইতিহাস রচনার পক্ষপাতিত্ব।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে যে সব দ্রব্য উদ্ধার করা হয়, তার থেকে যে ঘটনাকে উপস্থাপন করা হয়, তা অনুমান সাপেক্ষ বলে অনেকেই মনে করেন। ধরা যাক, মহেঞ্জাদারোর সভ্যতা আর্য্য না অনার্যদের সভ্যতা তাকে নিয়ে বহু বিতর্কের পর অনার্যদের সভ্যতা বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
কাকে ইতিবৃত্ত বলা যেতে পারে।
ইতিবৃত্তের প্রধান শর্ত হল সত্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে , কাল নির্দেশ থাকতে হবে, অতিরঞ্জন যেন ঘটনাবলীকে প্রভাবিত না করতে পারে, ঘটনার বিবরণে কোথাও কালের ক্রমবর্ধমান নিয়মের ছেদ পড়বেনা। রাজাদের রাজনৈতিক জীবন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রজাদের আর্থিক মানচিত্র, জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনযাপনের বিবরণ পাওয়া যায় , তাকেই ইতিহাস বা ইতিবৃত্ত বলা যেতে পারে।
রামায়ন ও মহাভারত অতিরঞ্জনের দোষে দুষ্ট এবং কাল নির্দেশের নিয়মটি য্থায্থ ভাবে পালিত না হওয়াতে তার ইতিহাসের তকমা থেকে বঞ্চিত হয়ে মহাকাব্য হিসাবেই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইতিবৃত্ত নির্নয়ের মাপকাঠি
ইতিবৃত্তের বিবরণের সত্যতা নির্নয়ের জন্য অন্যতম পথ হচ্ছে অভ্যন্তরীন বিবরণের সাথে বাহ্যিক বিবরণের প্রমানের মাধ্যমে তার ঘটনাবলীর সত্যতা নিরুপন করা। যেমন, দেশীয় ইতিহাসের সাথে বৈদেশিক পরিব্রাজকদের বর্ণনা।
ব্যতিক্রম -
রামায়ন ও মহাভারত।
প্রথমেই বলা যেতে পারে মহাভারত পুরানের উপর নির্ভর করে রচিত হয় নি। কিন্তু পুরাণের কিছু কিছু ঘটনা মহাভারতে আছে। সাহিত্যের ভিতটা যেমন তৎকালীন সমাজ থেকে রূপ, রস ও গন্ধের সমারোহে গড়ে ওঠে, এখানেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। সাহিত্য যদি সমাজের দর্পন হয়ে থাকে, তাহলে সমাজে চর্চিত অলৌকিকতা, কিংবদন্তি ও পৌরাণিক ঘটনার ঘনঘটা থাকবেই। আবার মহাভারতও একটা অকাট্য দলিল হয়ে ওঠে পুরাণের ঘটাবলির সত্যতার সাক্ষী হিসাবে।
বিদেশী ঐতিহাসিকদের সংকীৰ্ণপনা।
সুযোগ পেলেই অহংকারী বিদেশীরা ভারতের প্রাচীন সভ্যতাকে অস্বীকার করে পাচ্যত্যের সভ্যতাকে বড় করে দেখাবার বাসনা ত্যাগ করতে পারতো না। " দি আর্লি হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া" বইটিতে ভিন্সেন্ট স্মিথ ৬৭ পাতা ব্যয় করেছিলেন শুধু মাত্র আলেক্সজান্ডারের বিজয় কাহিনী লিখে। সেখানে ভীষণ মিতব্যয়ী ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত ও বিন্দুসারের জন্য ৪১টি পাতা আর সম্রাট অশোকের জন্য মাত্র ৪৪ পাতা বরাদ্দ করেন।
অবশ্য সত্য কখনই মিথ্যার পিছু ছাড়েনি। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকেরা প্রমান করেছেন, আলেক্সজান্ডার কেবলমাত্র এক প্রান্তিক সামন্তরাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য ভারতীয় রাজাদের সামরিককুশলতার খবর পেয়ে, সময় ব্যয় না করে তড়িঘড়ি ভারতবর্ষ ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গ -পুরাণ ও হিন্দু দর্শনপুরাণের সাথে হিন্দু দর্শনের নিবিড় যোগ। দর্শনের আরেকটা বড় কাজ হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়কে যুক্তির দ্বারা সহজ করে সাধারনের বোধগম্য করে তোলা। দর্শনের বিধিবদ্ধ আচরণকে অস্বীকার করে যেমন দর্শন লেখা যায় না, ঠিক তেমনি পুরাণ লেখারও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ আছে, সেই আদর্শ অনুসরণ করে পুরাণ লেখা হয়েছে।
দর্শনের বিষয়বস্তু হলো জগৎ ও জীবনের রহস্য উদ্ঘাটন। যেহেতু, এটি হিন্দু দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, সেখানে স্বভাবতই এসে যায়, হিন্দুদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে। এই দর্শনের প্রধান তিনটি জিনিস নিয়ে আলোচনা করে - জীব, জগৎ এবং ঈশ্বর বা হিন্দুদের পরিভাষায় ব্রহ্ম। এই দর্শনের উদ্দেশ্য অনুসরণ করলে প্রথমে যেটা আসে, সেটা হলো সৃষ্টি তত্ত্ব, তারপরে স্থিতি এবং পরিশেষে তার লয় । এই জাগতিক ঘটনার পিছনে একটা শক্তি কাজ করছে এবং সেই শক্তিকে ব্রহ্ম শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করছে হিন্দুদের দর্শন। শক্তি তখনিই কেন্দ্রীভূত হয়, যখন সৃষ্টির লয় হয়। স্থূল বস্তু যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা দেখা কিংবা অনুভব করা যায়, সবকিছুর বিনাশ হয়ে যাওয়াতে শুধু মাত্র সুক্ষ ভাবে সে চিন্তা বা ভাব হিসাবে বেঁচে থাকে। এই বিশ্বে শুধুমাত্র দুটি জিনিস আছে - একটি জড় বা প্রকৃতি আর অন্যটি চৈতন্য বা ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। এই লয়ের সাথে শুধুমাত্র জড় জগৎটি অংশগ্রহণ করে।
জড় যে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়- সেটা স্বামী বিবেকানন্দ আইনস্টাইনের বহু আগে বলেছিলেন। তারপরে এসেছিল E = MC^2 আইনস্টাইনের বিখ্যাত তত্ত্ব। এখানে E অর্থাৎ Energy বা শক্তি , M অর্থাৎ MASS বা ভর কিংবা ওজন বা বাটখারা (পদার্থ বিজ্ঞানের একটা মৌলিক ধারণা ) নিয়ম অনুযায়ী ওজনের কোন পরিবর্তন হয় না, কেননা সেটি প্রকৃতির মাধ্যকর্ষনের ফল। C হচ্ছে গতিবেগ।
শক্তি যখন অনেকবেশী জমাট বেঁধে যায়, তখন সেই শক্তি প্রকাশিত হয় শব্দে , শব্দ রূপান্তরিত হয় চিন্তা-ভাবনায়। ধরা যাক, একটা ইলেকট্রিক ট্রেন দূর থেকে আসছে কিন্তু সে সামনের স্টেশনে থামবে না তাই সেই স্টেশনের কাছাকাছি আসার সময় থেকে প্রচন্ড জোরে হুইসেলের শব্দ ( এখানে গতির শক্তি শব্দের জন্ম দিল ) বাজতে বাজতে স্টেশনটাকে অতিক্রম করতে লাগলো, যত কাছে আসলো শব্দ তত জোরে বাজতে লাগলো আবার ধীরে ধীরে যখন দূরে সরতে লাগলো শব্দের তীব্রতা ততই কমতে লাগলো। এটা শুধুমাত্র শব্দের ক্ষেত্রে নয়, আলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তার পর শব্দ মরে গিয়ে বেঁচে রইলো তার চিন্তার রেশ।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে -
আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘ জমতে জমতে শক্তি সঞ্চয় করে বজ্র হয়ে গর্জন করে আলোরবর্তীকা ছাড়িয়ে বৃষ্টি হয়ে মৌন হয়ে যায়। উপর দিকে ওঠা জলের সুক্ষ কণা একটা পর্যায়ের পর যখন ৫ মি.মি.এর উপরে চলে যায় তখন জলের কণাগুলি একে অপরকে ধরে রাখতে পারেনা অর্থাৎ মেঘ তখন লয়ের অভিমুখে রওনা হলো এবং লয়ের প্রারম্ভে শক্তি সঞ্চয় করে তীব্র গতিতে আলোর ঝলকানি দিয়ে প্রচন্ড শব্দ করে ভূমিতে আছড়ে পড়লো, মেঘ পরিণত হল বৃষ্টিতে আর আকাশ পরিষ্কার হবার পর প্রকৃতির সেই ধ্বংসলীলা শুধুমাত্র ধারণায় থেকে গেল।
ভারতীয় দর্শন বলে প্রথমে চৈতন্য, সেখান থেকে ভাব বা চিন্তা। এই চিন্তা থেকে উদয় হচ্ছে শব্দ ; এই শব্দ থেকে শক্তি আর শক্তির প্রকাশ বিষয়ে।
হিন্দু দর্শন
বিদ্যুৎ সংযোজনের দ্বারা কোন স্ক্যানার দেহের অভ্যন্তরের খুঁটিনাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য খবর পাঠায়, সেখানে স্ক্যানারটি কি বিদ্যুৎ ছাড়া কাজ করতে পারতো ? নিশ্চয় পারতো না। এই বিদ্যুৎকে যদি চৈতন্য হিসাবে গণ্য করা হয়, তাহলে আর বাদবাকি সবই জড় বস্তু হিসাবে মান্য করতেই হবে।
চৈতন্যকে যদি ক্যানভাস হিসাবে ভাবা হয় তবে তাকে আশ্রয় করে জড় তার উপর ভেসে বেড়াচ্ছে। চৈতন্যকে আশ্রয় করেই জড় প্রকাশিত হয়। সুতরাং জড়াশ্রিত চৈতন্যই জড়কে দ্যোতনশীল বা অমানবী বস্তুতে পরিণত করেছে। এই বিশ্বের সব বস্তুর উপর চৈতন্য কাজ করে তা প্রমাণিত। ঔষধ খেয়ে জ্বর সারলে মন আনন্দে ভরে যায় অর্থাৎ চৈতন্য জড় মনকেও প্রভাবিত করে, তাহলে এই ঔষধেও জড়াশ্রিত চৈতন্যশক্তি আছে। চৈতন্য যদি ব্রহ্ম বা ঈশ্বর হয়ে থাকেন আর তিনি যদি জড়তে বাস করেন, তাহলে জড় ও ঈশ্বর।
তাই হিন্দুরা বিশেষ বিশেষ জড় বস্তুর এবং প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা হিসাবে কল্পনা করে বিভিন্ন নামদ্বারা তাদের ভূষিত করেছেন। মানুষ হলেন নিয়োগ কর্তা আর সৃষ্টির দেবতা নাম দিয়ে যাকে নিয়োজিত করলেন, তার নাম ব্রহ্মা। সৃষ্টি করলেই তো হল না, সেই সৃষ্টিকে রক্ষণ করতে হবে তাই বিষ্ণুকে ভগবান হিসাবে এই বিভাগটা দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হল। সবই তো হল, নিয়ম অনুযায়ী পরিণতিই হচ্ছে একমাত্র সৃষ্টির পূর্নতা, তাই ধংসের দায়িত্বভার অর্পণ করা হলে রুদ্রকে। এই হল সৃষ্টি, স্থিতি আর প্রলয়ের প্রকারভেদ।
ক্রমশঃ
মন্তব্যসমূহ