সোমবার, ২৪ জুন, ২০২৪

(২২৪) বন্দী বিধাতা

 (২২৪) বন্দী বিধাতা 

ভারতবর্ষ কি এখনো রামায়ন ও মহাভারতময় (নবম  পর্ব)  

অনেক যন্ত্রনা, অনেক বঞ্চনা, ক্রমান্বয়ে আশাহতের বেদনার পুঞ্জীভূত হতাশা থেকে একান্তচিত্তে মুক্তির প্রার্থনার জন্য কাঙ্খিত মৃত্যুকে মানুষ আহ্বান জানায়।  কি এমন হয়েছিল, হস্তিনাপুরের  রাজকুমার দেবব্রত থেকে ভীষ্মতে উত্তীর্ন হবার পর ?  দীর্ঘ সময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ইচ্ছা মৃত্যুকে আলিঙ্গন  করতে। আসলে মুকুটহীন ব্যক্তি যত বড় বীর, রাষ্ট্রের অনেক বড় রক্ষকের ভূমিকা পালন করুন না কেন, সম্পর্কের চূড়ায় অধিষ্ঠান করলেও, ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর স্থান একান্তই পিছনের সারিতে, অথচ তিনিই একদিন রাজা - উজির নির্বাচনের কারিগর ছিলেন। সময় কিন্তু কিছুই মনে রাখতে চায় না।  
                        ********************************
সেই সময়ের হাত ধরে যদি একটু পিছিয়ে যাই।  পৌঁছানোর অভিমুখ ভীষ্মের মাতা গঙ্গার সাথে পরিচিত হবার। মহাভারতের সাগরে অনেকে উপনদী এসে মিলে গেছে।। এমনিই এক উপনদী মহারাজ শান্তনু ও গঙ্গার উপাখ্যান। আজকের এই ভরা বিজ্ঞানের স্রোতে অষ্টবসুর কাহিনীকে কল্পলোকের  উজানে চাপিয়ে  তাঁকে টেনে না আনাই শ্রেয়। তবে উপাখ্যান থেকে যা জানা যায়, ভীষ্ম মাতা গঙ্গা কোনদিন হস্তিনাপুরের রাজবাড়ীর গন্ডি অতিক্রম করেন নি।  তার আটটি সন্তান নদীতীরের কোন স্থানে শান্তনু এবং গঙ্গার জৈবিক মিলনের ফলশ্রুতি। একটা জিনিস পরিষ্কার হলো যে, মহারাজ শান্তনু নারীসঙ্গ কামনার  জন্য রমনীদের যে কোন ধরনের অঙ্গীকার করার ক্ষেত্রে তিনি একজন খানদানি  প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী। সামাজিক স্বীকৃতির  অভাবজনিত  কারণে ভীষ্মকে দীর্ঘদিন মাতার অধীনে  থাকতে হয়েছিল।  মাতা গঙ্গার তত্ত্বাবধানে  ভীষ্ম জীবন সংগ্রামের একজন শিক্ষিত সৈনিক হয়ে উঠলেন। বশিষ্ঠ মুনি দিলেন বেদ বেদাঙ্গের শিক্ষা, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী করে তুললেন পরশুরাম আর বহুধারার রাজনীতির পাঠ দিলেন বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্য।  
                            ********************************
 মহারাজ শান্তনুর রমণী মৃগয়ার আদর্শ স্থান সেই নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। তখন মহারাজের যৌবনের সূর্যালোক পশ্চিমপানে ঢলে পড়েছে, গঙ্গার সাথে শান্তনুর চুক্তি ভঙ্গের কারণে  তার নারীহীন জীবনের তৃষ্ণার উপকরণ সাজিয়ে এলেন সত্যবতী। শান্তনুর জন্য রমণীর অন্বেষনে  আমরা বারংবার কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের হাত ধরে বহমান নদীর কিনারে গিয়েছি এবং সেখানেই মিলেছে তার ইপ্সিত ভালোবাসার সন্ধান।  
                        ********************************
 তিল তিল করে ভীষ্মের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ত্যাগের বিনিময়ে যে কৌরব সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল , বহু অপমান সত্ত্বেও ভীষ্ম কৌরব সঙ্গ পরিত্যাগ করেন নি, তার কারণ লুকিয়ে ছিল ত্রিকালদর্শী ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের ভবিষৎবাণীর মধ্যে। বেদব্যাস বুঝতে পেরেছিলেন যে হস্তিনাপুর ক্রমশই তার জৌলস হারিয়ে তাদের উত্তরসূরিদের কারণে সমগ্র দেশটি ক্রমেই অত্যাচারীদের আবাসভূমি হয়ে উঠবে।  এই অন্যায়কে প্রতিরোধ করার  জন্য দুর্যোধন বাহিনীর শত অন্যায় সহ্য করে তিনি হস্তিনাপুর ত্যাগ করেন নি।   
                        ********************************
পাহাড়ের চড়াই উৎরাই অতিক্রম করা আর মহাভারতের ঘটনার মধ্যে পাঠকের পরিক্রমা প্রায় একই কষ্টসাধ্য। সজাগ পদক্ষেপ পাঠক যদি না রাখতে পারে তাহলে পথ হারানোর সম্ভাবনা থেকে যায়।  
                            ********************************
মহাভারতের এই অনন্য চরিত্র ভীষ্মকে আত্মস্থ করতে গেলে তাঁর  দেবব্রত থেকে ভীষ্ম হয়ে উঠা থেকে শুরু করে শরশয্যায় শায়িত হওয়া পর্য্যন্ত যে ঘটনাপরম্পরাকে একটা ক্যানভাসে চিত্রিত না করলে বোঝা যাবে না। 
                       *******************************
 প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতা  তার স্বাভাবিক ছন্দ।  অভিমুখ হচ্ছে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মহাভারতের চরিত্রের বিশ্লেষণ। প্রত্যেক বিষয়বস্তু থেকে সত্যকে উন্মোচিত করতে গেলে বস্তুর শ্রেণী  অনুযায়ী বিশ্লেষেণের নির্দ্দিষ্ট সূত্র আছে। তাকে অনুসরণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। মহাভারত ঐতিহাসিক তথ্য নির্ভর সাহিত্য। যেখানে মানবজাতির ইতিহাস বিশ্লেষণই  প্রাথমিক লক্ষ্য। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে  সমাজ ভাবনা পরিপূর্ন হয়না। যে হেতু মহাভারত একটি সাহিত্য, তাই ঘটনা প্রবাহের আবর্তনে চরিত্রের মধ্যে শ্রেণী বিভক্ত সমাজের শ্রেণী প্রতিনিধিদের কার্যক্রমের বিশেষ গুরুত্ব আছে।  সেখানে অবশ্যিই থাকবে দ্বান্দ্বিকতা তাই বিশ্লেষেণের ক্ষেত্রে বস্তু সম্পর্কিত দর্শনকে আশ্রয় করে এগিয়ে যাওয়া বাঞ্চনীয়। 
                            ********************************
যে অনমনীয়তা  গড়ে উঠেছিল কৈশোর থেকে সদ্য উত্তীর্ন হওয়া যুবক দেবব্রতর মধ্যে , তার কারণ নিহিত ছিল তার পারিপার্শিক বস্তু জগতে। জীবনের শুরুতেই   তিনি বঞ্চিত ছিলেন পারবারিক আস্বাদ থেকে। কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের আঙিনায় পৌঁছে তাঁর রাজপ্রাসাদে অভিষেক।  যে যৌবন অপেক্ষা করছিলো তাঁর ভোগের জন্য, সেই যৌবনকে পিতার পদপ্রান্তে অঞ্জলি দিয়ে  কামার্ত  বৃদ্ধ পিতার  কাঙ্খিত তরুণী ভার্যাকে তার কাছে উপহার দিলেন। অন্তরের ক্ষোভকে প্রতিজ্ঞার যূপকাষ্ঠে অবলীলায় বলি দিলেন জীবনের সব স্বাদ আল্হাদকে, সমগ্র ভূভারতে সমাদৃত হলো সেটি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা নামে।    
                    ********************************
দ্বান্দ্বিক নিয়ম অনুসারে প্রকৃতি ও তার ঘটনাবলীর মূল ভিত্তি হলো বস্তু এবং দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির আশ্রয় ব্যতীত  এই সত্যকে উদ্ঘাটিত করা যায় না। উৎস থেকে একটা বহমান নদী যেমন বহু প্রতিকূলতা, অসংখ্য জনপদ, বহু রকম মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে করতে অবশেষে সাগরে গিয়ে তার যাত্রা শেষ করে।  ঠিক তেমনি সাহিত্যও ভিন্ন পথে বিচিত্রগামী হলেও  যাত্রার অন্তিম পর্বে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে ঠিক তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। 
                        ********************************
 মনের অন্তঃপুরের পরস্পরবিরোধী দ্বন্দগুলি সত্যের  সন্ধানে  পৌঁছে গেলে দ্বন্দ্বের গুনগত পরিবর্তনের ফলে সেটি  মিলনতত্ত্বে পরিণত হয়ে যায়, দুইটি বিন্দু  নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের পর এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়, তখনিই তার গ্রহনযোগ্যতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।  
                            ********************************
 ভীষণ প্রাসঙ্গিকভাবে একটি মৌলিক প্রশ্ন উদয় হয় এই পরিবর্তনশীল জগতে বস্তু না মন কোনটি প্রধান ? বস্তু মনের জন্ম দেয়, না মন বস্তুর জন্ম দেয় ? বস্তু যেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন  করে থাকে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা বস্তুবাদী আর যেখানে প্রথমেই মনের স্থান, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা ভাববাদী। বাস্তবে দুইটি দৃষ্টিভঙ্গিই বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন। বস্তুবাদ বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেয় আর ভাববাদ অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অবতারণা করে। এক একটি চরিত্রের পরিকাঠামো বস্তু জগতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার গুনগত পরিবর্তন ঘটায়।  এটি বিশ্বপ্রকৃতির ক্রমবিকাশের অন্তর্গত  এবং  পরিবর্তনের কারণেই এই বিকাশ।  যিনি এক সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ন হয়ে শত্রু সংহারকে একমাত্র ক্ষত্রিয়চিত ধর্ম  হিসাবে মনে করেছিল, তিনিই আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অস্ত্র সংবরণ করে ক্ষত্রিয় ধর্মের উপর মানব ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্রতী হলেন। আসলে রাজধর্মের সাথে মানবধর্মের বিস্তর ব্যবধান। 
                        ********************************
ক্ষত্রিয়ের অস্ত্র ত্যাগ কি নির্বিকল্প সমাধি ? চিত্তবৃত্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, সেখানে আত্মবোধ, অহংবোধ থাকেনা। যেমনটি ঢেউ জলের মাঝে হারিয়ে যায়, সমুদ্র যেমন ফেনাকে গ্রাস করে ঠিক তেমনি সব জ্ঞান এসে আত্মজ্ঞানে বিলীন হয়ে যায় আর রুদ্ধ হয় চেতনার অধোগতির দ্বার, সে ক্রমেই  উচ্চপানে ধেয়ে যায়। এই হলো বস্তুর বিকাশের উন্নততর বিকাশ। এটাই পরিবর্তনের গতিশীলতা। 
                        ********************************
ভীষ্মের অন্তঃকরণে একই সাথে দুটি স্বত্বা বিরাজমান ছিল।  একদিন যে নেতিবাচক অর্থাৎ যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু সংহার প্রকৃত পক্ষে হিংসার নামান্তর আর ঠিক তার পাশেই ছিল মানবিকবোধ বা অহিংস নীতি যা ইতিবাচক ভূমিকাকে ইঙ্গিত করে। এই দুই পরস্পর বিরোধী মনোভাব যখন একই সাথে মনের অন্দরে বাস করছিল, তখন তো তাকে ঐক্য বলা যেতে পারে।  ঘটনা পরম্পরায় হিংসা-অহিংসা , ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের সংঘর্ষে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জয় হয়ে এক  নতুন সত্তার জন্ম হলো।  এটা বৈপরীত্যের ঐক্য ও সংঘাতের তত্ত্ব।  এখানে  একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেলো, বস্তুর বিকাশ ও পরিবর্তনের কারণের পশ্চাতে মুখ্য কারণ অবশ্যিই  অভ্যন্তরীণ। কর্তব্যের বেড়াজালে আবদ্ধ  ছিল ভীষ্মের আত্মা। চৈতন্যের উন্মেষে  সব বন্ধন থেকে যেই মুহূর্তে তিনি ত্যাগ করলেন, প্রায় সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটলো কৌরব সাম্রাজ্যের। 
  
********************************
 ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -  ২৫/০৬/২৪ 

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...