(২০৩) এবং আমরা
এই ব্লগটা লিখবার আগে দুটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এক, তথ্য সমৃদ্ধ একটা চিত্র পৃথিবীর ইতিহাস থেকে খুজে নেওয়া , যেই ছবিতে থাকবে কোন কৌশলে মানুষ অহিংস আন্দোলনের পথে কি ভাবে স্বৈরাচারী শাসককে ক্ষমতা থেকে সরাতে সক্ষম হয়েছে।
দুই, মানুষের অত্যাচার সহ্য করবার ক্ষমতার যদি কোন সীমারেখা থাকে , তবে তার গড় পরিমাপ কত , বাঁধ ভাঙ্গলে তার প্রতিক্রিয়া কি রকম হতে পারে এবং কেন হতে পারে।
প্রথম প্রশ্নটির উত্তরটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষক এরিকা চেনোওয়েথ ও তার সহযোগী গবেষক মারিয়া স্টেফান ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যত গণআন্দোলন ও প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে তার ডাটা কালেকশন করে, তাকে বিশ্লেষণ করে একটা রিপোর্ট পেশ করেছেন। এই গবেষণার পর দেখা যায়, অহিংস আন্দোলন সহিংস আন্দোলনের থেকে প্রায় দ্বিগুন সাফল্য অর্জন করেছে।
গবেষক চেনোওয়াথ অহিংস আন্দোলনের সাফল্যের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, এই আন্দোলনে যেহেতু ঝুঁকি কম তাই অধিক সংখ্যায় মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। আলাদা করে তাদের কোনো শিক্ষণ দিতে হয় না। খুব বেশী শারীরিক সক্ষমতারও দরকার পড়েনা বলে স্ত্রী-প্রতিবন্ধীরা, অপ্রাপ্তবয়স্করা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বেশি সংখ্যায় মানুষের উপস্থিতি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসাবে তিনি সার্বিয়ার মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা তুলে ধরেন। যখন প্রশ্ন উঠলো সেনাদের গুলি চালানোর জন্য, তখন বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতরা থাকাতে তারা অস্বীকার করে গুলি চালাতে। অর্থাৎ বিক্ষোভে অংশ গ্রহণকারীর সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনীর কোন না কোন পরিচিত এবং পরিবারের সদস্যরা বেশি করে অংশগ্রহণ করবেন। প্রফেসর এরিকা চেনোওয়েথ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন , মোট জনসাধারণের মাত্র ৩.৫ শতাংশ মানুষ যেখানে অংশ গ্রহণ করেছে, সেখানেই স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের সাফল্য এসেছে। অর্থাৎ ১ কোটি জনসংখ্যার ৩.৫ শতাংশ হচ্ছে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের আন্দোলনে অংশগ্রহণ।
দ্বিতীয় গবেষনায় দেখা যাচ্ছে, সহিংস আন্দোলনের সাফল্যের খতিয়ান ১০ : ১; অর্থাৎ ১০টা সহিংস আন্দোলনের মধ্যে ১ টি সফল হচ্ছে আর অহিংস আন্দোলন পূর্বে প্রতি দুটিতে সাফল্যের খতিয়ান ছিল ১টি। সেই জায়গায় প্রতি ৩টি আন্দোলনে সাফল্য আসছে ১টি তে।
যেখানে গণতন্ত্রের স্রোত স্বৈরতন্ত্রে গিয়ে মিশেছে, সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেই দেশকে কি আখ্যা দেওয়া যায়, তা নিয়ে বিতর্কের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে।
আবার সহিংস ও অহিংস আন্দোলনের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। এইটা যেমন একটা রাষ্ট্রীয় চরিত্রের একটা দিক আবার আন্দোলনের কি ধরনের চরিত্র হলে সে অহিংস আন্দোলনের তকমা হারাবে, সেই নিয়েও বিতর্ক আছে। যেমন, আন্দোলনের সময় যদি মানুষের বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির উপর আক্রমণ চালান হয়, তখন তাকে কি অহিংস আন্দোলন বলা যেতে পারে কিংবা আন্দোলনের মধ্যে থেকে জাতপাত নিয়ে যদি আক্রমন করা হয় শারীরিক আক্রমণ না করে , তবে সেই আন্দোলনকে কি ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে ? যেই আন্দোলনে কেউ যদি নিজেদের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মবিসর্জন দেয়, তাহলে তাকে কি আন্দোলন বলা যেতে পারে। উপসংহারে অধ্যাপক চেনোওয়েথ এবং মারিয়ে স্টেফান বলছেন, আন্দোলনের সাফল্যে অহিংস আন্দোলন সব থেকে কার্যকরী। এই আন্দোলন প্রায় ১৯৮ ধরনের আছে বলে তারা লক্ষ্য করেন।
বর্তমানে ডিজিটাল বিপ্লব একটা বড় জায়গা অধিকার করতে চলছে। অবশ্য এটি অনেকটা শাঁখের করাতের মতো, উভয় পক্ষই তার সুযোগ গ্রহণ করছে। তা সত্ত্বেও একটা আন্দোলনের জমি তৈরী করতে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার জুড়ি মেলা ভার। অন্যদিকে অত্যাচারী শাসক এই সোশ্যাল মিডিয়াতে নজরদারি করে আন্দোলনের উপর আঘাত হেনে যাচ্ছে। ডাটা সাইন্স ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বৈরাচারী শাসক সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীদের মনোভাব এবং ঝোঁককে সহজেই খুঁজে বার করছে।
এসব কিছু সত্ত্বেও, শান্তির পথে মানুষের জয়যাত্রা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।
মানুষের অত্যাচার সহ্য করবার ক্ষমতা -
পার্থিব জগতে চৈতন্য ছাড়া আর কেউ অসীম হতে পারেনা আবার অপরিবর্তিত থাকতে পারে না। এই সত্যের আলোকে যাবতীয় ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চৈতন্য ছাড়া বাদবাকি সবই সসীম এবং পরিবর্তনশীল। সুতরাং সেই নিয়মে সহ্য করার ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে এবং সেটাকে অতিক্রম করে গেলে পরিবর্তনের নিয়ম অনুসারে সহ্যের চরিত্রগত পরিবর্তন হতে বাধ্য। নাগরিক জীবনে স্বৈরাচারী শক্তির দ্বারা মানুষের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতার সাথে আন্দোলনের নিবিড় সম্পর্ক আছে, ইতিহাসে তার অসংখ্য উদাহরণ আছে। সহ্য ক্ষমতার মৃত্যুতে সে প্রতিবাদ হিসাবে সে নতুন করে জন্ম গ্রহণ করে, এটাই বাস্তব। একে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারোর নেই।
ক্রমশঃ
তারিখ -০৩/০৩/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন