(১৯৩) দেবতাদের ডেরার খোঁজে
চেতনার জন্ম জ্ঞানে, জ্ঞানের জন্ম শিক্ষায় আর শিক্ষার জন্ম কৌতূহলে। কতখানি চৈতন্যের আলো প্রতিবিম্বিত হলো বুদ্ধির উপর, তার উপর নির্ভর করছে বুদ্ধির উর্বরতা এবং তার উপর ভিত্তি করে বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতা গড়ে উঠে। মানুষের আদি ও অকৃত্তিম সম্পদই হচ্ছে চৈতন্য বা চেতনা।
তাই আজ মননে কৌতূহলকে সঙ্গে নিয়ে সময়ের যানে চেপে চললাম গন্তব্যস্থল ইলাবৃতবর্ষ , যেখানে একদিন হিন্দুদের দেবতারা বাস করতো এবং তার বহুল পরিচিত নাম হলো স্বর্গ। আর এখানে আমরা আজ উপস্থিত হয়েছি অনেক প্রশ্ন নিয়ে এবং অবশ্যিই পুরাণের হাত ধরে।
ভারতীয়দের হৃদয়ে ঈশ্বর, দেবতা এবং স্বর্গ নামক শব্দগুলি এক কৌতূহলদীপ্তক অনুভূতি নিয়ে আত্মগোপন করে থাকে। আধুনিক মেশিনারী দিয়ে ৬০০০ বছরের পুরানো ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ করা হয়, তবে অনেক কিছুকেই অতিরঞ্জিত কিংবা অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে। কিন্তু তার পশ্চাদপদটি অনুসন্ধান করলে সেই বিবরণগুলিকে যথার্থ এবং সময়োপযোগী মনে হতেই হবে।
মনুষ্য জগতে সেই-ই অধিক মর্যাদা পায় যাঁরা সাধারনের থেকে বেশ খানিকটা উচ্চতায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে সমাজ তাকে উপাধি দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করে থাকেন। সবাই ভুলে যায় যে তারাও একদিন এই সমতলে ছিল। আজকে এই সত্যের অনুসন্ধানে পুরাণ বর্ণিত ইলাবৃতবর্ষ খুঁজতে এশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে পৌঁছে গেছি।
দেবতারা আমাদের ধারণায় অতিমানব, আমাদের জীবনধারণের সাথে তাদের ব্যবধান তো থাকবেই। তাদের যাত্রাপথটি নিশ্চয়ই সাধারনের মতো হবে না, তাই স্বর্গ নামক ভূগোল বহির্ভূত একটি নামে তাদের বাসস্থানকে চিহ্নিত করে লোকচক্ষুর আড়ালে দীর্ঘ দিন ঢেকে রাখা হয়েছিল। নাম পরিবর্তনটা সহজেই করা যায় কিন্তু আস্ত একটা স্থানকে তুলে অন্য জায়গায় তো নিয়ে যাওয়া যায় না।
সুদীর্ঘ কাল ধরে ভারতবর্ষের উত্তর প্রান্তে প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সুদীর্থ হিমালয় পর্বত। হিমালয়েরও উত্তরে এবং হেমকুট পর্বতমালার দক্ষিণে কিম্পুরুষবর্ষ। হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ। হরিবর্ষের উত্তরসীমা বিস্তৃত ছিল নিষধ পর্বত পর্যন্ত। নিষধের উত্তরে ইলাবৃত্তবর্ষ। ইলাবৃত্তের উত্তরসীমা হচ্ছে নীলাচল। এইটি এশিয়ার মধ্যবর্তী স্থান। আধুনিক কালের পামিরমালভূমি বা পূর্ব তুর্কিস্থান। এই সমগ্র অঞ্চলটি একসময়ে ইলাবৃত্তবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১২,০৬০ ফুট উঁচুতে মেরু পর্বতের উপর দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের বাসস্থান ছিল। এখানে তাদের সামাজিক ক্রিয়া-কর্ম, যাগ-যজ্ঞ এবং যাবতীয় ক্রিয়া কলাপ অনুষ্ঠিত হতো।
দেশবাসী যতই কুশলীই হোক না কেন, দেশের উপর যদি প্রকৃতির আশীর্বাদের হাতটি না থেকে তাহলে সে সমৃদ্ধশালী হতে পারে না। দেবতারা উদ্বাস্তু হলো তখনিই , যখন প্রকৃতি সেই দেশটার মাথার উপর থেকে কৃপা বর্ষণ বন্ধ করে দিল। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হারিয়ে গেলো ইলাবৃত্তবর্ষের সেই প্রাচীন সভ্যতা।
শুরু হলো তাদের রুটি, কাপড়া আর মকানের খোঁজ। সঙ্গে করে নিয়ে এলো তাদের সংস্কৃতি, যুদ্ধ করার কৌশল, বিশেষ যান ও অস্ত্রশস্ত্র। একই সাথে বসবাসকারী দেব ও অসুরের দল তুর্কিস্থান থেকে আরম্ভ করে একে একে আসমান জমীন পার করে অধুনা কাশ্মীরের পথ দিয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছায়। কাশ্মীরকে বেসক্যাম্প বানিয়ে শুরু হলো তাদের রাজ্য জয়। প্রথমে পাঞ্জাব , সেখান থেকে বিন্ধাচলের উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত নিজেদের দখলে নিয়ে আসেন। তারপরে বিন্ধপর্বতের দক্ষিণে আর্যরা তাদের রাজ্য বিস্তার করে ছিলেন।
কথায় বলে, পুরাণকে গলাঃধকরণ না করলে রামায়ণ ও মহাভারতকে বোঝা যায় না। এই কাশ্মীরকে কখন অন্তরীক্ষ কখনো বা পিতৃলোক বলে সম্বোধন করা হতো, যেহেতু আর্যরা প্রথমে এখানেই এসে বসতি স্থাপন করেন বলে। আসল পিতৃলোক হলো ইলাবৃতবর্ষ। কাশ্মীর থেকে যে রাস্তাটি তুর্কিস্থানের দিকে চলে গেছে সেটাই স্বর্গে বা ইলাবৃতবর্ষ যাবার পথ। এটাই দেবযান পথ নামে পরিচিত ছিল। মহাভারতের সময় তীর্থ করার জন্য সেখানে যেত। সময়ের সাথে সাথে পথটি দুর্গম হয়ে যায়। এই দেবযান পথটি মানুষ যাবার অযোগ্য হয়ে যাওয়াতে বদ্রীনারায়ন ও মানস সরোবর হয়ে স্বর্গে পুন্য করতে যেত। ব্রহ্মলোক ও বিষ্ণুলোক ইলাবৃতবর্ষের উত্তরে উত্তর কুরুতে ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে উত্তর কুরু সাইবেরিয়াতে অবস্থিত।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -০৯/০১/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন