(১৯৯) প্রেমাঙ্গনে শ্রীকৃষ্ণ [পি ৪]
সময় কখন যে জীবনের কীর্তিকে মানদন্ডে ওজন করে মনুষ্য থেকে ঈশ্বরে উন্নীত করে দেয়, সেটা আগেভাগে বলা যায় না । সেই বর্ণময় পুরুষটি, যিনি মনুষ্য জীবনকে স্বীয় মর্যাদায় অতিক্রম করে, নিজেকে ভগবান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার রূপ,রস, গন্ধ ও কর্মময় জীবনের প্রতি সাধারণ মানুষের যে কৌতূহল থাকবে, সেটাতো ভীষণ স্বাভাবিক। ব্যতিক্রমীরা চিরকালই চর্চিত। তাঁকে অবলম্বন করে কত মানুষ যে কবি হয়ে গেছেন, তার কোন ইয়ত্তা নেই। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই সত্ত্বাকে অনুভব করতে গেলে, সেই সব প্রণম্য রচয়িতাদের রচনার গভীরে যাবার চেষ্টা করে সবকিছুর মধ্যেকার মৌলিকত্বকে অনুসন্ধান করার প্রয়োজনীয়তা আছে।
যেহেতু চরিত্রটি শ্রীকৃষ্ণ, তাই স্বভাবতই গীতা, মহাভারত, বেদ ও বেদান্ত ইত্যাদির প্রসঙ্গ থাকবেই। বিচার ও বিশ্লেষেণ করে গ্রহণ করা, ভারতীয় দর্শনের ধর্ম। অনেকে যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে গীতার উদ্ধৃতি একান্তই বেদান্তেরই কথা। গীতার সাথে শ্রীকৃষ্ণের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। শ্রীকৃষ্ণই গীতার উপদেশকে সমগ্র পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়েছেন। সেই অমূল্য শব্দগুলির রচয়িতা কে, সেই প্রশ্ন অবশ্যিই মানুষের মনে উদয় হতেই পারে। বহু উদাহরনের মাধ্যমে এটাই উলেখ্য যে, মহাভারত ও গীতার ভাষ্যকার কোন কোন ক্ষেত্রে একই, যেটি বহু শ্লোকের শব্দ সদৃশ এবং অর্থ সদৃশ ব্যাখ্যার মাধ্যমে শ্লোকগুলি উদ্ধৃত করে তার বাস্তবতাকে প্রমান করেছেন।
গীতার বাহ্যিক রূপকে তারা বিচার করেছেন - গীতার সাথে মহাভারতের, গীতার সাথে উপনিষদের, গীতার সাথে ব্রহ্মসূত্রের, গীতার সাথে ভাগবত ধর্মের, গীতার সাথে বৌদ্ধ গ্রন্থের, গীতার সাথে বাইবেলের আবার বর্তমান গীতার জ্ঞানের সাথে। বর্তমানে গীতার শ্লোকের সংখ্যা ৭০০ এবং অধ্যায় ১৮টা। আবার ভাগবত গীতায় ৭৪৫ শ্লোক, অধ্যায় ১৮টা। যেখানে, শ্লোকগুলি ভাগ করা আছে - ধৃতরাষ্ট্র -১ , সঞ্জয়ের - ৪০, অর্জ্জুনের - ৮৪ এবং শ্রীকৃষ্ণের - ৫৭৫ মোট ৭০০। যাঁর ইতিবৃত্ত যতটা দীর্ঘ, তার সম্পর্কিত আলোচনা ঠিক ততটাই প্রশস্থ। তাইতো প্রায় ৫০০০ বছরের পুরানো ঘটনাবলী আজও প্রাসঙ্গিক।
নামে কি ই বা আসে যায়, কর্মই তো আসল পরিচয়। যিনি ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায় সেই ভ্রমরকে ভাষান্তরে মধুসুদন ছাড়া আর কি নামে ডাকা যেতে পারে, যাঁকে এক নামে তার কৃত কর্মের সাথে সম্পর্কিত করা যায়। তাই শ্রীকৃষ্ণকে বিবিধ সম্মোধনের সংগ্রহের ভাণ্ডারে মধুসূদন নামটা নতুন করে সংযোজিত হলো। যত রকমের ঘ্রানে মানুষকে আস্বাদিত হতে পারে, সেই প্রেক্ষাপটে কৃষ্ণের বৈচিত্রপূর্ণ জীবনকে কবি জয়দেব তার গীতগোবিন্দে চিত্রায়িত করেছেন।
একটা খেলোয়াড় কতখানি কৃতকার্য সেটা নির্ভর করে খেলতে নেমে সে কতগুলি গোল করেছিল তার উপর। ইতিহাস সেটাই মনে রাখবে। পাশাপাশি সে খেলতে গিয়ে কতো ফাউল করেছে তার হিসাব কোনদিন রাখবে না।
