বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

(২০০) মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের পদার্পণ [পি ৫ ]

(২০০)  মহাভারতে  শ্রীকৃষ্ণের পদার্পণ   [পি ৫ ] 


 

বহু কষ্টে বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণকে মহাভারতের প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসতে  হলো। বিদ্যাপতি, জয়দেবদের হাতে পড়ে সুদীর্ঘ কৃষ্ণের জীবন দর্শনটা পাঁচিলের একপ্রান্ত দিয়ে উঁকি দিয়ে ক্ষুদ্র বাতায়নে অবলোকন করার মতো। মহাভারতের পথে হাটতে গিয়ে একটা বিস্তীর্ন  ঐতিহাসিক পটভূমির উপর অন্ধ বিশ্বাসের আবর্জনাকে দূরে সরিয়ে বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি  শক্ত ইমারত না থাকলে অচিরেই সে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাবে। সেদিনের কাহিনীকাররা সেটা জানতেন। এই কথাটি মনে রেখে প্রথমেই কৃষ্ণের ঐতিহাসিক অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাসঙ্গিকভাবে মহাভারতের ঘটনাবলীর কতটা ঐতিহাসিক আর কতটা অতিরঞ্জন তার অন্বেশন স্বাভাবিকভাবেই এসে পরে।  এই যাত্রার গন্তব্যস্থল সেটাই।   

সামাজিক অবস্থান থেকে প্রেরণা       

  যেই দেশে হরেকৃষ্ণের নাম কীর্তন শুনতে শুনতে ভোর হয়, পাশের বাড়ির  খাঁচার পাখিটা মানুষ দেখলেই বলে উঠে "হরে কৃষ্ণ",   রাসমেলার উৎসব,  প্রহরব্যাপী কৃষ্ণনামকীর্তন ইত্যাদি নিত্য কৃষ্ণ ভজনা। সেই দেশে সাধারণ মানুষের জীবন যে  শুধুই কৃষ্ণময়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।  তাঁকে ঘিরে কৌতূহল যে থাকবে, সেটা আর নতুন কিছু নয়। শ্রীকৃষ্ণ  আজ শুধু ভারতীয়দের আইকন নয়, ভৌগলিক সীমারেখা সে বহুদিন আগেই পাড়ি দিয়েছে , বিশ্ব চরাচরে আজ তার অবস্থান। এই কৃষ্ণ প্রেম শুধুই লোকগাঁথা  না ঘটনার পরম্পরা ?

বিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান -

      দীর্ঘদিনের  কুসংস্কার আর  অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মনকে টেনে নামিয়ে চৈতন্যের উপর পর্দা সরিয়ে বীরদর্পে মানুষের  বুদ্ধি তার জয়যাত্রা ঘোষণা করলো শাস্ত্রকে পুখানুপুংখরূপে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে।  অপমানিত বুদ্ধি ফিরে পেলো তার হৃত গৌরবকে। বহু  শতাব্দী পরে কৃষ্ণকে পুনরায় রঙ্গ  ভূমিতে পদার্পন করিয়ে, তার মধ্যেকার অন্তর্নিহিত  শক্তির উত্থানের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার চিত্তকে পাদপ্রদীপের তলায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। এটাই আধুনিকতা, এটাই শিক্ষার গৌরব। যা মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল তা পূর্ণতার লক্ষ্যে বিকাশ। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষার কাজই হলো আবিষ্কার করা, আর আবিষ্কার হলো আত্মার উপর যে আবরণটা আছে তাকে সরিয়ে ফেলে অনন্তর সাথে তার সম্পর্ক স্থাপন করা। এটাই ভাবনার  বিবর্তিত রূপ এবং  গতিশীলতা।

 

বঙ্কিমচন্দ্রের  দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ       

আলোচনা বা সমালোচনা বিচার বিশ্লেষণের একটা প্রাথমিক রূপ। শ্রীকৃষ্ণের অবস্থান সম্পর্কে ধারাবাহিক ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বহু রচনার দরবারে হাজির হতে  হয়েছিল কিংবা হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রের  'কৃষ্ণচরিত্র '  রচনাটি  নজরে পরে। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ' আধুনিক সাহিত্য ' প্রবন্ধে এই কৃষ্ণচরিত্র নিয়ে লেখেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণকে ছাপিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র মানুষের স্বাধীন বুদ্ধি এবং চিত্তবৃত্তিকে নায়ক বানিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বাস আর বিচারের চিরন্তন সংঘর্ষে বঙ্কিমচন্দ্র মানুষের স্বাধীন বিচারের জয়গান গেয়েছেন,  তাই তিনি বলতে পেরেছেন যা শাস্ত্র তা  বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই  শাস্ত্র। অন্তর্নিহিত ভাবনার  বহিঃপ্রকাশকে  কেন্দ্র করে  ব্যক্তির চারিত্রিক মৌলিকতা ফুটে ওঠে 

ইতিহাসের প্রতি দায়বব্ধতা  অথবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট  

ইতিহাস যেখানে প্রাচীন ঘটনাবলীর নিরস কাঠামো নির্মাণ করেছেন, সেখানে পুরাণ তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। পুরাণের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে ইতিহাসটা অসম্পূর্ন থেকে যাবে। 

পুরাণকে কেন নির্ভরযোগ্য বলে মানতে হবে এবং কৃষ্ণ থাকার প্রমান -


আঠারোটি পুরাণের মধ্যে নয়টি পুরাণেই  শ্রীকৃষ্ণ আলোকিত করে বসে আছেন। যদিও পুরাণের অন্তিম পরিচয় ধর্মগ্রন্থ হিসাবে আদতে সেগুলি ইতিহাস। কেন সে ইতিহাস -স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতেই পারে।  সেখানে স্পষ্ট বলা আছে পাঁচটি লক্ষণ থাকলে তাকে মহাপুরাণ হিসাবে গণ্য করা যায়। যেমন, সৃষ্টি,প্রলয়,মন্বন্তর,বংশ ও বংশাণুচরিত। তাছাড়া জীবের উৎপত্তি, জীবনধারণ, সময়ে সময়ে অবতারের মাধ্যমে  অশুভ শক্তির বিনাশ,  ভৌগলিক বিবরণ  এবং ধর্মরক্ষার ঘটনাবলীও পুরাণের উপজীব্য বিষয়। পুরাণ লিখবার সময় পরিষ্কার বলা আছে -" যে ঘটনাবলী দেখবে, তাকে কোনোরকম পরিবর্তন ও পরিমার্জন ছাড়াই লিপিবদ্ধ করতে হবে। " তাছাড়া, তৎকালীন   সময়ে রাজসভায় রাষ্ট্র ও সামাজিক জীবনের ক্রিয়াকলাপকে লিখতে হতো ' মাগধ ' নামক একশ্রণীর রাজকর্মচারীকে।  তার পাশাপাশি ' সূত ' নামক এক সম্প্রদায় তারাও ইতিবৃত্ত লিখে রাখতেন।  যজ্ঞের সময় আমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং  বিভিন্ন রাজাদের সামনে তা পাঠ করা হতো এবং সেই শ্রুতি থেকে ঋষিরা  নতুন করে ইতিবৃত্ত লিখতেন।  যদি কখনও কোন মাগধরা রাজকর্মচারী হিসাবে  রাজার কৃতকর্মের কিছু গোপন করতেন বা পরিবর্তন করতেন, তখন সূতিরা সঙ্গে সঙ্গে সেই ভুল সংশোধন করে দিতেন।  সুতরাং পুরাণকে মাইথোলজি বললে ভুল হবে।

পুরাণের অতিরঞ্জনের প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, হিন্দু শাস্ত্রগুলির উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ধর্মচারনে অভ্যস্ত করা  এবং সেই  পথ অনুসরণ করানো, তার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সহকারে পরিবেশনটা জরুরি ছিল।  

যে সব ঘটনা শ্রীকৃষ্ণের ঘটনাবহুল  জীবনকে  নিয়ে মহাভারতে আছে,সেটা হরিবংশে ও পুরাণে নেই। যে সব ঘটনা মহাভারতে স্থান পাইনি সেইসব ঘটনাবলী  হরিবংশ, পুরাণ ও ভাগবতে আছে।  যেহেতু ঘটনা প্রবাহের সারবত্তা নিয়ে মহাভারত লিখিত হয়েছে তাই প্রাচীনতার  নিরিখে মহাভারতই সবথেকে পুরানো।
 
অতিরঞ্জন মহাভারতের পীড়া  
" দুধে জল আছে কিন্তু রাজঁহাস জলটা সরিয়ে শুধু দুধটুকু খায় " - ঠাকুর রামকৃষ্ণের  সেই বিখ্যাত উপমাটা অনুসরণ করে বলা যেতে  পারে , মহাভারতের অতিরঞ্জনকে  ঐ রাজহংসরূপী  বুদ্ধির দ্বারা বিচার বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র সারবত্তাটাকে তুলে নিলে প্রকৃত স্বাদটা গ্রহণ করা যাবে।  জীবনপথে চলতে গিয়ে বহু ঘটনার সাথে কবির পরিচয় হয় ওই দেখাটা  যখন কাব্যিক মাধুর্য্য নিয়ে পরিবেশিত হয় সেখানে কাব্যের স্বার্থে অথবা কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্যে মূল ঘটনা থেকে কবি মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা সরে যান বা সরে যেতে হয়। যাঁরা শুধুমাত্র কাব্যের স্বাদ গ্রহণ করতে চান, সেখানে কোনো প্রশ্নের অবতারণা হয় না, কিন্তু কাব্যের আড়ালে সত্যকে যিনি উদ্ঘাটন করতে চান, তিনি তো তার বুদ্ধিকে ব্যস্ত রাখবেনই। 

  মহাভারত  কখনো অনুপ্রেরণার আঁধার   

কর্মের ও কর্তব্যপ্রণয়নতার উচ্চ আদর্শকে মহাভারতের কবি জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।  যেখানে তার ঘাটতি দেখেছেন সেখানে তাকে উত্তরণের জন্য অনুপ্রেরণামূলক ঘটনা কারুর না কারুর মুখ দিয়ে বলিয়ে দিয়েছেন। কুন্তীর মুখে বিদুলাসঞ্জয়সংবাদ লক্ষ্যহীন মানুষের অন্যতম  প্রেরণামূলক কাহিনী । 
মহাভারতের কলেবরে বহু অজ্ঞাতনামা কবির অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো সেটা প্রমাণিত। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান আদর্শে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার।  তারা নিভৃতে সেই কাজটি করে গেছেন।  

মহাভারতে কৃষ্ণের প্রয়োজনীয়তা  

একটা সংগঠিত আদর্শ সম্বলিত জ্ঞানকোষের প্রয়োজনীয়তা ছিল  মহাভারতে  আর যেখানে যাঁর মধ্যে যে ধরনের ঘাটতি ছিল সেই ভান্ডার থেকে তা নিয়ে এসে তাকে পরিবেশন করা হতো। সেই ভান্ডার আর পরিবেশক ছিলেন সেই শ্রীকৃষ্ণ আর ভান্ডারটা সমৃদ্ধ ছিল জ্ঞাত ও অজ্ঞাত কবিদের সৃষ্টিতে। জীবনে কর্মের সাথে মৃত্যুর আপেক্ষিকতার সম্পর্ক স্থাপন এবং তাকে অক্লেশে গ্রহণ করার মতো মানসিক পরিমণ্ডল গঠন  ও তার গ্রহণ যোগ্যতাকে কৃষ্ণ খুব সহজভাবে কুরুক্ষেত্রে  ভীষ্ম থেকে শুরু করে কর্ণ পর্যন্ত একইভাবে তাদের জীবন থেকে উদাহরণ তুলে তাদেরই উপলদ্ধি করিয়েছেন।  প্রত্যেকটিই এক একজনের জীবনের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র। প্রকৃত আলোর অভাবে মানচিত্রের যেসব স্থান  অহংকারের আস্তরনে আড়াল হয়ে ছিল, একদিন কৃষ্ণরূপী আত্মা বহন করে নিয়ে এলো  জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। সে এসে ঘন মেঘের ঘনঘটাকে এক লহমায় সরিয়ে দিয়ে তাঁদের উপস্থিত করলেন প্রকৃত সত্যকে তাদের দৃষ্টির বিপরীতে। এই অনুঘটকের কাজটা শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে করে গেছেন। তারই ফলস্বরূপ  কুরুক্ষেত্রের আপাতপ্রতীয়মান বীরেরা বাহ্যিক শত্রু সংহার শেষে  দিনান্তে  অন্তরে বিরাজমান শত্রুদের দমন করাকে জীবনের উচ্চতম আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে প্রায় একরকম স্বেছায় নশ্বর দেহটাকে বিসর্জন দিয়েছেন। 

 ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 
তারিখ -০৮/০২/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...