(২২২ ) অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো -
ব্যতিক্রমীরা সব সময়ে যে কোন ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। বিরামহীন উষ্ণতাকে গায়ে মেখে যার জন্য সব মানুষ মুখিয়ে থাকে, তার নাম বৃষ্টি। খনিকের অতিথি কিন্তু বেশ তাঁর নাম যশ। প্রকৃতির এই একটা উৎসব, যেখানে বহু রকমের শব্দের ফুলঝুরি একইসাথে মুখরিত হয়। কখন আকাশ থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি আবার কখনো ব্যাঘ্রের মতো গর্জনের গুরু ধ্বনি আর বৃষ্টির তো নিজস্ব ছন্দ আছেই, তার সঙ্গে তবলচিতে যোগ্য সঙ্গত করতে কখন উচ্চগ্রামের ঝড় আর নিম্নগ্রামে বাতাস থাকলে তো কথাই নেই। এই পরিবেশে অকবিকেও কবি হবার প্রেরণা যোগায়।
চিরন্তন বিরহতত্ত্বের অন্যতম রূপকার মহাকবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে বিরহী যক্ষ সেই অলোকাপুরীতে তার প্রিয়ার কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য পুঞ্জীভূত বৃষ্টির অখন্ড রূপ মেঘকে এই বর্ষা উজ্জ্বল শ্রাবন মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা "হাউ বিউটিফুল ইস টি রেইন" লিখবার জন্য এই বহু প্রতীক্ষিত বর্ষাই হয়ে উঠেছিল ভরসা। বিশ্বকবি তো একরাশ গান আর কবিতাকে তো বর্ষার পায়ে নিবেদন করে বসে আছেন। আরো কত কি, তা সীমাহীন।
বেশ ভালো লাগে সেই দর্পক গাছগুলিকে দেখতে, কি অসাধারন সম্ভ্রমে একে অপরের মাথার সাথে মিলেমিশে একবার সামনে আরেকবার পিছনে অবনত হয়ে ঝড়কে সম্ভাষণ জানায়। আবার মনে হয়, অনিয়মিত বর্ষন আর ফাঁকিবাজির কারণে তার অভিভাবক হিসাবে বজ্ৰ আর ঝড়, বৃষ্টিকে বকাঝকা করছে কিন্তু তাঁরা এমনিই অবিবেচক যে উলুখাগড়ার ঝগড়ায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
গ্রীষ্মের আবার ভীষণ বায়না, একবার এলে আর ফিরে যেতে চায় না, তাই তার চাহিদা আমাদের কাছে ভীষণ কম, ঘর জামাই থাকার ভীষণ প্রবণতা। পাখা থেকে শুরু করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র চালিয়ে তাকে আমাদের কাছ থেকে যতই দূরে রাখতে চাই, তবুও সে যে অনাহুতর মতো সেই সব গায়ে না মেখে ঘরের চোকাঠটা পর্যন্ত অতিক্রম করতে চায় না। সবই জীবন্ত মানুষের চিরন্ত্রন যন্ত্রনা।
শীত তো একেবারেই অতিথি, বহু রকমের বায়নাক্কা তার, পশ্চিমে যদি হাওয়া বয়ে যায়, তবে সে এখানে এসে নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে। অসময়ে যদি বৃষ্টি চলে আসে তবে তার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে অর্থাৎ ঝোলা থেকে ঠান্ডা বিতরণও করতে পারে আবার ঝাঁপটাকে আটকে রাখবে বৃষ্টি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত। দুনিয়া জুড়ে 'চাপ' নামক বস্তুটি বার বার বিনা অনুমতিতে আলিঙ্গন করার ক্লেশে আমরা যারপরনাই তার উপর বিরক্ত। তার উপর ঐ যে নিম্নচাপ নামক অস্ত্রটি , মাঝে মাঝে প্রয়োগ করে, আর তার পরোক্ষ প্রভাবে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠে। শীত তো খালি অজুহাত খোঁজে বাড়িতে বসে থাকার। যাও বা আসে, এসেই ফিরে যাবার জন্য ছটপট করে। তাই অগত্যা সেই হতচ্ছাড়া গরমকে নিয়ে বাস করতেই হয়। যেন একটা অলিখিত নিয়ম আছে, তোমাকে যেকোন একটা কালকে নিয়ে বাস করতেই হবে, তুমি সেটা চাও বা না চাও। বোধ হয়, সেটাই আমাদের সময়ের সাথে মানিয়ে চলার অভ্যাসে অভ্যস্ত করার রুটিন অনুশীলন।
মাঝে মাঝে কৃষক যেমন আকাশের দিকে তাকিয়ে মেষের আনাগোনা দেখে বৃষ্টির আগমনী গানের সুরটা উপলদ্ধি করতে চায়, ঠিক তেমনি শেয়ার বাজার ও লক্ষ্য করে , এই মরশুমে বৃষ্টি ভালো হবে তো ? কি অদ্ভুত ! সেটা আবার প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় যোগাযোগের অর্থনৈতিক দিক। আসলে এই অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে সমাজ সংসার অন্ধকার।
বসন্তকালকে আজকাল একদম উপলদ্ধি করা যায় না। মোপাসাঁর সময় ফরাসি দেশে একপ্রকার মাইক লাগিয়ে বলতো, হে প্যারীবাসিগন সাবধান! বসন্ত এসে গেছে। কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে, কে কাকে প্রেম বিতরণ করে বসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, সুতরাং প্রেমের তরীতে ভাসার আগে বসন্তকালেকে একবার যেন স্মরণ করো। যে তোমাকে ভালোলাগার অনুভূতি দিয়ে আগ্রাসী করে তুলবে, ভুলেও যেন পা বাড়িয়ো না পদস্থলন হবার সম্ভাবনা আছে। সে কিন্তু নির্দ্দিষ্ট সময় পার করে সে তার চমকারিত্বকে নিয়ে চলে যাবে কিন্তু তুমি তো বাবা থেকে যাবে, তখন তুমি কি করবে ? সুতরাং আগে ভাগেই সতর্ক থাকা ভালো।
কথাটা হচ্ছিল, অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো আর সে আসার অনুভূতি নিয়ে। আজকের দ্রুতগতির জীবন-যন্ত্রণার ঔষধি খুঁজতে গিয়ে প্রকৃতির রাজ্যের রাম-শ্যাম- যদু-মধু সব এক হয়ে গেছে। আজকে যারা নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ পার করে গেছে, তাদের হয়ত সেই বাল্যকালের প্রকৃতির পরিবর্তনের চেহারা আবছা মনে আছে। আর বর্তমানের শহুরে প্রজন্মদের সাথে বোধ হয় এই প্রকৃতির বৈচিত্রতার সাথে নিবিড় কোন পরিচয় আছে বলে মনে হয় না। যেই অবসরটা সেদিন ছিল জীবনকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম করার, জীবনের সাথে জীবিকার একটা সুপস্ট ব্যাবধান রচিত ছিল। আজ জীবন জীবিকার কাছে আত্মসমর্পন করেছে। অন্তরটা আসলে নিঃসঙ্গ হয়ে যান্ত্রিকজীবনের পূজারী বানিয়ে দিয়েছে।
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ২১/০৬/২৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন