(২০২) মায়ার স্বরূপের ব্যাখ্যায় স্বামী বিবেকানন্দ
আধুনিক ' মায়া ' শব্দের অর্থের সাথে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের অর্থের মধ্যে বেশ খানিকটা অসম্পূর্ণতা ছিল। 'কুহক' এই প্রতিশব্দ দিয়ে মায়াকে পরিচিত করেছিল তাদের সাহিত্যে। স্বামীজির হাত ধরে মায়া শব্দটি তার মায়াময় অর্থের বাঁধনকে অতিক্রম করে, আমাদের মননে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। এই উত্তরণের যাত্রাটি খুব সহজ ছিল না, তাই তাকে এক ধারাবাহিক পথ অনুসরণ করতে হয়েছিল বিভিন্ন যুক্তিতর্কের বেড়াজাল অতিক্রম করে । এই ছোট্ট শব্দটির বহুগামিতা , প্রকারন্তরে শব্দার্থের ছলনা তাকে প্রকৃত অর্থের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।
ইন্দ্র মায়ার সাহায্য নানা রূপ ধারণ করতেন। যেহেতু ইন্দ্র ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হতেন, সে ক্ষেত্রে মায়া শব্দটি ইন্দ্রজাল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের শাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী ইন্দ্র কোন নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি নন , তিনি রাষ্ট্রের সর্ব্বোচ ক্ষমতার অধিকারী যিনি তারই উপাধি মাত্র। অবশ্য ইন্দ্রদের ইন্দ্রজাল বিস্তারের ধারাবাহিকতা আজও প্রাসঙ্গিক। সাধাসিধে জনগণ যুগে যুগে ইন্দ্রদের দ্বারা এই ধরনের কুহকতার স্বীকার। মানবসভ্যতা সমৃদ্ধ হয়েছে বহু ঋষি মুনিদের মতবাদে যাতে ভাবনার ক্ষেত্রে দিক নির্নয় করতে সাহায্য করেছিল। এই ' মায়া ' নিয়ে চর্চার দীর্ঘ অব্যাহতি পরে , আধুনিক উপনিষদে ' মায়া ' ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বস্তুজগতে পরিবর্তন একটা অনিবার্য পরিণতি , মায়া নামটি অপরিবর্তিত থেকে বারবার তার রূপগত পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্বেকার বহু মতবাদকে পিছনে ফেলে সে বিবর্তিত রূপে আবির্ভূত হয়। মায়া শব্দটিকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দার্শনিকরা বিভিন্ন মতামত পোষন করেছেন। সেই অর্থের ব্যবহারের পুনঃ পুনঃ বিশৃঙ্খলাকে শঙ্করাচার্য্যের সময় থেকে শৃঙ্খলিত করে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল।
এই উত্তরণের পর্বে বৌদ্ধদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মায়াকে পৌঁছে দিয়েছিলো বিজ্ঞানবাদে , যেখানে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল যে , ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে জগৎ মনের অন্দরে প্রতিভাত হয়, সেটা আসলে মনের একটা অনুভূতি মাত্র , বাস্তবে তার কোনো সত্তা নেই। মায়া সম্পর্কে যত ব্যাখ্যা আছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মন। সুতরাং মনকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেক মতামত প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে বহু দ্বান্দ্বিকতাকে অতিক্রম করে আসতে হয় তবেই উপসংহারে গিয়ে একটি মতই তার জয়ের ধ্বজ্জা ওড়াতে সক্ষম হয়।
বিভিন্ন পর্বে বিষয়বস্তুর সাথে অর্থের সংঘর্ষে নবকলেবরে অর্থকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি সৈনিকের কাজ করে। অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল যুক্তিকে পরাজিত করে মূলপর্বের সংঘর্থে অবতীর্ন হয়। অবশেষে সবরকমের সিঁড়িকে অতিক্রম করে চূড়ান্ত ও সর্বসস্মতভাবে গৃহীত হয়ে পূর্ণতা প্রাপ্তি হয় , এটাই অনুক্রম বা hierarchy ।
যাকে আত্মস্থ করে মানুষের স্বাভাবিক স্নায়ুর ক্রিয়াকে অস্বীকার করে ক্রমান্বয়ে মানসিক , শারীরিক বা নিজের ক্ষতি জেনেও এক অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্খার বশবর্তী হয়ে বারংবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তাই-ই মায়া। যেমন, জীবনের অবিশ্বম্ভাবী পরিণতি যে মৃত্যু, তা জেনেও মানুষ জীবনের প্রতি আসক্ত হয়ে অবশেষে তার বাস্তব চেহারা উন্মোচিত হবার পর , হতাশ হয়ে পরে।
জীবনের দিকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, মানুষ যে পরিমান সুখ উৎপাদন করেছে ঠিক তার তিনগুন দুখঃ উৎপাদিত হয়ে সেই ভোগের যন্ত্রনা পেয়ে সেদিনের সুখের অনুভূতিকে দুঃখ নামক মহাজনের কাছে মিটাতে হয়েছে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, কেননা সৃষ্টির নিয়মই একমাত্র পরিবর্তন , তাই দুঃখই সুখের পরিবর্তিত রূপ। এই চিরন্তন নিয়মকে অস্বীকার করাটাই মায়া।
" যতই আমরা উন্নত হবো, ততই আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভব শক্তি তীব্র হবে "-সেটাই মায়া। যেখানে আলো থাকবে, তার পিছন পিছন অন্ধকার থাকবেই। যেখানে মঙ্গল থাকবে, সেখানেই অমঙ্গল থাকবে। যেখানে জীবন ঠিক তার পিছু পিছু মরণ তাকে অনুসরণ করবে। পার্থিব জগতে যেকোন অস্তিত্বের ভিত্তিই হচ্ছে বিরুদ্ধভাব। এখানেও সৃষ্টির নিয়মের কোন ব্যতিক্রম নেই , এটাই বস্তুর দ্বান্দ্বিক চরিত্র কিংবা সৃষ্টির মুলে আছে দ্বন্দ, এই তত্ত্বটি প্রমাণিত হচ্ছে।
অনন্তকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, তাই জগৎ সসীমরূপে দৃশ্যমান হয়। এই পৃথিবীতে সবই সীমাবদ্ধ তার জ্বলন্ত প্রমাণ আছে, যেমন সুখের গভীরে সাঁতার কাটতে গিয়ে মানুষ তার সীমার প্রাচীরটা যেই অতিক্রম করে তখনিই সে দুঃখের সাগরে নিমজ্জমান হয় , কেননা সুখের সীমাব্ধতাকে অতিক্রম করলেই দুঃখের সাগরের শুরু। কাম্যবস্তুকে ভোগ করতে গিয়ে বাসনাকে নিবৃত্ত করতে পারেনা , সেখানেও সেই সীমাবদ্ধতা আর সেখান থেকে জন্ম নিলো অতৃপ্ত বাসনাজনিত দুঃখ। সব জেনেও মানুষ তার পিছনে ছুটতে থাকে, সেটাই মায়া। ধর্ম অর্থাৎ যে বাস্তবতাকে অনুসরণ করে চললে দুঃখের পারাপারে চলে যাওয়া যায়, তার শুরুটা হয় জীবনে বৈরাগ্যভাব আসার সাথে। আবার বৈরাগ্যভাব আসে তখনিই, যখন মানুষ বুঝতে পারে জগতের সীমাব্ধতাকে এবং সেই অনুযাযী সোনার হরিনের পিছনে দৌড়ানোর অপচেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখার মধ্যে দিয়ে। তারই পরিবর্তিত অনুভব থেকে ধর্মভাবের উৎপত্তি হয় । অর্থাৎ বৈরাগ্যই ধর্মভাবের কারণ।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -২০/০২/২৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন