শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

(২২৩) ষড়যন্ত্রের অঙ্কুরোদগম

(২২৩) ষড়যন্ত্রের অঙ্কুরোদগম


ভারতবর্ষ কি এখনো রামায়ন ও মহাভারতময় (অস্টম  পর্ব)  

একটা ষড়যন্ত্রের বীজ থেকে অঙ্কুরিত অসংখ্য শাখা প্রশাখার ব্যাপ্তি  ধীরে ধীরে সমগ্র কাহিনীকে গ্রাস করলো। তার বহু ঘটনার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র অথচ সদূরপ্রসারী অর্থবহনকারী ঘটনা  বারানাবতর জতুগৃহ।  পাণ্ডবদের অস্তিত্ব বিলোপের উদ্দেশ্যে  বহু সাধনায় নির্মিত দুর্যোধনের জতুগৃহ বানানোর চক্রান্ত পান্ডবদের কাছে  ফাঁস হয়ে যাওয়াতে, পাণ্ডবেরা পাল্টা ষড়যন্ত্র করে পাঁচ ব্যাধ পুত্রসহ, তাদের জননীকে নৈবিদ্যের ডালা সাজিয়ে তাদেরই অজ্ঞাতসারে  লেলিহান  আগুনের কাছে  নিবেদন করলেন। ছলনাই ছিল স্বার্থকতার সোপান।  সমাজের অতি নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত  মানুষের এই ছয় ছয়টা প্রাণের বিনিময়ে নিজ পুত্রদের  সুরক্ষা নিছিদ্র করলেন মহাভারতের অন্যতম মহীয়সী নারী কুন্তী। 

আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগের এই অমানবিক ঘটনার সম্মুখীন হয়ে আজকের কাতর পাঠক বর্তমানের পটভূমিতে কাহিনীর বাস্তবতাকে সহজেই অনুমান করতে পারছেন বলে মনে হয়।  ধর্ষিত মানবতা  থেকে উৎসারিত হচ্ছে ধর্মের গূঢ় হেঁয়ালি  ব্যাখ্যা আর তার  আড়ালে আত্মগোপন করে রয়েছে  সেই ধর্ষকরা। এই অসংলগ্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যার ঢালকে সেদিন থেকে বাঁধ দেওয়া হয়নি তাই তার প্রলয় নৃত্য আজও  সমাজ দর্শন করছে ,  সেটা অস্বীকার করার জো নেই। 

সাহিত্য শুধু মাত্র সমসাময়িক কালকেই নির্দ্দেশ করেনা, সে যখন বর্তমানকে ছাপিয়ে আগামীর প্রাঙ্গনে  নিজের জায়গা করে নেয়, সেখানেই তার স্বার্থকতা প্রকাশমান হয়। তাই তো মহাভারত  একাধারে মহাকাব্য, দর্শন এবং হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থও বটে। সেই মহান কবির যে দূরদর্শিতা থাকবেই, সেটা বলাই  বাহুল্য।    দূরদর্শী কবি ব্যাসদেব এই সমাজে সমাজপতিদের প্রাধান্য সর্বসময়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত ছিল তার জ্বলন্ত উদাহরণ জতুগৃহে পাঁচটি ব্যাধ ও তাদের মাতার পরিকল্পিত হত্যা করে অবলীলায় তাকে এক দুর্ঘটনা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে।  শুধু তাই নয়, সমাজ যদি সচেতন না হয়, তাহলে বহু দুর্বল যুক্তির অবতারণা হবে এ ধরনের ধামাচাপা দেবার জন্য।   দীর্ঘদিনের শোষিত শ্রেণী শাসক ও সমাজপতিদের কাছ থেকে এই প্রাপ্যটা পেয়েই আসবে, সেটা তাঁদের কোন অবস্থায় প্রাপ্য ছিল না। 

প্রশ্ন সেখানেই ওঠে যে, চিরকাল নিচুতলার মানুষরা উচ্চাসনে বসে থাকা মানুষদের শিকার হয়ে থাকবে আর  সমাজপতিরা   ধর্মকে চিরকাল  আঁচলে বেঁধে রাখবে। মানবতা, মূল্যবোধ এই সমস্ত শব্দগুলিকে ব্যবহারের যখন সময় উপস্থিত হবে, তখন তাকে যুক্তির বেড়াজালে আবার কোথাও মিথ্যা আর প্রচারের আবরণে সত্যকে আড়াল করে রাখবে। জতুগৃহের মতো  প্রশ্নে, যেমন অন্যান্য শাসকরা একই সাথে গলা মিলিয়ে বলে থাকে - বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং কাহিনীর স্বার্থে পাণ্ডবদের বেঁচে থাকার একান্ত দরকার ছিল,  সেই সব বড় দুর্বৃত্ত কৌরবদের ধংস করবে বলে। এখানে পাঠক প্রশ্ন করতেই পারে একদল বৃহৎ অমানবিক , অত্যাচারী শাসকদের গদিচ্যুত করতে অপেক্ষাকৃত কম অমানবিক শক্তিকে ব্যবহার করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং সেইমতো প্রচার হয়েছে। কিন্তু ঘটনাক্রম সে কথা বলে না, যদি তাই হতো, তাহলে পৃথিবীতে বিভিন্ন মাত্রার   হিংসার প্রদর্শনী হতো না। 

 সামাজিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে  ধর্ম তার চরিত্রগত পরিবর্তন করে থাকে। এটাই বোধহয় ধর্মের গতিশীলতা। হত্যা করা পাপ কিন্তু নিজের আত্মরক্ষার্থে হত্যা করা সেখানে মানুষের আত্মরক্ষা সংক্রান্ত ধর্মের আওতায় পরে।  মূলত রাজধর্মের সাথে মানবধর্মের সংঘাতটা আদর্শগত।  যেখানে মানবধর্মের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা, সেখানে রাজধর্মের ভিত্তি হচ্ছে ছলনা। রামায়ন-মহাভারতের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। রামায়নে বালির হত্যা থেকে শুরু করে মেঘনাদ আর মহাভারতে কৌরবদের সব সেনাপতিদের ছলনার দ্বারা পান্ডবরা হত্যা করেছে।  সুতরাং ব্যবধান ছিল এবং থাকবেই। এই ব্যবধানের দূরত্ব ঘোচাতে একমাত্র মানুষের চেতনাই পারে। 

মহাভারতের অসংখ্য ক্ষতগুলিকে দিনের আলোতে না এনে বরং তাকে রংবে রঙের পোশাকের  আড়ালে ঢাকা রাখা হয়েছে। আসলে সেই লুক্কায়িত ক্ষতগুলি আজ সমাজে  বিশাল বিশাল গহ্বরের আকার ধারণ করেছে, যা সহজে মিটাবার নয়। যা  সমালোচিত হবার দরকার ছিল, তাকে যত্ন করে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আর যা লুকাবার  ছিল তাকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।  

মহাভারতের এই সংঘর্ষ গুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এইটা বর্তমান রাষ্ট্র তথা  সমাজের  জ্বলন্ত সমস্যা। নিম্নরুচিকে আশ্রয় করে সাময়িক পরিত্রান সমাজপতি এবং শাসকের অতি পরিচিত অভ্যাস আর তাকে ধর্মের মোড়কে সত্যকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা।  সেই সমাজপতিদের প্রটোকল অনুযায়ী চণ্ডাল,ব্যাধ, ডোম, মেথর ও অতি সাধারণ মানুষের আঙিনায়  শিক্ষার অনুপ্রবেশ সীমাবদ্ধ করার বাস্তব রূপায়নের ক্ষেত্রে আজও শাসকরা সক্রিয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। কারণ এই অপব্যাখ্যাগুলিকে তারা যেন বুঝতে না পারে। খুব যত্ন করে সেই যুগে  ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্যদের বেদ পড়ানো হতোনা অথচ বেদের রচয়িতারা কখন  সে কথা বলেন নি।  

চলবে ০০০০০০

 ব্লগার -বীন মজুমদার 

তারিখ -  ২২/০৬/২৪   ভোর ০৪:০১ মিঃ 

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...