বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০২৪

১৯৭) ভাব আর রসের আলিঙ্গনে কৃষ্ণ লীলা (পি ২)

(১৯৭)  ভাব আর রসের আলিঙ্গনে কৃষ্ণ লীলা  (পি ২)


 প্রেমের রসায়ন -

ভক্তির তীব্রতা থেকে প্রেমের উৎপত্তি। প্রেম আনন্দময়, প্রেম চিন্ময়, অজর, অমর ও অব্যয়, সঠিকভাবে চৈতন্যেরই আরেকরূপে। তাই  তার গ্রহনযোগ্যতা  সর্বকালে এবং সর্বস্তরে। কখনো মানুষ নিজে নিজেই  তার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে , আবার অন্য কেহ তাকে প্রেমের স্বাদ  আস্বাদন করাতে  পারে। তাই প্রেম চৈতন্যের ন্যায় সর্বলোকে অবাধে তার বিচরণ। প্রেমের পূর্নতা ভাব আর রসের অভূতপূর্ব সংমিশ্রনে গঠিত।  রসহীন ভাব যেমন কল্পনাতীত আবার ভাবহীন রসও  অবাস্তব।  প্রকৃতিদত্ত প্রেমের রসায়নে ভাব ও রসের মেলবন্ধন থাকবেই।  রসের  বিগ্রহ আবার রাসের পৃষ্ঠপোষক শ্রীকৃষ্ণের সাথে ভাবরূপে রাধার আত্মপ্রকাশই একটা পূর্ণাঙ্গ প্রেম কথা। 

 রাধা কৃষ্ণের লীলার অন্তরালে ভারতীয় দর্শন- 

মানবজীবনের অন্যতম কাম্য বস্তু হচ্ছে প্রেম। ভারতীয় দর্শনে  যার স্বরূপ অনন্ত অর্থাৎ কোন লয়  হয় না, কোন পরিবর্তন হয় না, সে-ই  নিত্য শব্দে ভূষিত হয়, অন্যদিকে  পরিবর্তনশীল বস্তুকে অনিত্য  বস্তু বলা হয় । কৃষ্ণ প্রেম অর্জিত বস্তু, সে নিত্য , তাকে লাভ করতে গেলে সাধনা করতে হয়।  তাঁকে লাভ করা ও না করার মধ্যে যে প্রতীক্ষালয়ে বসে সাধক অপেক্ষামান, সময়ের দোলাচলে, না পাবার আশঙ্কায় সেটাই হয়ে উঠে  বিরহের আবাসস্থল। জীবনে কেউবা নিত্য প্রেমকে লাভ করে মায়ার পৃথিবীকে ভুলে যান, আবার কেউবা অনিত্য প্রেমকে নিত্য প্রেম ভেবে মায়ার ঘোরে জীবনটা অতিক্রম করেন।  

লীলার রূপ -

লীলার দুটি রূপ , একটি ব্যক্ত বা প্রকট  অন্যটি অব্যক্ত বা অপ্রকট ।  মানুষ লীলার প্রকট  রূপকে নিত্য আলিঙ্গন করে, সেটাই তার অবলম্বন। লীলা নিত্য বলে   এ জগতে  সে বরেণ্য। সাধকেরা আপন মনের শুচিতা আর রুচিকে নৈবিদ্য সাজিয়ে এই লীলাকে আপন অন্তরে বন্দনা করেন। সাধকের সমগ্র অন্তর জুড়ে  এই অমৃত ভাবটি ফল্গু নদীর মতো সদাই বহমান।

 বহুরুপে শ্রীকৃষ্ণ -  

গীতায় আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে  বলছেন -" ব্রহ্মণোহি প্রতিষ্ঠাহং "। বিষ্ণুপুরাণ বলেছেন "বৃহত্ত্বাৎ, বৃংহণত্বাচ্চ তদ্ব্রহ্ম পরমং বিদুঃ"।    যার অর্থ হচ্ছে, তিনিই সবথেকে বড়, তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা।  তিনিই অনন্ত শক্তির আধার, তিনিই পরমাত্মা , তিনিই ভগবান।  এই ব্যাখ্যার আলোকে অনেকটাই স্বচ্ছ হয়ে গেল যে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের পর্বটাই রাধা-কৃষ্ণ লীলা। 

' কৃষ ' ধাতু থেকে 'কৃষ্ণ' শব্দটির উৎপত্তি। ' কৃষ '  ধাতুর অর্থ হচ্ছে যিনি সকলকে আকর্ষণ করেন । সকল  জীবের আত্মা স্বরূপ। যিনি ব্রহ্মরূপে সৃষ্টি করেন আবার শিব রূপে ধ্বংস করেন।   ' রাধা ' শব্দটির মধ্যে আছে ' রা ' অর্থাৎ লাভ করা আর ' ধা ' অর্থাৎ ধাবিত হওয়া। ' রাধা '  একজন  জীবাত্মা, সে তার গোটা জীবনটা  পরমাত্মার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাকে লাভ করার জন্য।  কৃষ্ণ হচ্ছে সেই পরমাত্মা আর তার বাঁশী হচ্ছে আহবান। এই চাওয়া আর পাওয়ার ব্যবধানটাই লীলা।  এটাই রাধাকৃষ্ণ লীলার অন্তঃসার।

কৃষ্ণলীলার চিরন্তন বার্তা - 

 দেশ কালকে অতিক্রম করে সার্বজনীন প্রেমের বার্তা শুধুমাত্র জ্ঞাতিজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে মনের মধ্যে অসংখ্য পৃথিবী তৈরি করতে পারলে  জীবনে যদি কোন বিপদ ঘনিয়ে আসে তবে সেই ভুবনে ডুব দেওয়া যাবে।  যার যত বেশি ভুবন তার যন্ত্রনা এড়াবার জায়গা ততবেশী। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের বার্তায় এবং বার্টান্ড রাসেলের এই উক্তিটি সার্বজনীন  প্রেমের ভুবনের যথার্থতা সম্পর্কে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। 


কবির স্বধীনতা 

কাব্য সাহিত্যে নৈসর্গিক প্রেমের সাথে দেহগত প্রেমের মিশেল  যদি না থাকে তবে কাব্য নাকি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠেনা। সেখানে অধিকাংশ পাঠককূল  পড়তে গিয়ে ককটেলটাকে বেশী পছন্দ করেন। সত্য বর্ণনা সব সময়ই বেশ নিরস, অনেকটা আর্ট ফ্লিমের মতো, দর্শক পায়না, কিন্তু হাইব্রিড সিনেমা সহজেই বাজারজাত হয়ে যায়।  তাই কালিদাস পার্বতীকে জগৎ জননী হিসাবে বর্ণনা করেও তাঁর  সম্ভোগের বর্ণনার হাতছানি  থেকে  নিজেকে বিরত রাখতে  পারেন নি। আর শ্রীকৃষ্ণ লীলা নিয়ে কবিদের রসবোধের দুর্বার স্রোত শ্লীলতা, অশ্লীলতার সীমারেখাকে কোথাও কোথাও অতিক্রম করে গেছে।  

কতখানি পথ হাঁটলে তবে ঈশ্বর হওয়া যায় -

ইতিহাসে খুব কম চরিত্র আছে যারা নিজগুনে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন।  মূলতঃ  অধিকাংশ হিন্দুর ঘরে ভোর হয় গীতার কোন শ্লোক উচ্চারনের মাধ্যমে।   কোন কোন প্রেমিক প্রেমিকার আচরণকে রসলীলা বলে আখ্যায়িত করা হয়।   কাঙাল নয়নে প্রেমাস্পদের জন্য  অপেক্ষমান  নারীকে রাধার বিরহের সাথে তুলনা করা হয়। আবার যখন সমাজে সবলের অত্যাচারে নিষ্পেষিত দুর্বল আকুল নয়নে দূরের ঐ পথের  দিকে তাকিয়ে থাকে,  কবে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হবেন,  আর গীতার সেই " যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিভাবতি ভারত " এই  শ্লোকের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করবেন।  এটাই উজ্জ্বল উদাহরণ - দৈনন্দিন জীবনে শ্রীকৃষ্ণ ও তার লীলা। 

 
ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -১৯/০১/২৪

rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 


কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...