(২২০)হস্তিনাপুরের অন্দরমহলে -
ভারতবর্ষ কি এখনো রামায়ন ও মহাভারতময় (ষষ্ঠ পর্ব)
আমি অম্বিকা, কাশীরাজ রাজকন্যা। বেশ ঘটা করে রাজসভায় স্বয়ম্বর সভার আসর বসেছিল। বিবাহ শব্দটি আমার কাছে নারী জীবনের পূর্ণতার অপর নাম। সন্ধ্যা আগত প্রায়; রাজপ্রাসাদের পশ্চিম পারে শান বাঁধানো পুকুরের পাশে স্তব্ধ বাগানটা হঠাৎ পাখিদের কলকন্ঠে মুখরিত হয়ে উঠলো। দিনমনির প্রত্যাগমনের বার্তায় চঞ্চল পক্ষিকুল বাধ্য শিশুর মতো যে যার ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর হয়ে উঠবারই একান্ত প্রকাশ। প্রত্যেক দিনই তারা এমনিই করে থাকে, কিন্তু আজ যেন আমি তাদের আনন্দের আরেকজন ভাগিদার হয়ে গেলাম। এমন এক ভালোলাগার সময়, অন্তঃপুর থেকে দাসী এসে খবর দিল, সব রাজপুরুষেরা প্রায় এসে গেছে, রানীমা ডাকছেন। অলিন্দ দিয়ে রাজমহলের যাত্রা পথে লক্ষ্য করলাম এক অনন্য রাজপুরুষের আগমন। দিব্যকান্তি, প্রশস্ত পাঁজরের খাঁচাটি নয়নাভিরাম বর্ম দিয়ে আবৃত, মনে হলো সবরকমের স্পর্শের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ, কোমরে স্বর্ণখচিত মোড়কে আবদ্ধ বিশাল তরবারি এবং একরাশ তীরের পশ্চাৎদেশ ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মারছে। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠছে আত্মবিশ্বাসের স্পষ্ট অভিব্যক্তি। সব মিলিয়ে তাঁকে দেখে মনে হলো, তিনি যেন কাশীরাজের জঙ্গলে শিকার করতে এসেছেন। কে এই রাজপুরুষ, চলায় বলায় অন্য সবার থেকে অনন্য। রাজসভার ঘোষকের ঘোষণায় জানা গেল, নাম তার দেবব্রত, তিনি কুরু বংশের প্রতিনিধি হয়ে কাশীকন্যাদের তার ভ্রাতৃবধূ করার অভিপ্রায়ে ৫২০ মাইল অতিক্রম করে হস্তিনাপুর থেকে এখানে এসেছেন। অসির ঝংকারে, কাশীরাজের কোন মতামতের অপেক্ষা না করে আমাদের বোনদের নিয়ে তিনি হস্তিনাপুর অভিমুখে যাত্রা করলেন। বেশ লাগছিল, মনে হচ্ছিল এই রাজপুরুষটি কনে পছন্দ করতে আসেন নি, তিনি যেন মৃগয়া করতে এসে বন থেকে হরিণীদের যত্ন করে খাঁচায় পুরে নিয়ে চললেন।
স্বপ্ন বোধহয় কখনও বাস্তবে ফলেনা। তখনকি জানতাম যে হস্তিনাপুরের চিড়িয়াখানায় শুধু মাত্র ভালো ভালো দানাপানি ছাড়া আর কিছুই আমাদের ভাগ্যে জুটবেনা। সম্পর্ক, খাদ্য ও পোশাক তার বিনিময় মূল্যটা ভীষণ সাংঘাতিকভাবে আমাদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল এই সমাজটা। নারী হিসাবে, নিদেন পক্ষে একজন মানুষ হিসাবে জীবনের যাবতীয় স্বাদ-আল্হাদ ও মানবিকবোধ গুলিকে বিসর্জন দিয়ে এক অচেতন প্রাণীর মতো শুধু মাত্র অস্তিত্বকে আঁকড়ে ধরে হস্তিনাপুরের রাজমহলে জীবনের বাকি দিনগুলি আমাকে কাটতে হবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। জীবনের অসম্মাপ্ত শিক্ষা পূর্নতা পেলো স্বামী বিচিত্রবীর্য্য যখন ইহলোক ত্যাগ করলেন। তখন সমাজ কতৃক সন্তানহীনা বিধবা পত্নী থেকে মাতা হিসাবে উত্তীর্ন হবার জার্নিটা নিঃসন্দেহে একটা অমানবিক ঘটনা ।
*****************************
সারাদিন আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে আছে। ঝড় আসার একটা সম্ভাবনা বাইরে তৈরি হয়েছে কিন্তু তার থেকে অনেক বড়ো ঝড়ের ইঙ্গিত আমার হৃদয়ের তন্ত্রীতে এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। জীবনের যে মূল্যবোধ নিয়ে এতগুলি বসন্ত পার করে এসেছি, সে আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। নারী হয়ে জন্মাবার জন্য বিধাতাকে দায়ী করতে একবারও মনের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়নি।
********************************
নিস্তব্ধ অন্ধকার রাতে দূর থেকে আলোর শিখার উজ্জ্বলতা ক্রমেই সামনের প্রাচীরে ছোট থেকে বড় হয়ে প্রতিফলিত হতে লাগলো। সমস্ত ভাবনার সুরগুলি মুহূর্তের মধ্যে যেন সর্বাঙ্গের যৌথ অনুভূতির গভীর আর্তনাদ ক্রমশই দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগলো। বুঝলাম, অনাহূতের আগমনের আর বিলম্ব নেই।