কৃষ্ণকে সমর্পিত করে রাধার প্রেমের প্রস্ফুটিত করুণ কোমলতাকে অনুভব করে কবি জয়দেব বোধহয় কাতর হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনি তার কাব্যের তৃতীয় সর্গে শ্রীকৃষ্ণকে ভগবানের আসন থেকে নামিয়ে নিয়ে এসে মানুষ বানিয়ে ভক্তরুপী রাধাকে সাধিকার পরিবর্তে প্রেমিকা বানিয়ে ছেড়েছেন। চতুর্থ সর্গে রাধাসখী যখন তাঁর বান্ধবীর বিরহদশার কথা কৃষ্ণের কাছে পরিবেশন করলেন তখন মধুসূদন স্নিগ্দ্ধ হলেন তার প্রেমে। পঞ্চম সর্গে শ্রীরাধা যখন কৃষ্ণ অভিসারের জন্য যাত্রা শুরু করেন, তখন আয়ত আঁখি মেলে দিয়ে সুদূর পথের দিকে কৃষ্ণ তার দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, সেই আঁখিকে কবি বলছেন পদ্মলোচন।
কবির আঙ্গুলি লেহনে কাব্যের সর্গ এগিয়ে চলে পূর্বের ভাবনার সূত্র ধরে। ষষ্ঠ সর্গে রাধাসখী ইনিয়েবিনিয়ে তার বান্ধবীর প্রেমে একাগ্রতার কথা ব্যক্ত করে কৃষ্ণের কাছে। যে প্রেম অন্ধ হয়ে সম্মুখপানে চলতে চলতে ভগবান আর ভক্তের মধ্যকার ব্যবধান ভুলে কখন যেন নিজেকেই ভগবানের অংশ হিসাবে ভাবতে শুরু করে। তদানীন্তন সাহিত্যে বেদ ও বেদান্তের অসম্ভব প্রভাব ছিল। অবচেতন মনে অথবা জ্ঞাতসারে অদ্বৈত ভাবনার প্রভাব থেকে কবি নিজেকে আলাদা ভাবতে পারেন নি। তাই তিনি জীবাত্মা ও পরমাত্মা যে স্বরূপগতভাবে এক; সেই ধৃষ্টতা তিনি দেখিয়েছেন। তাই এই সর্গের নাম দিয়েছেন 'ধৃষ্টবৈকুন্ঠ '। বৈকুন্ঠ শব্দের অর্থ কুন্ঠা যার নেই। ভগবানের অপর একটি নাম তাই বৈকুন্ঠ।
জলে যেমন ঢেউয়ের উৎপত্তি হয় আবার সেই জলেই সে বিলীন হয়ে যায়। রাধার জীবনে ঠিক তেমনি প্রেমের ঢেউ উথালি পাথালি হয়ে ওঠে কিন্তু সেই ঢেউ স্থিতিকে স্পর্শ করতে না পারায়, নিদারুন শোকে সেই ব্যার্থতায় নিজেকে বলিদানের আকাঙ্খায় ব্যাগ্র হয়ে উঠে। যিনি এই জগতের আশ্রয়, সমস্ত জীব তারই মুখাপেক্ষী, তাই তিনি নারায়ণ। একই অঙ্গে বহুরূপ - একাধারে সমগ্র জীবজগতের অন্তঃপুরবাসী তাই তিনি নারায়ণ, অন্যদিকে বহু রমণীর হার্টথ্রোব, তাই তিনি সেই অর্থে নাগর। এই সপ্তম সর্গের তাই নামকরণ করেছেন 'নাগরনারায়ণ '। শ্রীমতি রাধা সেখানে ভগবানরূপী নারায়ণকে না খুঁজে এই নাগর রুপী শ্রীকৃষ্ণের জন্য উতালা হয়ে ওঠেন। বাসনাই যে বেদনার কাঙ্খিত গন্তব্যস্থল, সেটা কবি জানাতে ভুলেননি।
প্রেমের চড়াই- উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে রাধা জিতেই নিলো কৃষ্ণের হৃদয়। একাগ্রতার ক্ষমতার ব্যবহারিক প্রয়োগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাধার একনিষ্ঠ কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ এবং অবশেষে কৃষ্ণের উপর্যুপরি সাড়াতে সার্থকতা অর্জন করলো। রাধার মানভঞ্জনের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠলো কৃষ্ণের রাধার প্রেমের মুদ্ধতা। রসবোধের নিত্তিতে কৃষ্ণের নামের সাথে নারায়ণের একটা সুক্ষ ভেদটা এখানেই আছে , ঈশ্বর ভাবনায় কোন অমিল নেই /
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -২৭/০১/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন