বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৪

(১৯৪) হেঁয়ালির আড়ালে পুরাণের কথকতা

(১৯৪) হেঁয়ালির আড়ালে পুরাণের কথকতা 

শূন্যের মহাভোজ কিংবা শব্দার্থের বহুগামিতা  -

হু বিবাহ যেখানে স্বীকৃত সেখানে শত শত পুত্রের পিতা হিসাবে  গৌরবে গৌরবান্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা কিংবা অবিশ্বাস্য কিছু ছিল না পৌরাণিক যুগে ।

         পুরাণের বহু চর্চিত কাহিনী ভাগীরথের গঙ্গাকে আমন্ত্রণ করে মর্তে নিয়ে আসা। এই ঘটনাটি  একটা বিবৃবিতেই  শেষ করে দেওয়া যেত।   তাতে করে পুরাণের লক্ষ্য  পূরণ হতো না। কোন ঘটনাবলীকে অলংকার সহযোগে আকর্ষণীয় করে  তাকে দীর্ঘ জীবনদান। সেইসঙ্গে মানুষের শিক্ষার ধারাকে অব্যাহত রাখা, এটাই পুরাণের মূল আদর্শ।  তাইতো   সাধারণ মানুষ ৫০০০ বছর পরেও ভুলতে পারে নি কপিল  মুনির আশ্রমকে , গঙ্গাসাগর আর ভাগীরথের গঙ্গা আনয়নকে ।  
 
        স্থুল কাঠামোর আড়ালে যেমন সুক্ষ ভাবনা আত্মগোপন করে থাকে, ঠিক তেমনি বহু অতিরঞ্জনের বেড়া অতিক্রম করে পুরাণের প্রকৃত চেহারাটা উন্মোচিত হয়।  ঘটনার  পরম্পরা যে কোন রচনার মূল বুনিয়াদ। বহু উপাধির আতিশয্যের কারণগুলি ব্যাখ্যা করলে বোঝা যাবে কেন এই উপাধির প্রয়োজনীয় ছিল। 

        ভারতীয় পুরাণের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন হচ্ছে বিষ্ণু এবং বায়ু পুরাণ। বিষ্ণু পুরাণে বর্ণিত আছে ইক্ষাকু বংশের রাজা  সগর, যিনি ছিলেন  শ্রী রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। কপিলমুনির অভিশাপে তার পুত্রদের মৃত্যুর কাহিনীটাই উপজীব্য বিষয়।  স্বর্গরাজ ইন্দ্র ছিলেন যজ্ঞ ভাঙতে ওস্তাদ। তার বহু নিদর্শন পুরাণে আছে।  তার পিছনে ছিল একছত্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার বাসনা।

         সেই যুগে রাজাদের ক্ষমতার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হতো একটা  সফল অশ্বমেধ  যজ্ঞ সম্পন্ন করার উপর।  ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হলো সগর রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়ার যাত্রা। পিছন পিছন চলল রাজার ৬০ হাজার সন্তান অসমঞ্জসের নেতৃত্বে। সমতল থেকে ধীরে ধীরে পার্বত্য অঞ্চলে  ছুটতে লাগলো ঘোড়া , ঠিক এই সময়ে পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইন্দ্রের চরেরা ঘোড়াটাকে হাইজ্যাক করে। পাতালে তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ঋষি কপিলের আশ্রমে একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখে ইন্দ্রবাহিনী অপসৃত হয়ে যান। 

        অন্যদিকে সগর রাজার পুত্ররা পাহাড়ের বাঁকে ঘুরে গিয়ে  ঘোড়াকে না পেয়ে, চারিদিকে বেষ্টন করে খুঁজতে লাগলেন। খোঁজার শেষপর্বে তারা দেখেন, এক ঋষি  ধ্যানে মগ্ন আর  তারপাশে অশ্বমেধের ঘোড়াটি বাধা আছে। এত মানুষের কোলাহলে   কপিল মুনির ধ্যান গেলো ভেঙ্গে।  তাঁর অসময়ের ধ্যান ভঙ্গ করায় যে ক্রোধের উন্মেষ হলো, সেটি প্রকাশিত হলো  তার দুই চোখ থেকে। সেই ক্রোধের অগ্নিতে ছাই হয়ে  গেল ৬০ হাজার সন্তান। 

        পার হয়ে গেলো কয়েক প্রজন্ম, অবশেষে ভগীরথ নামে এক বংশধর, তার পূর্বপুরুষদের বিদেহী আত্মাকে মুক্ত করার জন্য শুরু করেন গঙ্গার তপস্যা। সেই তপস্যায় সাড়া দিয়ে স্বর্গ থেকে গঙ্গা পাতালে অবতরণ করে সগর পুত্রদের শ্রাদ্ধ শান্তি সম্পন্ন করতে সহায়তা করলেন এবং  তার বহমান স্রোতের সাথে  সেই চিতাভস্মকে ভাসিয়ে নিয়ে যান। 

        পুরাণ  গল্পের আকারে  তার আদর্শকে রক্ষা করেছে । হিন্দুদের লক্ষ্য হচ্ছে মোক্ষ লাভ। কতখানি তাদের দূরদর্শিতা ছিল এবং সেই কল্পে তাকে বাস্তবায়িত করার জ্বলন্ত উদাহরণ মোক্ষের লক্ষে আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ গঙ্গাসাগরে পুণ্যের জন্য আসেন।  

         যখন মানুষ প্রকৃতিকে মন্থন করতে গিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই  প্রকৃতি তার মতো করে প্রত্যুত্তর দিয়ে এসেছে।  সেটা হতে পারে একান্ত আধুনিক কালে পানামা খাল খনন  কিংবা সগর রাজার গঙ্গা খনন। তিনি  তার সন্তানসম ৬০০০০ কর্মচারীকে নিয়োগ করেছিলেন এই খনন কার্যে যারা পুরাণে তাঁর পুত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।  অশ্বখুর দ্বারা চিহ্নিত পথ অনুসরণ করে তারা প্রায় সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় বাধসাধলো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।  কপিল অর্থাৎ  পিঙ্গল বর্ণ, যার প্রভাবে লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চোখ এবং শরীর উভয়েই হলুদ বর্ণ ধারণ করে, এটাই কপিল মুনির অভিশাপ বলে বর্ণিত।এই ম্যালেরিয়া নামক জ্বরের প্রভাবে তারা মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে।  
      
        কালের নিয়মে সগর রাজা, ভগীরথ ও অন্যান্যরা ইতিহাসের গহ্বরে বিলীন হয়ে গেছে কিন্তু পুরাণের সেই উদ্দেশ্যমূলক মোক্ষ যাত্রা সময়ের বাধা পেরিয়ে আজও অমলিন।  মোক্ষ কতখানি হবে জানিনা কিন্তু তার অন্বেষণ জারি থাকবে।  এই সন্ধান দীর্ঘ জীবন পাবে আগামী প্রলয় পর্যন্ত পূর্ণার্থীদের  কপিল মুনির আশ্রম দর্শন  আর গঙ্গা সাগর যাত্রার মধ্যে। 

ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -১২/০১/২৪

rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...