*************************
কি আশ্চর্য! আজ রাতে সেই অবিনস্ত দাড়িওয়ালা অদ্ভুত পোশাকের মানুষটা, না জানি কতদিন স্নান করেনি, মাথায় তার একরাশ উস্কখুস্ক চুলে আবৃত। তিনি আমার শাশুড়ি মাতার অবিবাহিত অবস্থায় মাতৃত্বের ফসল। তাই তিনি সম্পর্কে আমার ভাসুর। আসার হেতু, শাশুড়ি মাতার একান্ত অনুরোধ প্রকারান্তে একরকম আদেশ কিংবা হুমকি বলা যেতে পারে সে আমার অরক্ষণীয়া ও অনুৎপাদনশীল 'ক্ষেত্র'তে 'বীজ' বপন করার দায়িত্ব পালন করবে। শুনেছি আমার ভাসুরমশাই শাস্ত্রজ্ঞ এবং প্রতিষ্ঠিত ঋষি। মাতা সত্যবতীর এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে তিনি নিমরাজি ছিলেন কিন্তু মাতৃআজ্ঞাকে তিনি কঠোর আদেশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন নি, তাই তার আগমন।
******************************
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সমাজের উপরতলার মানুষগুলি নিজ নিজ প্রয়োজনে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে মোড়কটিকে ব্যবহার করেছে, তাকে ধর্মের নাম দিয়ে বাজারজাত করেছে। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যাদের ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের মতামতকে কোনদিন প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।
**********************************
যে কোন সৃষ্টির একটা আদর্শগত দিক আছে। নারী-পুরুষের যৌনজীবনের ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। বিবাহ নামক যে সামাজিক বাঁধন দিয়ে তোমরা নারী-পুরুষের সম্পর্ককে শৃঙ্খলিত করেছো পূর্বেকার লাগামহীন যৌনতাকে প্রাচীর তুলে দিয়ে তাকে রুখতে। তাকেই তোমরা তোমাদের ঘৃণ্য স্বার্থে "নিয়োগ পদ্ধতির " নাম দিয়ে নারীকে বাধ্য করেছে একাধিক পুরুষের অঙ্কশায়িনী হতে।
আসলে, এই সমাজের দরকার মানব সম্পদকে, রাজ্যের দরকার উত্তরাধিকারীর তাই তোমরা নারীকে "ক্ষেত্র" ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারোনি। বীজহীন ক্ষেত্রকে ফেলে রাখা যাবেনা, কারণ সেটি সামাজিক ধর্মের বিরোধী। সমাজের অভিমুখ হচ্ছে সম্প্রসারণ। এই সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যারা বিরোধিতা করবে তার সর্বতোভাবে সামাজিক অপরাধী। আবার অপরদিকে যে পুরুষ প্রজাসৃষ্টিতে অক্ষম, সে সমাজের কাছে দায় ছাড়া কিছুই নয়।"নাবীজী ক্ষেত্রমহর্তি" অর্থাৎ যাহার বীজ নাই সে ক্ষেত্র পাবার অধিকারী নয় অর্থাৎ সে নারী সঙ্গ বিবর্জিত পুরুষ মাত্র। (নারদীয় মনুসংহিতায় তে পরিষ্কার বলা আছে )
*****************************
ইতিমধ্যে সেই মানুষটি আমার ঘরে প্রবেশ করেছে। দীর্ঘ পথশ্রমে ঘর্মাক্ত কলেবরের কটু গন্ধকে প্রমান হিসাবে তাঁর বস্ত্রটি যত্ন করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, দুর্গন্ধ বিতরণের জন্য। বাইরে প্রচন্ড বজ্রের শব্দ আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঝড়ের যোগ্য সঙ্গত। দক্ষিণের জানালা সেই ঝড়ের কাছে আত্মসমর্পন করাতে, ঘরের বাতিও অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পন করলো। প্রকৃতি বোধহয় জানান দিলো, তোমারও মানসিক প্রতিরোধ থেকে মুক্তি দিলাম। ইতিমধ্যে সেই বিশাল আকৃতির শরীরটা ক্রমশই আমার দিকে এগিয়ে আসছে, অন্ধকার ঘর, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘরটা আংশিক আলোকিত হয়ে উঠছে। কিন্তু মনে মনে ভাবছি এই ঝালকানিটা না দিলেও পারতো, তাহলে অন্তত ঋষির আদিম পোশাকের বিভীষিকার সাথে পরিচয়ও হতো না, আমি আর্তনাদ করে সেই যে চক্ষু বুজে ফেললাম। তার পরে যে বাইরের প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে ঋষির বিলম্বিত যৌনতার অফুরন্ত উচ্ছাসের ঢেউ সর্বগ্রাসী ধংসলীলারূপে আমার সর্বাঙ্গে আছড়ে পড়ল।
চলবে ০০০০০০
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ১৮/০৬/২৪ ভোর ৪:৩৮
1 টি মন্তব্য:
Superb writing
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন