শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪

(২২৭) মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৭)

(২২৭) মহাভারতের যাজ্ঞসেনী (৪৭)


জীবনের দীর্ঘ পথ যাত্রায় ক্লান্ত পথিক, ক্ষনিকের পার্থিব সুখ-দুঃখের সাথে যাপন করে অবশেষে আমরা যাত্রা শুরু করলাম মহাপ্রস্থানের পথে।   পঞ্চপাণ্ডবের সাথে  সেই যাত্রার সাথী , আমি পাঞ্চালী । যাত্রার প্রাক্কালে, ভীষণ ইচ্ছা করলো জীবনটাকে একটু ফিরে দেখতে। 

আজ জীবনের অন্তিমলগ্নে, বলতে কোনো অসুবিধা নেই আমার জীবনের সাংসারিক পর্বটা   আরম্ভ হয়েছিল এক  ভীষণ ঝড়ের সমারোহে। যাঁর আঘাতে  বিবাহিত জীবনের চির পরিচিত স্বপ্ন  ভেঙ্গে গেছে কিন্তু দিয়ে গেছে একরাশ বৈচিত্রময় ঘটনার সমারোহ। কখনো দিনের শেষে দেহটা আলিঙ্গন করেছে সুদৃশ্য পালঙ্কের বিছানায় ঐশী আরামে, আবার নিয়তির হাতছানিতে দিনরাত কেটে গেছে অনন্ত আকাশের কোলে।  সেখানে রাতে পাহারা দেয় কত নাম না জানা  তারারা,  আর পালা করে চাঁদ আসে যায়। না জানি কতনা মেঘের সারি আকাশ পথে আমাদের দেখতে দেখতে উড়ে যায়। হয়তো তাঁরা  আমাদের মতো ভাগ্যহীনাদের সংবাদ বয়ে নিয়ে যায় সেই স্বর্গের অলিন্দে,  শুনেছি সেখানে একদল দেবতা ভাগ্য আর দুর্ভাগ্যকে বন্টন করে পাঠায়। দিনের সূর্য্যের প্রখর তেজ থেকে নিবিড় শান্তি এনে দেয়  সুউচ্চ গাছের অসংখ্য বাহু সম্বলিত পাতার দলেরা।  পাহাড়ের ঝর্ণার জল অব্যাহতি দেয় তৃষ্ণাকে  আর নদীর জলে অবগাহন করে তৃপ্ত হয় দেহ-মন। 

ক্রমেই এক  অদৃশ্য শক্তির ইশারায়  আমি ধাবিত হচ্ছিলাম এক অজানা পথে।  কালের সেই যাত্রা পথে এক অনুগত যাত্রী আমি,  সারা জীবন ধরে শুধু তাকেই  অনুসরণ করে গেছি । সে পথে লাঞ্চনা ছিল আমার নিত্য সঙ্গী আর সর্বাঙ্গে আলিঙ্গন করে ছিল অপমানের মধুর পরশ। জীবনের যাত্রা পথটা কে যেন, মুড়ে দিয়েছিলো ছোট বড়ো সব কণ্টকের নুড়ি দিয়ে।  নারী জীবনের সীমিত পরিসরে সে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছিলাম। 

মনে আছে, যেদিন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব মহাভারতের পাঠকদের কাছে আমার প্রথম পরিচয় করে দিয়েছিলেন। ঋষির ছিল লেখনীর  স্বাধীনতা,  সেই ক্ষমতার সুযোগ্য ব্যবহারে আমাকে চিত্রিত করেছিল এক অযোনীজাত কন্যা হিসাবে,  যে  ধূমায়িত যজ্ঞের অগ্নি থেকে উঠে এসেছে এবং পদার্পন করেছে মহাভারতের পাদপ্রদীপে।  তাই কেউবা আমাকে যাজ্ঞসেনী বলেও সম্বোধন করে।  

বহুধা বিভক্ত এই ভারতবর্ষে স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নে অত্যাচারিত জনসাধারণ আশায় বুক বেঁধেছিলো ,  এই অগ্নির থেকে উঠে আসা নারী, তাদের  জীবনযন্ত্রনাকে  লাঘব করে দেবে। জীবনের অন্তিম লগ্নে হয়তো বা দিতে পেরেছি কিন্তু তার বিনিময়ে আমি সেই গরল বিষের তীব্র জ্বালাকে আমার জীবনের সঙ্গী  করেছি। 

জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা আমার তৃতীয় পাণ্ডবকে ঘিরে।  বাকি ছিল  যাবতীয় প্রতিকূলতার সাথে মানিয়ে নেবার অভ্যাস। যে সবরকমের পরিবর্তনশীলতার মাঝে এক মাত্র অপরিবর্তিত বিষয় ছিল,  সেই নারী জীবনের চিরন্তন সহনশীলতা।  রাজপরিবারের  জন্ম , বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলিতে একটি অলিখিত সূচি থাকতো, তা হলো রাজনীতি।  আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বয়ংবর  অনুষ্ঠান  হবার আগেই পাত্র নির্বাচন হয়েই গিয়েছিলো। ঋষি ব্যাসদেব ঘন ঘন পাঞ্চালে  এসে পিতার সাথে রাজনৈতিক আলোচনার ফাঁকে কৌরবদের সাথে যুদ্ধের  পরাজয়ের গ্লানিকে দূর করার জন্য পাণ্ডবদের মতো শক্তিশালী পক্ষের সাথে  আত্মীয়তা করার কথা বলতেন। সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার একমাত্র মাধ্যম ছিলাম আমি আর সঙ্গে ছিল আমার রূপ ও যৌবন। তাকে এই স্বয়ংবর সভায়  আহুতি দেওয়ার মধ্যেই সেই  সার্থকতা লুকিয়ে ছিল। যদিও অর্জুনকে মনে আমার ধরেছিলো , তবুও  আমার পিতার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য  এই পূর্বনির্ধারিত পাত্র নির্বাচন করে হাস্যকর স্বয়ংবর সভার আয়োজন ছিল একধরনের অনৈতিক অনুষ্ঠান। 

যেই সমাজ স্ত্রীকে ধন-সম্পত্তির সাথে একাকার করে ফেলে, সেখানে যৌথ পরিবারে  সেই অর্জিত সম্পত্তির উপর অন্যান্য সদস্যদের যে মালিকানা থাকবেনা , সেই ভাবনার কোন অবকাশ নেই।  পাঞ্চাল কন্যা  দ্রৌপদী তো তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।   নিয়মরীতি  মেনে নারী নামক ক্ষেত্রকে তারা সাম্যবাদী কায়দায় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলো অর্জিত প্রসাদ হিসাবে। আমি তাদের কাছে  একটি উর্বর জমি ব্যতিরেকে আর কিছুই নৈ। তাছাড়া, আমি  সব ভাইদের চোখেমুখে মদনতূণে  আহত প্রাণীর প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছিলাম। অবশ্য আমার ঐশর্য্য ও বুদ্ধিমত্তাকে তাঁরা স্বীকার করেছিল কিন্তু, পুরুষের আধিপত্যের মোহ থেকে প্রথম পাণ্ডব বেরিয়ে আসতে পারেননি, তাই আবার আমাকে সম্পত্তি  জ্ঞানে পাশা খেলায় বাজি রেখে দিলেন। 

কি আশ্চর্য্য ! পান্ডব ভ্রাতাদের এই ঘূর্ণিয়মান পদ্ধতির বেড়াজালে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। আমার কাছে যেটা ছিল নিত্যদিনের শারীরিক গঞ্জনা আর অপেক্ষামান অন্যান্য ভ্রাতাদের কাছে ছিল একটা দীর্ঘ  প্রতীক্ষার অবসানে আবার নব আনন্দে জেগে ওঠার বাসনা।  যে নারীর  নির্যাতন প্রকাশ্যে কুরু রাজসভায় হয়েছিল তার জন্য  সমাজ তার নিন্দা করেছিল। কিন্তু অন্দরমহলে  লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে মানুষের ইচ্ছার বারংবার মৃত্যু হয় তার  নিন্দা কে করে ? সমাজপতিরা সব বুঝেও চক্ষু মুদ্রিত করে থাকে। 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -  ২৯/০৬/২৪ 

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...