(২১৯)বীর হনুমানের লঙ্কা নিরীক্ষণ
(২১৯)বীর হনুমানের লঙ্কা নিরীক্ষণ
অরক্ষণীয়া নারীর সম্ভ্রমের বিড়ম্বনা নিম্নবর্গের নারীদের যতখানি প্রাপ্য ঠিক ততখানি না হলেও অভিজাত রমনীদের ক্ষেত্রে ও ব্যতিক্রম ছিল না। রাজপাট খুইয়ে স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে যে বসবাস করছে, সে আর যাই হোক ক্ষমতার নিরিখে সে তো যথার্থই দুর্বল। যে নিজের অধিকারের প্রশ্নে আবেগপ্রবণ হয়ে সেই দুর্বলতার কাছে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আসে, সে আর যাই হোক, মানসিকভাবে যথেষ্ট দুর্ব্বল। আর ক্ষমতাশালী যদি হতো, তাহলে কেউ কি রাজভোগের আয়াস বিসর্জন দিয়ে সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে শ্বাপদ সংকুল পরিবেশে বাস করে ? সেই অক্ষম পুরুষের সুন্দরী পত্নীকে অপহরণ করাই যেতে পারে। এরকম একটা মনোভাব রাবণ মনে মনে পোষণ করতো বলেই সে এমন একটা ছদ্মবেশ ধারণ করলো। যেই বেশটাকে সে ধারণ করলো, আপামর নরনারী সেই রূপটাকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করে। সাধুর বেশকে রাবন কলঙ্কিত করেছিলেন, ঠিক সেই কারণে স্বর্গের বড় বড় দেবতাদের কাছে যথেষ্ট ধমক খেয়েছিলেন, সঙ্গে প্রাণটাও তার খোয়া গিয়েছিল।
লুঠ হয়ে যাওয়া পত্নীকে উদ্ধার করা নিয়ে রোমহর্ষক যুদ্ধই তো রামায়ণের মূল উপজীব্য বিষয়। এতদভিন্ন সংসারী পাঠকদের পরিবারের নিত্যদিনের রাজনীতির সাথে পরিচয় থাকার দারুণ অযোধ্যার রাজান্তঃপুরের ঘটনাবলী খুব যে উৎসাহ প্রদান করেছিল, তা মনে হয় না। অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু রাক্ষস বধের মতো ঘটনা বাদ দিলে, বাকি গল্পটা বেশ সাদামাটা। কাহিনীকে চিত্তাকর্ষক করার প্রয়োজনে সীতার হরণটার বোধ হয় একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ভিলেন যদি না থাকে তবে নায়ক বানানোর ক্ষেত্রে সাহিত্যিকদের কালঘাম ছুটে যায় আর গল্পও দীর্ঘজীবন লাভ করে না।
রাজপুরুষরা গহীন অরণ্যে থাকলে বোধ হয় হিংস্র পশুরা তাদের হিংসা বৃত্তিকে বোধ হয় সংযত করে থাকেন। সর্প, বিছার মতো দংশকপ্রিয় প্রাণীরা ভুলে যান তাদের বিগত দিনের অভ্যাস গুলিকে। কেননা, কোথাও শোনা যায়নি এইসব প্রাণীদের দ্বারা কোন রামায়ণ কিংবা মহাভারতের কুশি-লবেরা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে। অবশ্য মহাভারতে পাণ্ডবদের স্ত্রীকেও একবার জয়দ্রথ হরণ করা চেষ্টা করেছিল কিন্তু সজাগ পাণ্ডবেরা তাঁকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিল। পরপুরুষের স্পর্শের বাড়াবাড়ি মহাভারতে ছিল না, তাই দ্রৌপদীকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়নি। বোধ হয়, মহাভারতের থেকে রামায়নের সমাজ অনেকবেশি রক্ষণশীল ছিল। রামের জীবনে দুর্ঘটনা যখন ঘটেই গেছে তখন সেখান থেকে উদ্ধার পাবার রাস্তাটাও নিজেকেই খুঁজতে হবে। ঘটনাক্রমে, হনুমানের সাথে রামের পরিচয় হলো।
সমগ্র রামায়ণের যেন কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে হনুমানের আগমন। এতক্ষণ পাঠকবর্গ ভীষণ উৎকন্ঠায় ছিলেন, এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে নারীকে হরণ করার মতো অপরাধের মতো ঘৃণ্য ঘটনায়। মানুষ ভীষণ অনুভবপ্রিয়। রামের স্ত্রী হারানোর কাল্পনিক আতঙ্কটা নিজের কোলে অবলীলায় গ্রহণ করে নিজ মনে কৃত্তিম ভয়কে স্থান করে দিলেন।
কি করে সামান্য একটা হনূমান থেকে সঙ্কটমোচনের বিগ্রহ বা আইকন হয়ে গেলেন, সেটাই রামায়নের উৎসাহব্যঞ্জক বিষয়। শক্তি, ভক্তি, বুদ্ধি, পরাক্রম, দূরদর্শিতার মিশেল ছিলেন হনূমান এবং সর্বপরি একটা নায়ক হতে গেলে যা যা দক্ষতা থাকার দরকার, তা হনুমানের মধ্যে ছিল। তাই আজও হনুমান রাম অপেক্ষা আসমুদ্র হিমাচলের মানুষের হৃদয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত বিপদতারিনীর প্রতিমূর্তি , যাঁকে ঘটা কবে প্রতিষ্ঠিত না করেও আপনাগুণে অটল স্থানাধিকারী।
হনুমানকে বহুল প্রচলিত অপারেশন রিসার্চ এবং গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের জনক বলা যেতে পারে। লক্ষ্য যেখানে সীতাকে উদ্ধার এবং যুদ্ধ যেখানে অনিবার্য , সেখানে শত্রুর শক্তি, দুর্ব্বলতা, সুবিধা এবং অসুবিধা কি কি আছে তার যথাযথ অনুসন্ধান। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হনূমান ভীষণ যত্ন করে লঙ্কায় গিয়ে এক এক করে সেগুলি লক্ষ্য করলেন। লঙ্কা সেসময়ে প্রতিরক্ষার জন্য এক প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ছিল, যুদ্ধবিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন তারা। কিন্তু এই যুদ্ধের আদর্শগত দিকটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। রাম যুদ্ধ করেছেন হৃত স্ত্রীকে পুনুরুদ্ধারের মতো নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর রাবনের সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ করবে অনৈতিকতাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে। নীতি ও আদর্শ এমনিই শক্তিমান যে , রাজার যুদ্ধের বহু উপকরণে সজ্জিত অস্ত্রাগার আর সৈন্যবাহিনীর থেকে অনেক বড়ো শক্তিশালী। (সেটি আজও প্রমাণিত। নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছে তার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আছে। )
যে কোন প্রশিক্ষণ, একটা নিয়ম রীতির মধ্যে আবধ্য। ফুটবল খেলতে গেলে সেই ঘেরাটোপের মধ্যেই খেলতে হবে আর সেখানেই জয় পরাজয় নির্ধারিত হবে। সেখানে খেলার নিয়ম অনুযায়ী পা' কে অবলম্বন করে খেলতে হবে, হাতকে ব্যবহার করা যাবেনা। সেদিনও যুদ্ধ করতে গিয়ে ব্যাকারণ মেনেই যুদ্ধ করতে হতো আর ব্যাকরণের বাইরে যুদ্ধ করতে জানতো না। এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হনুমান তার লঙ্কা আক্রমনের ঘুটি সাজায়। রামের ভাণ্ডারে রাবনের মতো অস্ত্র নেই , শুধু আছে মানবশক্তি আর নৈতিকতা। এইটা উপলদ্ধি করে হনূমান সহজ উপলদ্ধ সম্পদ অর্থাৎ পাথরকে অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করল তার মানবসম্পদকে দিয়ে। কেননা উড়ে আসা পাথরকে প্রতিহত করার মতো শিক্ষা সেই সৈন্যবাহিনীর জানা সিলেবাসে ছিল না। এটা ছিল তাদের দুর্বলতা আর হনুমানের সৈন্য বাহিনীর সুবিধা। যুদ্ধ জয়ের পশ্চাতে হনুমানের প্রারম্ভিক বিশ্লেষণ যুদ্ধ জয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। হনুমান ক্রাইসিস ম্যানজেমেন্টের একটা প্রটোকল আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিল। কোন রকম ফ্যাটাল ক্রাইসিস হলে কি করতে হবে। হনূমান যুদ্ধে আহত লক্ষণকে বাঁচাতে গিয়ে হিমালয়ের নির্দ্দিষ্ট অঞ্চলের উৎপাদিত ঔষধির খবরও সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।
ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের চিরন্তন দূরত্ব। আর এই দুইয়ের পার্থক্য নির্নয়ের জন্য কবি মাঝখান দিয়ে বিশাল সাগরকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এই সুগভীর ও সুবিস্তৃত সাগরসম ব্যবধানকে ঘুচিয়ে সমাজে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার মতো কঠিন কাজে মানুষের সংযম ও নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত বানর সেনার একাগ্রতার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছিলো। ধর্মের সাথে অধর্মের ব্যবধান ঘুচিয়ে নৈতিকতাকে প্রতিষ্ঠাই রামায়ণের অন্যতম আবেদন এবং সেটাই ধর্মকে প্রতিষ্ঠা।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ১৬/০৬/২৪ ভোর ৫:০০
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