( ২০১) ইতিহাসের পটভূমিতে শ্রীকৃষ্ণ [ পি ৬ ]
ইতিহাসের পটভূমিতে যদি শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজতে হয় তাহলে মহাভারত নামক এক বিশাল সমুদ্রে অবগাহন না করলে, তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এই অন্বেষণের প্রাথমিক শর্ত হলো মহাভারত কি মহাকাব্য না ইতিহাস সেটা নির্ধারণ করা। যদি ইতিহাস হয় তাহলে অবশ্যিই তাকে প্রমান দিতে হবে আর কাব্য হলে কালস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেই চলবে অর্থাৎ এখানেই ইতি টানতে হবে।
যে পথ ধরে ইতিহাসে বেনোজল ঢুকে গিয়ে তার কৌলিন্যত্বকে মলিন করে দেয়, সেই ফেলে আসা পথের মধ্যেই লুকিয়ে আছে কি কারণে ইতিহাস তাঁর ছন্দকে হারিয়ে ফেলেছিল। এই দীর্ঘ প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ফিরে যাবার পথে বহু কন্টকতা সঙ্গে আছে। যেমন ইতিহাসের ব্যাকরণের সাথে মহাভারতের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সিন্টেক্স এরররের ডিবাগ এবং সব বাধা অতিক্রম করে তাকে প্রমান সাপেক্ষে ইতিহাস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
মহাভারত কি ইতিহাস ?
ঘটনার বাস্তবতা ও অভ্যন্তরীন অনুসন্ধান
রটনাকে ঘটনা বলে ধরে নেবার প্রবল আকাঙ্খা পরবর্তী লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছিল ইতিহাসের সাথে কাল্পনিক মাধুর্য্যকে একত্রিত করে পরিবেশন করার। তাতে কাহিনীর স্বাদ হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছিলো কিন্তু বহুক্ষেত্রে ইতিহাসের স্বাস্থ্যহানি হয়েছিল অত্যাধিক তেল মশলার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে। অনাবিস্কৃত স্ক্যানারের অভাবে সেদিন মহাভারতকে সত্যের সম্মুখীন হতে হয়নি, আজ সেই স্ক্যানার আবিষ্কৃত হওয়ায় তাকে কড়ায় গন্ডায় হিসাব দিতে হচ্ছে সেদিনের কল্পনা বিলাসীকতার।
লোকগাথার হাতছানির এক বিশেষ আকর্ষণ আছে। সেই প্লাবনে সত্যের চেহারাটা এতোটাই নগন্য হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জনশ্রুতিই অত্যাধিক প্রাধান্য পেয়ে স্থায়ী মসনদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলো।
যে দূষণে দূষিত পূর্ববর্তী লেখকদের রচনা, তাকেই অনুসরণ করে পরবর্তী লেখকরা অতিরঞ্জনের একটা পরম্পরা সৃষ্টি করে। এতো গেল ইতিহাসে দূষণ ঘটেছে তার বাস্তবতা কিন্তু কেন ঘটেছিলো এবং কি ভাবে ঘটেছিলো তারও নিশ্চয়ই একটা পটভূমিকা আছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যখন প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থ লেখা হয় তখন প্রায় সব দেশে লিখে রাখবার প্রযুক্তির প্রচলন ছিল। তার পাশাপাশি এখানে সেই সুযোগ না থাকায় মূল কাহিনীকে বারবার পরবর্তী লেখকদের দ্বারা টেম্পারিং হতে হয়েছিল। যা লিখিত আকারে থাকলে সেটা সম্ভব হতোনা। তার পরিবর্তে ভারতবর্ষে গুরু-শিষ্যের পরম্পরায় সেটি মুখে মুখে শ্রুতি হিসাবে প্রচারিত ছিল। প্রমাণাদির অভাবে যা ইতিহাসের চরিত্র হরণের অন্যতম কারণ হিসাবে প্রতীয়মান।
মহাভারত নামক মহা সমুদ্রে বহু নদী, তার ধারা এবং উপধারা এসে মিলে গেছে। মজার ব্যাপার হোল এতবড় একটা আকর্ষণীয় মঞ্চে বহু দাবিহীন নিরহংকারী ঋষি ও কবিদের দ্বারা নিভৃতে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং মূল অংশ সমৃদ্ধ হয়েছে বহু উপকরণে।
যে আকর্ষণীয় মঞ্চে মহাভারত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সেটি পৃথিবীর অন্য কোন ইতিহাসগ্রন্থে সেই জৌলুস ছিল না। অনামী লেখকরা নিজেদের নাম প্রচারের জন্য নয়, শুধুমাত্র মহাভারতের মঞ্চে নিজেদের রচিত যাত্রা পালাকে ফিরে দেখার লোভ সম্বরণ করতে না পেরে, তাদের ছোট ছোট নদীসম রচনাকে মহাভারত নামক মহাসমুদ্রের সাথে গোপনে সংযোগ স্থাপন করে ধন্য হয়েছিল। তাতে হয়তো মহাভারতের কলেবরের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল কিন্তু সে তার ঐতিহাসিক সৌন্দর্য্যতাকে অনেকাংশে ক্ষুন্ন করেছিল।
কর্ম সাধনের দুটি ভিন্নমুখী ধারা থাকে একটি সকাম অন্যটি নিষ্কাম। ভারতীয় পন্ডিতরা রচনা করার সময় দ্বিতীয়টিকে তাদের জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করে ছিল। তাই নিজেদের নামযশ ছিল তাদের কাছে গৌণ আর মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল মূখ্য। তাই লোকহিতের উপযোগী রংগুলিকে নিয়ে মহাভারতের ক্যানভাসে ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস ও সাহিত্যের অভিমুখ যদিও মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে কিন্তু ইতিহাস রচনার ব্যাকরণকে অবহেলা করে নয়।
মানব সভ্যতার উন্নয়নে একদিকে যেমন ইতিহাসজ্ঞানের প্ৰয়োজনীয়তা আছে, পাশাপাশি আদর্শ সমাজ গঠনকে সেদিনের পন্ডিতরা অনুভব করছিলেন। সেখানে মহাভারত সাধারণ মানুষের আকর্ষণের এমন একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছিলো, তাই সময়পোযোগী কাহিনীর সংযোজনে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে কিন্তু সে তার ইতিহাসকে হারায়নি।
বিদেশীদের চোখে ভারতীয় কাব্যের ঐতিহাসিকতা
শুধুমাত্র রাষ্ট্র গঠনের মূল চারটে উপাদানই যথেষ্ট নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার স্বীকৃতি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য মাপকাঠি। ঠিক তেমনি মহাভারত দেশের সর্বজনের কাছে সমাদৃত হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যখন প্রবেশ করলো তখন তাকে হাস্যকর এবং পূর্বনির্ধারিত ধারণার বাহক একদল পাশ্চাত্যের বেশ কিছু পন্ডিতদের বহুরকমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
বিলাতী চশমা পরে দেশীয় গ্রন্থ পড়তে গিয়ে, তাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। আর হোঁচট খাবার অভিজ্ঞতা ভীষণ করুণ, তখন পথিক রাস্তা গঠনের কার্যকারণ বিশ্লেষণ না করেই তাকে অভিসম্পাত দিতে শুরু করে, যেটা ভীষণ সহজ প্রতিক্রিয়া।
ঘটনার গভীরে প্রবেশ না করে শুধুমাত্র কতগুলি টুকরো ঘটনাবলীর আলোকে বিদেশিদের ভারত ও তাদের সংস্কৃতির প্রতি ভ্রান্ত ধারণার ভুরি ভুরি হাস্যস্কর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন, মহাভারতে পান্ডবদের পঞ্চপতির এক পত্নী কি করে হতে পারে, এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে সাহেবরা ধরে নিয়েছিল যে, ভারতবর্ষে নারীদের মধ্যে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। এইসব ধারণার যজ্ঞে একদিন আহুতি দিলো ফার্গুসন সাহেবের প্রাচীন বাড়ির ভগ্নাবশেস দর্শন। সেখানে কিছু নগ্ন নারীমূর্তি দেখে তিনি ধরেই নিলেন যে প্রাচীন ভারতে নারীরা জামাকাপড় পড়তেন না। ঠিক তার পাশাপাশি মথুরার ভাস্কর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তার ক্রেডিটটা গ্রিক ভাস্করের ঝোলায় অবলীলায় তুলে দিলেন। বেবর বাবু তো আরেকটু উপর দিয়ে বিচরণ করেন, ভারতীয়দের প্রাচীনতর জ্যোতিষবিদ্যাকে অস্বীকার করতে না পেরে বলেই দিলেন যে ব্যাবিলনীয়দের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ তাদের জানার সম্ভারে কোনদিনও চান্দ্র নক্ষত্রমণ্ডলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অবশ্য এদের সাথে কিছু অনুকরণপ্রিয় ভারতীয়রা যোগ্য সংগত করে নিজেদের চরিত্রকে কলুষিত করেছিলেন।
সেদিন ভীষণ মুশকিল ছিল সাহেবদের বোঝানো যে, ইতিহাসকে কাব্যে প্রকাশ করাটা ইতিহাসের সম্ভ্রম হানি নয়। যেহেতু, তাদের দেশে যে সব সাহিত্য কাব্যের ছন্দে প্রকাশিত হতো সেটাকে তারা মহাকাব্য হিসাবে আখ্যা দিতো। সেই সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির আবছা আলোতে মহাভারতকে দেখতে গিয়ে তাকে মহাকাব্য বলা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না, এটা অবশ্য তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির দৌলতে মাক্সমুলারসহ ও অন্যান্য পন্ডিতদের মাধ্যমে যখন পরাধীন ভারতের অসামরিক সম্পদের গুপ্তধন আন্তর্জাতিক বাজারে উঁকি দিল, তা দেখে পাশ্চাত্যের পন্ডিতদের ভিরমি খাবার জোগাড়। তড়িঘড়ি তাকে জানার আগ্রহ পশ্চিমী দুনিয়ায় উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো । আদ্যোপান্ত সংস্কৃতে মোড়া সাহিত্য থেকে রস আস্বাদন করতে গেলে সেই ভাষাটাকে রপ্ত করতে হবে আর সেই উদ্দেশ্য সংস্কৃত ভাষাকে জানার আগ্রহ বাড়তে লাগলো। ক্ৰমবৰ্ধমান একটা পরাধীন জাতির সংস্কৃতির রুদ্ধ দ্বার থেকে উন্মোচিত আলোর রোশনাইয়ে পাশ্চাত্যের পন্ডিতদের চক্ষু ছানাবড়া। হয়তো, তাদের ধারণা ছিল সমরকুশলীরাই একমাত্র সংস্কৃতিবান হবার অধিকারী হতে পারে এবং তারাই একমাত্র সভ্যতার বাহক। শুরু হলো পারস্পরিক মুখ চাওয়াচায়ি, যারা সামান্য কারণে দুইদুটো বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে উপহার দিতে পারে, তারা কী করে মানবে প্রাচ্যের এই নীরব অহংকারকে। শুরু হল তাদের ভারতীয় সভ্যতার গৌরবকে হানি করার প্রক্রিয়া। কেউ বললো এতো অন্য দেশ থেকে চুরি করে এনেছে , ভগবৎ গীতা তো বাইবেলের আদর্শে রচিত হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবশ্য পরবর্তী সময়ে ধোপে কিছুই টিকলোনা, মিথ্যার ঘেরাটোপকে ভেঙে আজ সারা পৃথিবীতে ভোগবাদী দুনিয়ার নিত্য দৌড়ের প্রতিযোগীরা অবিশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে অচিরেই শ্রান্ত হয়ে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির বিশাল বটচ্ছায়ায় দিনের শেষে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে মহাভারতকে ইতিহাস স্বীকৃতি আদায় করতে হয়েছিল। আবার কোন কোন পাশ্চাত্যের পন্ডিতরা বলেন, কৃষ্ণ বিনা মহাভারত হলে, তাতে মহাভারতের কোন যায় আসতনা। এই বাক্যটা অনেকটা হিটলার বিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাবনার মতো। সেই সবকে মিথ্যা প্রমাণিত করে, মহাভারতের মধ্যে যে ইতিহাস আছে তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত।
----------------------------------------------------------------------------------------------
পরবর্তী সংখ্যায় - প্রামাণ্য দলিল - বিষ্ণুপুরানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ - দেশী ও বিদেশীয় মতে পাণ্ডবদের ঐতিহাসিকতা - দেশী ও বিদেশীয় মতে কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা দেশী ও বিদেশীয় মতে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা -গীতা ও মহাভারত।
----------------------------------------------------------------------------------------------
ক্রমশঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন