(১৯৫) মহাভারতের দ্বান্দিকতা (পি-১)
বহু সাধকের নৈবিদ্যে মহাভারতের থালি পরিপূর্ন হয়েছে। সেখানে নিভৃতে অর্ঘ নিবেদন করে তারা মহাকবি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের সৃষ্টির আড়ালে নিজেদেরকে আত্মগোপন করে রেখে ছিলেন। এই ভাবে বহু ধারা উপধারার সংমিশ্রনে সমৃদ্ধ ঘটনাবলী একে একে মহাভারতের মহাসমুদ্রে নিমজ্জ্মান হয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অভিমুখ একটাই তৎকালীন ঋষিদের একমাত্র লক্ষ্য সমাজে পুরুষার্থের প্রতিষ্ঠা।
মহাভারতের সমুদ্র থেকে যদি একটা চরিত্রকে তুলে এনে ডাঙায় নিয়ে আসা হয়, সেই ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেই সমগ্র মহাভারত দর্শন হবে। এই মহাকাব্যের স্থাপত্য শিল্পটা সেই ভাবেই রচিত হয়েছে। যে কোন দিক থেকে দৃষ্টি মেলে ধরলেই মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ শরীরটা ধীরে ধীরে চোখের সামনে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে।
মহাভারতের সমুদ্রে দীর্ঘ সময় ধরে অবগাহন করার পর, সমুদ্রবক্ষে এক উজ্জ্বল বর্ষপ্রাচীন প্রাণীর দেখা মিলল। যে না থাকলে ব্যাসদেব এই অমূল্য কাব্য রচনাই করতে পারতেন না। তাছাড়া তিনি নিজেই এই কাহিনীর ট্রাজিক নায়ক। তিনি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুও বটে।
যে মহাকাব্যের ধারাবিবরণীর সূত্রপাত ঘটেছিল আজ থেকে ৫০০০ বছর পূর্বে রাজা জনমেজয়ের অনুরোধে বৈশ্যসম্পায়নের গলায় , সেই স্বর আজও স্তব্ধ হয়নি শুধুমাত্র কাহিনীর আকর্ষণে। সময়ের বন্ধনীতে সে আবদ্ধ নয়, বহু সৃষ্টির পাহাড় তার যাত্ৰাকে পারেনি রুখতে, সে তার নিজগুনে উদ্ভাসিত। পাঠকের শুরুটা যদি মহাভারতের যে কোনো অংশ থেকে শুরু হয়, তাতেও সাহিত্যের রসের আস্বাদন নেবার ক্ষেত্রে কোন ফারাক হবে না।
ধর্মের গভীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বার বার অধর্মকে তুলে ধরে তার বিয়োগান্ত পরিণতিকে তুলে ধরতে হয়েছিল ব্যাসদেবকে । এটা বোধহয় মহাভারতের সৃষ্টির একটা দ্বান্দ্বিক পটভূমি। কেউ কেউ যদি মহাভারত নামক সুউচ্চ ইমারতের চারটি দেওয়াল অবলোকন করে, তাকে যদি শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস বলে ভূষিত করেন, তাহলেও বোধহয় অতুক্তি হবে না। কেননা, যৌক্তিকভাবে তা সঠিক বলে তাকে প্রমাণিত করার যথেষ্ট প্রমান আছে। এখানে একটা শ্রেণী ধর্মের পক্ষে অপর একটা শ্রেণী অধর্মের বাহক এবং পদে পদে সংঘাত অবশেষে কিন্তু মোক্ষেরই জয় এটাই উপপাদ্য বিষয়। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বেদের এই পুরুষার্থের চার বর্গের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই মহাভারত।
দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের সময়ে ধর্মের সুক্ষ তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে মহামতি ভীষ্ম কখন যে শর শয্যায় নিজের আসন পেতে ফেলেছিলেন তা নিজেই জানেন না। তত্ত্ব খুঁজতে গিয়ে তিনি সময়ের আবর্তে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। সম্বিৎ যখন ফিরে এলো তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে, ততক্ষনে সূর্যি পাটে গেছে, অন্ধকারের পদধ্বনির শব্দ ক্রমেই বহুদূর থেকে ক্রমেই নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে আর ভীষ্ম তখন অসহায় হয়ে পরপারের দিন গুনছেন।
অর্থ সেদিনও নীতি আদর্শের দীপককে এক ফুৎকারে নিবিয়ে দিতে পারতো, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচার্যের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তিতে। পান্ডবদের প্রতি অনুরাগ, ভালোবাসা সবই আছে কিন্তু কৌরবদের কাছ থেকে গ্রহণ করা অর্থ তাদের হাত- পা বেঁধে দিয়েছে , শুধু তাই নয় তারা সেদিন পরম প্রিয়জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে কুন্ঠা বোধ করেন নি। এনারা ধর্ম ও অধর্মকে ভালোই বোঝেন কিন্তু সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে অর্থের প্রতি অনুরাগ। এখানে অর্থের প্রতি আপোষহীন আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্ঠান্ত মহাভারতের এই অংশটি । এখানে বেদের পুরুষার্থের চারটি বর্গের মধ্যে অর্থ যে ভোগ বা কামের মাধ্যমে জীবনের আপাতপ্রতীয়মান লক্ষ্য পূরণ যে একমাত্র উপায় হতে পারে না- সেই নীতি বোধকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ধর্মের উন্মেষ ও ধর্মযুদ্ধের শুরু এবং তার করুণ পরিসমাপ্তির মধ্যে দিয়ে। বহমান কালের প্রেক্ষাপটে ঘুরে তাকালেই দেখা যায়, সেই না বলা গল্পের পুনরাবৃত্তি আজও অম্লান । আনতো মস্তকে ধর্ম মাটির পানে তার দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে আর অপরিণামদর্শী অধর্ম মাথাউঁচু করে রয়েছে আগামী দিনে তার শিরচ্ছেদের অপেক্ষায়।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -১৩/০১/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন