(১৯৬ ) গোপীদের সান্নিধ্যে শ্রীকৃষ্ণের কিছুক্ষন -(পি ১)
শ্রীকৃষ্ণের জাগতিক ও মহাজাগতিক অবস্থান কখনো দেবরূপে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ,আবার কখনো মানবরূপে বৃন্দাবনে প্রেমলীলার সার্থক রূপকার , কখন তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গীতার স্রষ্টা হিসাবে ধর্মের গূঢ়ভাবের বিশ্লেষক, কখনো সৃষ্টি, স্থিতি এবং ধংসের প্রতীক হিসাবে আবির্ভাব।
গোবর্ধন পর্বতকে ঢাল করে জলপ্লাবনকে রোধ-
শ্র্রীকৃষ্ণকে যদি অবতার হিসাবে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে কোন গল্পের অবতারণা তো করতেই হবে। দৈনিন্দন জীবনের কোন কোন ঘটনাবলীকে তুলে ধরতে এবং পুরাণের আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে নায়ককে অতিরঞ্জনের আতিশয্যে সাধারণ মানুষের থেকে বেশী উচ্চতায় তাদের পৌঁছে দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
কাহিনীর বিন্যাস হয়েছিল আর্য্যদের রাজা প্রকান্তরে পূজনীয় দেবতা ইন্দ্রের বহুদিনের ভক্ত গোপজাতি হঠৎ করে তাদের পূজার আসনে ইন্দ্রের স্থলে গিরীপূজা ও গোপূজার প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে ইন্দ্রের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিল এবং পরবর্তী সময়ে ইন্দ্র তার প্রতিশোধ নিতে অকাল বৃষ্টি দিয়ে তাদের জনজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। এই দেবতার পরিবর্তনের আসল কারিগর ছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সুতরাং পরোক্ষভাবে তাদের রক্ষা করার নৈতিক দায়িত্ব এসে বর্তালো কৃষ্ণের উপর। ইত্যাবসরে জলপ্লাবনে বহু গরুর মৃত্যু ঘটে। তখন কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে ভূমি থেকে তুলে নিয়ে এসে এক হাতের উপর রেখে তার নিচে সমস্ত গোপ এবং তাদের পালিত প্রাণীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে ইন্দ্রের হিংসাত্বক কার্যকলাপ থেকে গোপদের রক্ষা করেন।
জনসমক্ষে একাঙ্ক নাটকের পরিসমাপ্তির পর গ্রিনরুমে এসে প্রকৃত ঘটনা যখন এঁকে শরীরের উপর রূপকের আড়ালে থাকা বাড়তি পোশাকের ভারগুলি লাঘব করে দিলো, তখন সে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করলো। একে একে জাগ্রত হলো বিচার বুদ্ধি। বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা গেলো, অপরিমিত বৃষ্টির জল এবং তার সাথে উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা না থাকার কারনে আবদ্ধ জলের প্লাবনই গোমৃত্যুর কারণ। কৃষ্ণ তার বুদ্ধি বলে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং প্রয়োজনে বাঁধও দিয়েছিলেন এবং সমর্থ হয়েছিলেন এই প্লাবন রুখতে।
পুতনা বধ - প্রাচীনকালে বেশ কিছু রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। সেখানে শ্রী কৃষ্ণ এবং পুতনা সেই একই ধনুষ্টঙ্কার রোগে আক্রান্ত হলেও ব্যতিক্রমী হিসাবে শ্রীকৃষ্ণ বেঁচে যান এবং পুতনার মৃত্যু হয়, সেটাই রূপক হিসাবে পুতনা বধ বলে পুরাণে বর্ণিত আছে।
রাসলীলা - জীবনের সাথে জীবিকার এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবিকাই জীবনের গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করে। সময়ের সাথে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে কিন্তু জীবন এখনো জীবিকার প্রাধান্যকে সেই পূর্বের মতোই গুরুত্ব দিয়ে এসেছে বা বাধ্য হয়েছে। যাঁরা আজও স্থায়ী ডেরা বাঁধতে পারেন নি এবং জীবিকার প্রয়োজনে বারংবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে তারই যাযাবর। সামাজিক রীতিনীতির বেড়াজালের যৌক্তিকতা তখনিই আসে যখন মানুষের জীবনটা স্থিতু হয়। স্বভাবতই যাযাবরেরা এইসবের উর্ধে, সেটাই বাস্তব। তাই এই জাতির মধ্যে লিঙ্গের কোনো ভেদাভেদ ছিল না, সবাই জীবন যুদ্ধের সৈনিক। তাদের একঘেয়েমি জীবনে নাচগান আর স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ছিল আনন্দের অন্যতম আকর্ষণ আর সেই অনুঠানে স্ত্রী-পুরুষ একই সঙ্গে অংশগ্রহণ করে থাকতো। একেই রাস বলে সম্বোধিত করা হয়।
কংস মামার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে কৃষ্ণ দীর্ঘ দিন ধরে পিতৃভূমি থেকে পরাভূমিতে পালিত। গোপদের মাঝে তার বেড়ে উঠা। তার বাল্যকাল কেটেছে গোপ-গোপীদের সংস্কৃতির সান্নিধ্যে। সুতরাং, তার মধ্যে যাযাবর জাতির প্রভাব তো থাকবেই। সতীত্বের উচ্চ আদর্শের পরাকাষ্ঠা সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবেনা আর একাধিক নারীসঙ্গ মোটেই দোষণীয় বলে গণ্য হতোনা তৎকালীন সমাজে। সেই সময়কার সামাজিক আদর্শ অনুযায়ী কৃষ্ণের রাসলীলা ছিল একটা স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়া ব্যাতিত কিছু নয়।
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদের লোক।
দর্শনে অনবদ্য, বুদ্ধিতে ক্ষুরধার , তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অসাধারন, পরোপকারী, সকলের মুশকিলআসান, যুক্তিবাদী এবং মনমোহিনী বক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত শ্রীকৃষ্ণর গ্রহণ যোগ্যতা যে কোন সমাজেই অবিসংবাদী নেতার আসনটি তার জন্য যে বরাদ্দ থাকবে, এ আর নতুন কি। ঘটনাক্রমে, অতি সাধারনের ভিড়ে এই ধরনের চরিত্র খুবই কমই পাওয়া যায়। যখন একবার পেয়ে যায়, তখন কাহিনীকারদের সাহিত্যকৃতির আলমারিতে তুলে রাখা বাছা বাছা তূণ নিক্ষেপে পাঠককে জর্জরিত করে তোলে। অতিরঞ্জনের চূড়ায় উঠে ১৬০০০ গোপিনীদের রক্ষাকর্তাকে প্রশংসায় বহুবচনে তাদের স্থূল অর্থে রক্ষিতা শব্দে ভূষিত করলেন। অবশ্য এর মধ্যে যত্ন করে পাঠক সমাজের বহু কাঙ্খিত আদিরস বেশ আচ্ছা করে ভরে দিলেন।
যৌন মন্দির
নারীরা চিরকালই কামার্ত পুরুষদের সফ্ট টার্গেট। তারা দেখা দিতেন কখন আক্রমণকারীর বেশে, কখনো বা ক্ষমতার অলিন্দে থাকা সুযোগ সন্ধানীদের বেশে। আসলে তম গুণের একচেটিয়া আধিপত্যে মানুষ যে কামে কাতর হবে এবং তার পরিচালিত পথে সমাজে নিরন্তর অপরাধ সংগঠিত হবে - এই পরিণতির কথা সেদিনের শাসকরা জানতো। তাই প্রাচীন কালে রাজা অর্থাৎ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গণিকাদের সমাজের মধ্যেই স্থান দেওয়া হতো। তীক্ষ্ণ নজর থাকতো যাতে তারা উৎপীড়নের স্বীকার না হয়।
সংসারে থাকা মাত্রাধিক্য যৌন পিপাসায় কামার্ত পুরুষের যৌন কামনাকে চরিতার্থ করার প্রয়োজনে তৈরি হোল যৌন মন্দির বা গণিকা গৃহ যেখানে যজ্ঞের বেদীতে নারীর আহুতিতে তৃপ্ত হতো কামদেবের জাগ্রত উগ্র অতৃপ্ত বাসনা। পুনঃ পুনঃ কামের আগ্নেয়গিরির ফুলিঙ্গ যেন সেই মন্দিরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -১৬/০১/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন