(২০৯) বিদ্রোহী কবিতার প্রাসঙ্গিকতা এবং সমকালীন ভারতবর্ষ
কবি নজরুলের এই কবিতাটি শুধু মাত্র একটা সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেনা, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তাকে জায়গা করে দিলে দেখা যায় যে সে কালকে অতিক্রম করে একটা প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে। আজকের এই ১২৫তম জন্মদিবসে সুযোগ খুঁজে পেলাম তাকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার। কবির এই উত্তরণটি খুব সহজে হয় নি। জীবনের আঁকেবাঁকে তাঁর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা আর কঠিন বাস্তবকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করে জীবনে জীবন যোগকরা , নিঃসন্দেহে একটা কঠিনতম কাজ। সাধারণ মানুষের কথা বলতে গেলে এই যোগটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। নিত্যদিন সমাজের বহমান স্রোতে অবগাহন করে লদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ জীবনকে চিনতে শেখে; একবার যদি সেই অন্তর্নিহিত সুরের ফল্গুধারার সাথে বাহিরের জগতের মেলবন্ধন ঘটে গেলে, সে সময়কে অতিক্রম করে অনন্তের সাথে মিলতে চায়।
একধারে দেশমাতৃকা পরাধীনতার অন্ধকারে নিমজ্জমান এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল সংকীর্ণ ধর্মান্ধতার বিষ, উভয়ের নাগপাশে গোটা সমাজটা আছন্ন। এমনিই এক সময় দীর্ঘ ৪ বছর ধরে সমগ্র বিশ্ববাসী অনুভব করেছিল কিছু রাষ্ট্র নায়করা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাণীশ্রেষ্ঠ মানুষ যারা একে অপরকে পারস্পরিক দ্বন্দে আহ্বান করে অসংখ্য মানুষের রক্তপান করে অবশেষে ১৯১৮ সালে সেই বিশ্ব যুদ্ধের অব্যাহতি দিলো। ইতিমধ্যে ঘটে গেছে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সাধারনের অংশগ্রহণের মতো একটি যুগান্তকারী নিদর্শনের দৃষ্টান্ত বিশ্বকে নব চেতনায় প্লাবিত করলো। কবি নিজে সেই যুদ্ধের একজন অতিব ক্ষুদ্র একজন অংশগ্রহণকারী। প্রকাশ্যে যুদ্ধ হয়তো দেখতে পাওয়া যায় না কিন্তু মানব মনের অন্তরালে সেই চিরন্তন অপ্রকাশিত যুদ্ধ প্রতি মুহূর্তে বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে।
সর্বগ্রাসী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবায় আহত মানুষের রক্তাক্ত ক্রন্দনের আওয়াজ অসংখ্য চেতনাসম্পন্ন মানুষের মতো ক্রমেই পীড়িত করছিলো কবির অন্তরাত্মাকে। শাসক আর শোষকের যৌথ প্রযোজনায় সংগঠিত শোষনের পুঁতিগন্ধময় পঙ্কিল গহ্বর থেকে শোষিতরা নিজেদের উদ্ধার করার জন্য বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। উন্মত্ত শাসক কখনই তার ক্ষমতার বিলগ্নিকরণে বিশ্বাস করে না। সংগঠিত নিপীড়িত মানুষের শক্তিই সেই ইপ্সিত লক্ষ্যকে পূরণ করতে পারে। বিদ্রোহীদের সব থেকে বড়ো পরিচয় যে তাঁরা মানবতার এক মহান পূজারী। তা না হলে, সে সর্ব সুখ ত্যাগ করে এই ক্ষয়ে যাওয়া পুরোনো ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন ইমারত গড়ার স্বপ্ন দেখে না। ১৯২২ সালে কবির ২৩ বছরের জীবনের উপলদ্ধির ফসল উগরে দিয়েছিলেন তার " বিদ্রোহী " কবিতার প্রতিটি ছত্রে।
সৃষ্টিটা লুকিয়ে আছে কার্য্য কারণের গভীর অন্তরালে -
এই কবিতাটি উপস্থাপনার পাশাপাশি তাঁর অন্তর্নিহিত সুরটা না ধরতে পারলে কবিতা পাঠ এবং কবি নজরুল ইসলামকে উপলদ্ধি করার ব্যাপারটা অসম্পূর্ন থেকে যাবে বলে মনে হয়। তাই এই আলোচনাকে সংক্ষেপে মূল কয়েকটা পর্বে ভাগ করে এগিয়ে গেলে আমরা কবিকে সত্যিকারের অনুধাবন করতে পারবো বলে মনে হয়।
বুনিয়াদি শিক্ষার প্রথম পাঠটি মানুষ পরিবারের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে গ্রহণ করে থাকে। কবির সুফিবাদী মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হবার কারণে, ধর্মের আধ্যাত্মিক দিকটা শৈশব অবস্থা থেকে তাকে প্রভাবিত করেছিল। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও স্বরূপ সম্পর্কে, ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিমুনিদের মতো কবির অন্তরে অনন্ত জিজ্ঞাসার বীজ রোপিত হয়েছিল । এই দৃশ্যমান পৃথিবীর বৈচিত্রতা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন ইন্দ্রিয়ের অপরপাড়ে এক পরমসত্তা বিরাজমান । এই দৃশ্যমান জগৎ অসীম শক্তির সসীম প্রকাশ। মানুষ ও তার ব্যতিক্রম নয়। এই জাগতিক প্রক্রিয়ার পিছনে এক সুগভীর পরিকল্পনা সৃষ্টি কর্তার আছে, সেটাই তাঁর অধ্যাত্মজগতে প্রবেশের প্রথম সোপান।
কবির ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণার ভিত্তি - কবির এই ধারণা সম্পূর্ণ যুক্তি নির্ভর এবং সেখানে অন্ধ বিশ্বাসের কোন স্থান ছিল না। তিনি তত্ত্ববিদ্যা ও কার্যকারণমূলক যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেছিলেন ।
কার্য্য কারণ সম্পর্কে সাংখ্যদর্শন বলছে, এই জগতে এমন কোন বস্তু নেই যে নিৰ্দ্দিষ্টভাবে সুখের কারণ হবে কিংবা দুঃখের কারণ বা মোহের কারণ হবে। বস্তুর এই ত্রিগুন তার অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত আছে। রামায়নে এক সীতা একাধারে রামের মনে সুখের অনুভূতি, শূর্পণখার মনে দুঃখের কারণ আর রাবনের মধ্যে মোহের আবরণের সঞ্চার করেছিল।
কবির দার্শনিক অনুসন্ধিৎসা -
কবির দৃষ্টিতে ধর্ম - প্রত্যেক কার্য্যের পিছনে কারণ থাকে। ধর্মকে সমাজে অনুশীলন করার মুখ্য কারণ হলো মানুষের অবাধ আচরণকে নিয়ন্ত্রন করে এক শান্ত, সুন্দর, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। নজরুল এর সাথে আরেকটু সংযোজন করেছেন যে, যদি সমাজে যথাযথ ধর্ম পালিত না হয়, তা হলো সেটা একাধারে ধর্ম বিরোধী কাজ এবং অন্যায়। সুতরাং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘঠিত হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই সময়োপযোগী ধর্ম।
কবির অধ্যাত্বিকতা - আত্মা যখন আমিত্বের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ ছেড়ে অনন্তের খোঁজে পাড়ি দেয় সেই আকর্ষণের ধারাকে অধ্যাত্বিকতা বলে থাকে। কবি নিজের মধ্যে সেই স্রষ্টার সন্ধান পেয়েছেন, তাই তার বিভিন্ন সাহিত্যে সেই পরমপুরুষের গান গেয়েছেন। স্রষ্টা যখন অন্তঃস্থলে জাগ্রত হন , তখন সমগ্র বিশ্বের ক্ষুদ্র স্বার্থ কিংবা কোন আপাত ঘৃণ্য বস্তু মনকে বিচলিত করতে পারেনা। কেননা ত্রিগুণের(সত্ত্ব , রজঃ ও তমঃ ) স্পর্শে তখন মানুষ কাতর হয় না। এই অনুভূতিই কবিকে মানুষ নজরুল থেকে আধ্যাত্মিক নজরুল হিসাবে প্রতিপন্ন করেছিল।
এই অনুভূতি জাগ্রত হবার পিছনে প্রাচীন যুগের মুনি ঋষিদের মতো কবির মনেও উৎসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান জগতের অন্তরালের প্রকৃত সত্তার অস্তিত্বের প্রশ্ন। যদিও প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পরমসত্তার অস্তিত্বের প্রশ্নে দুটি ভিন্ন দর্শন প্রতিষ্ঠিত যা আস্তিক দর্শন এবং নাস্তিক বা বস্তুবাদী দর্শন হিসাবে পরিচিত । কবির দর্শন ছিল দৃশ্যমান জগতের পিছনে ঈশ্বর বা পরমপুরুষের উপস্থিতি আছে অর্থাৎ আস্তিক দর্শন।
কবির কথায় " আমার যা কিছু সৃষ্টি তার পিছনে সৃষ্টি কর্তা ছাড়া আমি কাউকে ভাবতে পারিনা। আপাতদৃষ্টিতে আমার ইচ্ছার দ্বারা সৃষ্টি মনে হলেও তার কার্য্য কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেটি ঈশ্বরের ইচ্ছা। যে বাঁশির সুর আমার মনকে প্রভাবিত করে বাঁশির সৃষ্টির কৌশলে মূর্ত হয়ে ওঠে, সেটিও আমার নয়। প্রত্যক্ষ অপরাধী আমি কেননা, আমিই সেটা বাজানোর মতো অপরাধ করেছিলুম, কিন্তু আসলে যিনি সেই বাজানোর সুর সৃষ্টি করে আমার অন্তরে প্রোথিত করেছেন, তিনিই বীণাকার, আমি তো মাধ্যম মাত্র। সুতরাং রাজার বিরুদ্ধে যিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেণ, আসলে তিনি সেই বীণাবাদক ঈশ্বর, আমি তো নই। "( রাজবন্দীর জবানবন্দী )
বহুত্বের মধ্যে একেশ্বরবাদ - বিদ্রোহী কবি তার সাহিত্যে বহু দেব-দেবীকে উপস্থিত করলেও তার উপলদ্ধি ছিল বৈদিক যুগের প্রাচীন সাহিত্য ঋগ্বেদের একেশ্বরবাদের যুক্তির ব্যাখ্যার উপর। সব নদীর মহাস্রোত যেমন সাগরে এসে একাত্ব হয়ে গেছে, ঠিক তেমনি সব ধর্মের দেবতাও সেই এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরে এসে মিলিত হয়ে গেছে। এই ধারণার উন্মেষের ধারক তিনি নিজে আর যাদের ধর্মমত তাকে সমৃদ্ধ করেছিল, সেই বাহকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন রায় ও স্বামী বিবেকানন্দ।
কবির অদ্বৈতবাদ -হিন্দু ধর্মের বহমান ধারায় ভিন্ন ভিন্ন গতিপথকে চিহ্নিত করার প্রয়োজনে অসংখ্য নামকে আশ্রয় করে পরিচিত হতে হয়েছিল কিন্তু দিনের শেষে সেই বহুমুখী যাত্রা যখন এক নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে এসে যখন মিলেমিশে একেকার হয়ে যায় , তখন আর তাঁকে আলাদা করে নাম দিয়ে খুঁজলেও চেনার উপায় থাকে না যে, পূর্বে কি উপাধিতে তিনি ভূষিত ছিলেন। সব নাম যেখানে এক হয়ে মিশে যায়, সেই তো সর্বনাম। সেটাই একেশ্বরবাদের চরম নিদর্শন এবং অদ্বৈতবাদের ভিত্তি। সেটা যেমন, প্রতিধ্বনিত হয়েছে যেমন গীতাতে, ঠিক তেমনি ইসলামে। গীতা বলেছেন " পরমেশ্বর থেকে উচ্চতর আর কোন দ্বিতীয় সত্তা নেই"। আবার আল কোরানে বলছেন " তিনি এক ও অদ্বিতীয়, অনাদি; তিনি কাউকে জন্ম দেন না, তাঁর জন্মও যেমন হয় না, তাঁর মৃত্যুও হয়না, তিনিই পরমস্রষ্টা। "
কবি বলেছেন, যেদিন আমি শুনেছি মসজিদের আজান আর মন্দিরের শঙ্খধ্বনি ঊর্ধ্ব আকাশপানে শব্দের ডানা মেলে উড়তে উড়তে গিয়ে অনন্তের সাথে একাত্ম হয়ে যায়, তখন পরমপিতা স্বাদ, রূপ ও গন্ধ নির্বিশেষে মুগ্ধ হয়ে শুধুমাত্র সেই শব্দের অমৃত আস্বাদ গ্রহণ করে খুশিতে আহ্লাহিত হয়ে উঠেন। আর সেখানে, তুমি ভায়া কে হে, জাতের নামে বজ্জাতি কর ! অশুভকে উপলদ্ধি করতে না পারলে শুভকে চেনা যায় না।
কবির নৈতিকতা - চেতনার পথ জুড়ে বসে থাকা একদল মিশ্র বাতাসের গন্ধ প্রতিনিয়ত আছড়ে পড়ে মনের অলিন্দে। সেখান থেকে উগ্র বন ফুলের গন্ধের সাথে ভালোলাগা ফুলের সুরভি বাছতে গিয়ে ভালো-মন্দ সম্পর্কিত ধারনাটাই ক্রমশই ধোঁয়াটে হয়ে উঠে। তখনিই মনে হয় সব ফুলের গন্ধের তারতম্য নির্ধারণের শিক্ষাটিতে ফাঁকি আছে, জ্ঞানটা সম্পূর্ণ হয়নি। চৈতন্যের সহোদর নৈতিকতাই যুগে যুগে মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিষয়ের মূল্যায়ন করতে শিখায়।
কাছে গিয়ে কেন চলে গেলে দূরে - মার্ক্সবাদের অন্তর্গত সাম্যবাদ সম্পর্কিত ধারণা কবি মনের জানলায় উঁকি দিয়ে প্রবেশ করেছিল কিন্তু বস্তুবাদী ভাবনার নাস্তিকতাকে কবি অন্তরে যথাযথ স্থান দিতে পারেন নি। কিন্তু তার সাম্যবাদী দর্শনকে মনে স্থান করে দিয়েছিলেন ইসলামী সাম্যবাদী ভাবনায়।
পুণ্যের অপর নাম প্রকৃত শিক্ষা- এই বিশ্ব প্রকৃতি থেকে আমন্ত্রিত যে কোনো বস্তু প্রাথমিক অবস্থা থেকেই সমাজের সম্পদে পরিণত হয় না। সেই আকরিক অবস্থা থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ হতে গেলে একাধিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেই বস্তুকে অবতীর্ণ হতে হয়। ঠিক তেমনি, শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে একটি মানুষ কালে কালে মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়। সেক্ষেত্রে কবি লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষা প্রচার ও গ্রহণের পরিবেশ গঠনের অনুরাগী ছিলেন। এই শিক্ষাই একমাত্র পথ প্রদর্শক শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের। অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসে যে বিচার বিশ্লেষেণর মাধ্যমে জন্ম হয় প্রকৃত শিক্ষার আর অপরকে বিশ্বাসকে নিজের বিশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করে যে শিক্ষা হয়ে থাকে, তা হয় পরাশিক্ষা আর তার থেকেই জন্ম নেয় দাসত্ব।
ওরে অশান্ত দুর্বার যৌবন, পরলো কে তোরে জ্ঞানের মুখোশ সংযম-আবরণ - পরাধীন ভারতবর্ষে সময়পোযোগী শিক্ষা হল দেশ মাতৃকাকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা, সেখানে সংযমের শিক্ষা ছিল সেই সময়ের অনুপযোগী শিক্ষা। একই ভাবনার প্রতিধ্বনি স্বামীজীর কন্ঠে বেজে উঠেছিল। তার স্পষ্ট উক্তি ছিল দেশমাতৃকা যেখানে পরাধীন সেখানে দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেবতাদের পূজা শিকেয় তুলে দিয়ে, দেশকে স্বাধীন করতে হবে। নজরুলের ভাবনাও একাকার হয়ে গিয়েছিলো স্বামীজীর ভাবনার সাথে। প্রেমের স্বরূপ দেশ ও মানবের ক্ষেত্রে কোন ব্যবধান নেই।
আমার চক্ষে পুরুষ- রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই - অজ্ঞানতাই বন্ধন , কবির দৃষ্টির প্রসারতা অন্তঃপুরের পর্দা ভেদ করে নারীর পরাধীনতার চেহারাটা ধরা পড়েছিল। একটি জাতির অর্ধেক জনসংখ্যাকে যদি অন্ধকারের শিকলে আবৃত করে রাখা হয়, তাহলে সেই জাতির উন্নতি কখনই হয়না এটাও যেমন সত্য, ঠিক তেমন জাতির জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য মানুষকে দারিদ্রের সংগ্রামে গোটা জীবন জুড়ে যদি ব্যস্ত রাখা হয়, তাহলে সেই আর্থিক সংঘর্ষে ক্লান্ত মানব আর যাই হোক জাতির মান উন্নয়নের পথিক হতে পারে না।
যে রচনাটির শিকড় প্রোথিত আছে মৃত্তিকার গভীরে আর তার কোন একটি ডাল বিশ্বাস, কেউবা অনুভূতি, তার গোড়াটা চেতনা আর সব মিলিয়ে যে দর্পনে সামাজিক দর্শনের ছবি প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হয় , সেই-ই সজীব সাহিত্য। নজরুল ছিলেন তারই পূজারী।
সেই দ্বারে গিয়ে ফিরে আসা - যে দ্বার দিয়ে সাম্যবাদী ভাবনার ঢেউ অন্তরকে প্লাবিত করেছিল এবং মার্ক্সিয় দর্শনের প্রবল দোলায় দেহমনকে আছন্ন করে ছিল। কিন্তু মনের কোণে স্থায়ী আবাসিক ছিল ঈশ্বর ভাবনা। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কিত দৃঢ় ধারণা থেকে তার মনকে বস্তুবাদী ধারণা টলাতে পারেনি। সাম্যবাদ ছিল একান্তই ইসলামিক সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের ধারণাটা যে ইসলামী সাম্যবাদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, এই যুক্তির সপক্ষে তিনি সওয়ালও করেছিলেন।
সাম্যবাদী কাব্যে তিনি সমান্তরালভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং মর্যাদার সাথে স্থান দিয়েছেন গীতার শক্তিবাদকে এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সদ্য কমিউনিজমকে। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে ইসলামের মূলধারার সাথে তার নাড়ীর সংযোগকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে দেননি।
কবি ভাবনায় আত্মা বা চৈতন্য - কবি কন্ঠে সেই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছিল -"আমি মৃন্ময়,চিন্ময়, / আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়! " দ্বৈত ও অদ্বৈতের সংঘাত অবশেষে অদ্বৈতের জয়- আত্মা অবিনশ্বর- সেই চৈতন্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে তার "বিদ্রোহী " কবিতায় ১৪৭ বার "আমি" শব্দরূপে। কোথাও যেন গীতার শ্রীকৃষ্ণের বাণীর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে , জীবাত্মার অস্তিত্ব বিনাশ হয় না , দেহে আত্মা থাকার উপযুক্ত পরিবেশ যখন থাকেনা, তখন তিনি সেই দেহ ছেড়ে অন্য দেহে নিজেকে স্থানান্তরিত করে। অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যখন প্রাণভয়ে চলে যাবেন বলে স্থির করে ছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মনে করিয়ে দেন যে আত্মা দেহের অতীত, অজর, অমর। মৃত্যু একটা স্থানান্তরের মাধ্যম, যেখানে জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় আত্মা নিজেকে স্থানান্তরিত করে।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ -২৫/০৫/২৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন