(২০৫) আজকের দিনের উপলদ্ধি -
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের অন্যতম সার্বজনীন বাণী "চৈতন্য হোক "! সেটা আজ সমাজে বহন বিবর্জিত গুদামজাত সম্পদ। অথচ মৃতের সাথে জীবিতের সীমারেখার একমাত্র চিহ্ন সেই চৈতন্যের উপস্থিতি। তবে কি প্রাণীরা আজ জীবন্মৃত ? জীবনের উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া ঝড়ে শুয়ে পড়া বৃক্ষরাজি ? দূর থেকে বিধাতা অবলোকন করে জীবন্ত মানুষ আছে বলে ধারণা করতে পারে না। মাঝে মাঝে সেখান থেকে কোনো আর্তনাদ শুনা না গেলে পতিত ভূমি বলেই ভ্রম হতো।
বিধাতা আজ নিজের কাছেই প্রশ্নের সম্মুখীন, কি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে চৈতন্যবিহীন মানুষ জীবিত বলে দাবী করছে কিংবা কি ধরনের সংকেত বার্তা আকাশ-বাতাসে ছেয়ে গেছে যে মানুষ আজ নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে যুদ্ধারম্ভের প্রস্তুতির দামামার শব্দের। ভাবছে, এই মুহূর্তটি মোটেই উপযুক্ত নয় চৈতন্যের প্রকাশের, কেননা সে ক্ষেত্রে অস্তিত্বের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভবনা প্রকট। পূর্বে যাঁরা সময়ের সংকেতকে অস্বীকার করে জীবনের সংগীতকে তাদের বীণার তারে ঝংকার তুলেছিল, তারা আজ কংসের নিদ্রাভঙ্গের অপরাধে কারাগারে কেউবা বন্দী, কেউবা আজ ধারধামের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে কংসের অতীব আদর-যত্নে। তাঁরা অবশ্যিই স্মরণীয় এবং বরণীয়।
আজ কিন্তু আকাশে বাতাসে আগমনী গানের সুর ধ্বনিত হচ্ছে, সেই সুর আজ আহবান করছে কংসের কারাগারের অবলুপ্তির। যুগে যুগে এই কংসরা বস্তু জগতের চারটি দিকের একটি দিক দেখেই তাকে সমগ্র জগৎ ভেবে ভুল করে বসে। কিন্তু বাস্তবে তাদের কৃতকর্মের ফল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে, অজানা উৎস থেকে আসা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞাত না হবার কারণে নকল বুদির গড় অচিরেই ভূমিতে আশ্রয় নেয়।
বিধাতা জীবকে চৈতন্য দিয়ে চুপ করে খেলা দেখে। ভাল-মন্দের দায় সে কখনই নেয় না বা নিতে পারে না , কারণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া একই সূত্র থেকে প্রকাশিত। আসলে অদৃষ্ট বলে কিছুই হয় না, যা হয় তা কাজের মূল্যায়ন।
এটা প্রমাণিত যে, সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে অখন্ড চৈতন্য বিদ্যমান, তবে মানবের কোন শক্তি নেই তাকে ঢেকে রাখে কিংবা খন্ডন করে। অবশ্য সৃষ্টির শুরুতেই স্রষ্টা অহংকার ১ নামে যে সল্টটাকে ইনবিল্ড অবস্থায় প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন, তার রকমফেরে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে। তখনিই তারা কৃত্তিম মেঘের সৃষ্টি করে চেতনার আলোর গতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে। সমুদ্রের বালুচরের পথিকের পদচিহ্ন যেমন নতুন পথিকের পায়ের তলায় হারিয়ে যায়, ঠিক তেমনি সেই অব্যাকরণীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীরা ইতিহাসের কঠোর নিয়মে বিলীন হয়ে যান।
নিভৃতে মন মন্দিরে জ্ঞানের সাধনায় মগ্ন সাধক, ধ্যানভঙ্গে উদাত্ত কন্ঠে বলে ওঠেন জ্ঞানই একমাত্র পথ যে চৈতন্যকে জাগ্রত করতে পারে। সেই ডাকে কেহবা সাড়া দেয় কেহবা নিদ্রায় মগ্ন থাকে কিংবা তাদের একপ্রকার ঘুমিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। যুগে যুগে মানব সভ্যতা এইভাবেই এগিয়ে চলে। বহু মহামানবের পদধুলিতে ধন্য এই ভারতভূমি। ঋষিদের অনন্ত সাধনার দ্বারা প্রাপ্ত পরীক্ষিত ভারতের জীবন দর্শন। নিদেনপক্ষে যে সৈনিক সন্ন্যাসীর মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিস্থাপিত হলো ভারতীয় দর্শনের গরিমা, যার মূল সুরটা ছিল অদ্বৈত বেদান্তের মতো অখন্ড মানবজাতি ও মনুষত্ব। আধ্যাত্মিক আন্তর্জাতিকতাবাদের চরম নিদর্শন। এই আধ্যাত্মিকতা প্রচলিত সেই মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি নয় , বরং ঘন্টা বাজিয়ে মানব ঈশ্বরের ঘুমন্ত অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে বলা " তুমি আর তোমার পাশের বাড়ির মানুষটা স্বরূপগতভাবে এক "।
গতিশীল পরিবর্তনের মধ্যে যা কিছু অপরিবর্তিত তাই-ই সনাতন আর সেটাই ধর্ম হিসাবে যুগে যুগে পালিত হয় স্থান,কাল ও সময় নির্বিশেষে। যেমন সত্য যিনি, তিনি অপরিবর্তিত। সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তিই হচ্ছে পরধর্মসহিষ্ণুতা আর সেটাই মানবধর্ম।
আজ নিজেদের আর আগামী প্রজন্মের জন্য মূল্যায়ন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে দেশের গতিপথ নির্ধারণের। বিশ্লেষণ করতে হবে জনপ্রতিনিধিদের ইতিহাস, দর্শন আর তাদের পারফরম্যান্সের আলোকে। ভাবনা আর সেই আলো ফোটানোর কাজটা কোন সাহায্য ছাড়া নিজেদেরকে নিজেদের জন্যই জ্বালাতে হবে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
১ অহংকার -সাংখ্য দর্শনের মতে প্রকৃতি থেকে মহত্তত্ব ; বুদ্ধি ও অহংকারের উৎপত্তি হয় এই মহৎ থেকে। ( একটা জিনিস মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা সাধারণ অর্থে দাম্ভিকতাকে অহংকার বলে জানি, কিন্তু দর্শনে অহংকার মানে শরীর বা দেহ ) এই অহংকারের দুইটি ভাব । একটি সাত্বিক ভাব ; অন্যটি তামসিক ভাব। অহংকারের সাত্বিক যে অংশটি আছে, সেখান থেকে পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রীয়( কর্ণ, চক্ষু, নাসিকা, ত্বক ও জিহবা ) ও মন এবং পাচঁটি কর্ম্মেন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। অহংকাররের তামসিক ভাব থেকে পঞ্চ তন্মাত্রা ( শব্দ, স্পর্শ ,রূপ , রস ও গন্ধ অর্থাৎ যেসব ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মানুষ বাইরের জগৎ থেকে সংবাদ গ্রহণ করে ) এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয় পঞ্চ মহাভূত(বস্তু জগৎ) । তারা যথাক্রমে, ক্ষিতি , জল, তেজ , বায়ু ও আকাশ।
**************************************************
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -০১/০৪/২৪
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন