(২২৬ ) উপলদ্ধি (সাংখ্য এক )
একদিন প্রকৃতি নিদ্রাছন্ন ছিল পরমব্রহ্ম বা চৈতন্যের গভীর আলিঙ্গনে। দিনের ব্যস্ততার পর রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকার শেষে আবার সেই দিন। আর এই একাকিত্ব সহ্য করাটাই অসহ্য হয়ে উঠছে সর্ব শক্তিমান ব্রহ্মার কাছে। এই একাকিত্বের অভাব থেকে জন্ম নিলো সৃষ্টির ইচ্ছা। বাসনার তীব্র দহন কামনা করলো প্রাণের স্পন্দনকে। যেখানে নিঃসঙ্গ পুরুষ বা পরমব্রহ্ম শুনতে পারবেন নিস্তব্ধতা ভাঙার গান। যেমনটি ইচ্ছা, ঠিক তেমনটি কাজ।
শুরু হলো তার পথ চলা। ব্রহ্ম তাঁর নিজ অংশ থেকে প্রথমেই সৃষ্টি করলেন প্রকৃতিকে। সে বড়োই স্পর্শকাতর। পুরুষের স্পর্শে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হলো প্রকৃতির চৈতন্য আর তার প্রভাব গিয়ে পড়লো তাঁর দেহ ও মনে। স্বাদে,গন্ধে, বর্ণে, শব্দে, স্পর্শে তার তন্ত্রীতে বেজে উঠলো জীবনের গান বিকশিত হলো সৃষ্টির বিজয়কেতন ।
সেই প্রাণের মধ্যে আবার গভীর নিদ্রায় আছন্ন ছিল অতীব চঞ্চল ত্রিগুন। স্পর্শের অভাবিত ক্রিয়ায় জাগ্রত হলো প্রকৃতির কোলের সেই ঘুমন্ত শিশুরা, যাঁরা পরিচিত সত্ত্ব, রজ ও তম নামক ত্রিগুনে। এসেই তাঁরা চঞ্চল হয়ে উঠল, কে অধিকার করবে প্রাতিষ্ঠানিক দেহের অন্তস্থলের মনের আসনটি। স্বভাবতই, পূর্বেকার যে সাম্যাবস্থা বিরাজ করছিলো, সে এই প্রচন্ড কোলাহলের অপরিসীম মাত্রাকে সহ্য করতে না পেরে বিদায় নিলো আর সেই স্থান দখল করলো অসাম্য। ঠিক যেমনটি জাগ্রত অবস্থায় ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় যারপরনাই আন্দোলিত হয় মনের অন্দরের শান্তসিস্ট দীঘির জল। এক একটি ঢিলের সমান এক একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্য। আবার নিদ্রার সময় সব শান্ত।
পরিমিতির গন্ডি পেরিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় এই ত্রিগুণের অসম ব্যবহারে যে বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশে আশঙ্কিত হলো সবে শৈশবের গন্ডি পেরোনো মানব সমাজ। শুরুতেই যেন অশুভ সংকেত। ভাবী আশঙ্কায় ব্যথিত হল সেই মানবদের আত্মা যাঁরা দীর্ঘ সাধনার দ্বারা চৈতন্যের আলোতে অবগাহন করেছেন। সাধারণ মানুষ ত্রিগুণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞান। একান্ত ইন্দ্রিয় নির্ভর যে সাময়িক উন্মাদনায় বিভোর মানবকুল হয়তো সাময়িক আনন্দ পাচ্ছে কিন্তু তার পরিবর্তে আগামী দিনে এক সীমাহীন দুঃখ যে অপেক্ষা করছে, সেটা তাদের কাছে অজানা।
মোহময় প্রকৃতি, চারিদিকে তাঁর অপূর্ব বৈচিত্রপূর্ণ সম্ভার ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সব বস্তুর গ্রহনযোগ্যতা সমান নয় কিন্তু বাইরের মনোহর রূপটার হাতছানিকেও অস্বীকার করা যায় না। যে সেটা জানে তার কাছে অশনি সংকেত কিন্তু যে জানে না তার ব্যবহারে কি হতে পারে, সে তো পাবার জন্য ব্যাকুল হবেই। এই চঞ্চল মনের অপার আকাঙ্খা আর তার প্রাপ্তি থেকে একদিকে ভোগের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং চুড়ান্ত ভোগের উচ্চতায় উঠে ক্রমবর্ধমান অনীহার মাত্রা বৃদ্ধি, আবার অন্যদিকে ভোগ্য বস্তুর না পাওয়ার বেদনা। এই দুইয়ের টানা পোড়েনে মানব জীবন থেকে সাময়িক সুখকে হয়তো স্পর্শ করতে পারবে কিন্তু শান্তির স্বর্গপ্রাপ্তি যে ঘটবে সেটি সন্দেহাতীত।
এমতাবস্থায়, ঋষিগণ নিজ অন্তরের গভীরতম প্রদেশে এর উপায় অন্বেষনের লক্ষ্যে যে সাধনায় অভিনিবেশ করেন , সেখান থেকে যা কিছু উপলদ্ধি হয়েছিল সেটাই ছিল তাদের জীবন দর্শন এবং দুঃখের কারণকে জানা ও নিবারণের উপায় নির্ধারণ। সেই দিনের সত্য দর্শনই কালের হাত ধরে আজ আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে।
******************************
প্রত্যেক দর্শনের একটি অভিমুখ থাকে, তাকে কেন্দ্র করে বহু উপধারা আবর্তিত হয়। একে একে সেই উপধারা বা ধাপগুলি সার্থকতার সাথে উত্তীর্ন হলে তবেই সেই শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব হয়। পথপ্রদর্শক এবং পথের দিশার মানচিত্র না থাকলে সে পথে যাত্রা অসম্ভব। এই লক্ষ্যে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা অবিরাম প্রাণপাত করে মানব সমাজের কাছে সেই সম্পদ তুলে দিয়েছেন। সেই সম্পদ লাভের যজ্ঞে উৎসর্গ করেছিলে তাদের জীবনের তথাকথিত সুখ-আনন্দকে। এই আত্মত্যাগের পরিবর্তে চেতনার গভীর স্তর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল সেই পরম সত্যের মন্ত্রকে।
**********************************
অন্তরে অন্তর মিলালে যার অন্তরের পরিচয় পাওয়া যায়, তাকেই তো উপলদ্ধি বলে। তাই এই অন্বেষণ কোন বাহ্যিক জগতে নয় , সেই গানের স্বরলিপিগুলি খালি চোখে পড়া যায় না, সে থাকে অন্তরের গহীন প্রদেশে, যেখানে বহু মোড়কের অন্তরালে সেই অনন্ত বাস করে। সেখানে থেকেই অবিরাম সংকেত আসছে মানবের অন্তরাত্মা জন্মলগ্ন থেকে ত্রিবিধ দুঃখের হাতে বন্দী।
*******************************
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ২৭/০৬/২৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন