(২২৮ ) শাশ্বত (সাংখ্য দুই )
আপনারে দীপ করি জ্বালো / আপনার যাত্রা পথে আপনিই দিতে হবে আলো।
বর্তমান ভারতবর্ষে ধর্ম নিরপেক্ষতা যখন সংকটে, তাই আরো বেশি করে ভারতীয় দর্শনের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য উজানের একটি ধারাবাহিক প্রয়াস ।
বহু ধারা, উপধারাকে সঙ্গে করে নদী মহাসাগরে এসে তার যাত্রা পথ সমাপ্ত করে। ঠিক তেমনি সৃষ্টি তত্ত্বের ব্যাখ্যার প্রসঙ্গে মূল তত্ত্বের গোড়াতে পৌঁছাতে গিয়ে ছোট ছোট অসংখ্য তত্ত্বের অবতারণা সাংখ্য দর্শনকে করতে হয়েছে। "সৎ কার্যবাদ" -সে রকমেরই একটি সমর্থনকারী তত্ত্ব।
সাংখ্য দর্শন সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন, আদি পুরুষ হলেন ব্রহ্মা এবং তার ইচ্ছা হলো সৃষ্টি করতে তাই তিনি নিজেকে খণ্ডিত করে তার নামকরণ করলেন প্রকৃতি। এই পুরুষ বা চৈতন্য ও প্রকৃতির সম্মিলিত প্রকাশিত সত্তা হলো বস্তু। উপযুক্ত প্রমান ছাড়া মানব সমাজ কোন তত্ত্বকে গ্রহণ করবে না। এটাও প্রমাণিত যে কারণ ছাড়া কোনো কার্য্য হয় না। তাহলে, বিচার বিশ্লেষণের মূল সূত্র হলো কার্য্য এবং তার কারণের সম্পর্ক। বাস্তবতা হলো কার্য্যকে দেখা যায় কিংবা অনুভব করা যায় কিন্তু তার পশ্চাতে যে কারণ লুকিয়ে থাকে, তাকে কখনো প্রতক্ষ্য করা যায় না। দর্শনের মূল ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বহু ছোট ছোট তত্ত্বের অবতারণা করা হয়েছে। তার মধ্যে "সৎ কার্যবাদ" এমনি একটা তত্ত্ব। আরেকটু ভেঙ্গে বললে, সৎ এই শব্দটি নির্দ্দেশ করে যে বস্তু আছে এবং সে জ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ হয় তাই তার নাম সৎ। সৎএর বিপরীত শব্দ অসৎ। মাটির অবস্থান্তরের নাম ঘট। মাটি হচ্ছে কারণ আর ঘট হচ্ছে কার্য্য। এই ঘট নামক কার্যের পিছনে কিছু নিমিত্ত থাকে, যেমন, কুম্ভকার ও তার চক্র ইত্যাদি , তাই এইগুলিকে নিমিত্ত কারণ বলে। তার কার্যবাদ বলতে বোঝাচ্ছে তার কর্ম অর্থাৎ সে যে প্রকাশিত হচ্ছে তার প্রভাব।
প্রকাশমান কে হচ্ছে ? প্রকাশিত হচ্ছে বস্তু , যে পূর্বে অব্যক্ত ছিল এবং চৈতন্যের পরশে সে তার পূর্ব অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। পূর্বে সে সৎ অর্থাৎ তার অস্তিত্ব ছিল অথচ তাকে প্রত্যক্ষ করা যেত না দৃষ্টি শক্তির অভাবে, সেই অভাব পূরণ করলো চৈতন্য, তাই তাঁকে দেখা গেল। তাহলে কারণের অন্তঃপুরে কার্য্য নিদ্রিত ছিল অর্থাৎ বস্তু সুক্ষ অবস্থ্যায় ছিল। যেমন, দুধ থেকে দই হয়, দই নতুন কোন সৃষ্টি নয়, সে দুধের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থ্যায় ছিল, পরে দই রূপে ব্যক্ত হল। প্রশ্ন হচ্ছে, দইয়ের উপাদান আগে থেকে যদি কারণের মধ্যে বসবাস করে , তাহলে কার্য্যের কি প্রয়োজন পরে ? এর উত্তরে দর্শন বলছে অব্যক্ত কার্য্য ব্যবহারের পক্ষে উপযোগী নয় বলে। এইখানে সৎ-কার্যবাদের প্রথম রূপ অর্থাৎ পরিনামবাদের নিয়মানুসারে কারণ থেকে কার্য্য হয়েছে। যেমন, মাটির বিবর্তিত রূপ ঘট এবং সে জল আনার ক্ষেত্রে উপযোগী, কিন্তু মাটির সেই যোগ্যতা নেই। আবার যখন রাত্রির বেলায় ভুলক্রমে রজ্জুকে সর্প বলে ভুল করি কিন্তু যেহেতু রজ্জু সর্পে পরিণত হয়না, সেটি হল বিবর্তিত রূপ আর যদি রজ্জু সর্পে পরিণত হতো তাহলে তাকে বলা হতো সেটি পরিণামবাদের লক্ষণ। তার মানে হচ্ছে কারণ আর কার্যের মাঝখানে আরেকটা একটা শব্দ লুকিয়ে আছে, সেটি হলো বিবর্তন। সৎ-কার্যবাদের দ্বিতীয় রূপটি হল বিবর্তবাদ।
*******************************
প্রত্যেক শাস্রের নিজস্ব বাধা ধরা গন্ডি আছে। মানুষেরও নির্দ্দিষ্ট বুদ্ধির সীমারেখার মধ্যে যা কিছু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে দেখা যায় বা জানা যায়, তাকে "দৃষ্ট" শ্রেণীতে চিহ্নিত করেছে। আর যাঁর জন্য বেদের সাহায্য নিতে হয় অর্থাৎ পরোক্ষভাবে জানা তাকে "অদৃস্ট" শ্রেণীতে ভূষিত করেছে এবং বেদকে গ্রহণ করার জন্য সাংখ্য দর্শনকে আস্তিক পৰ্য্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। সাংখ্য দর্শন বস্তুর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ও অনুমান ছাড়া দর্শন শাস্রের প্রমান ছাড়া বেদবাক্যকে সংযোজিত করেছে।
********************************
এই বস্তুজগতে কি কি কারণে বস্তুকে নিত্য পৰ্য্যায়ভুক্ত করা হবে এবং কি নির্দিষ্ট কারণ থাকলে অনিত্য বলা হবে, সাংখ্য দর্শন রূপরেখা চিহ্নিত করে তার সাথে যুক্তির অবতারণা করেছেন।
একটি মানব শিশু হয়ে জন্মায়, সময়ের সাথে সাথে যৌবনকে অতিক্রম করে বৃদ্ধ হয় অবশেষে সেই নশ্বর দেহটাকে পৃথিবীতে রেখে আত্মা তার পূর্বতন স্থানে ফিরে যায়। এটা বস্তুর পরিবর্তনশীলতার ধর্মের কারণে হচ্ছে এবং প্রকৃতির রাজ্যে যা কিছু আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করি, তারা সবাই এই পরিবর্তনের অধীনে। জন্ম নিজেই মৃত্যুর অধীন। মৃত্যু যদি অস্তিত্বের অস্তিত্ব বিলোপ হয় তাহলে সে তো অনিত্য বস্তু, তাহলে মানুষের ভিতরে যেই আত্মা বাস করছিলো, তারও কি লোপ হয়েছে ? এখান থেকে বিতর্কের সূত্রপাত। যে দেহ পঞ্চভূতের উপাদান দিয়ে তৈরি [ অর্থাৎ ১) ক্ষিতি- যে গন্ধ তন্মাত্র এবং আমরা তাকে নাক বলে জানি ; ২) অপ- রস তন্মাত্র যার মাধ্যমে স্বাদ গ্রহণ করি সেই জিহবা ; ৩)বায়ু - কারণ স্পর্শ তন্মাত্র, যে বায়ুকে উপলদ্ধি করতে শিখায় সেই ত্বক ; ৪) তেজ- রূপ তন্মাত্র, যার দ্বারা প্রত্যক্ষ করে থাকি সেই চক্ষু ; এবং ৫) আকাশ- কারণ শব্দ তন্মাত্র, যে ইন্দ্রিয় সেটা গ্রহণ করে সেইতো কান। ] সে তো ধংস হয়না, তার রূপান্তরিত হয়, তাই তাকে আপাতদৃষ্টিতে অনিত্য বললেও তার মধ্যে নিত্য গুণ বর্তমান।
এই পঞ্চভূতকে আমরা জ্ঞানের মাধ্যমে গ্রহণ করি। জ্ঞানের চরিত্র অনেকটা অগ্রগামী ঢেউয়ের মতো, একটা ঢেউ ভাঙ্গলে অপর একটা ঢেউ এসে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানটা দখল করে। নয়ন যখন মেলে ধরে তখন সে অনেক বস্তুর সমারোহ প্রত্যক্ষ করে, আবার চোখ বুজলে সব হারিয়ে যায়, মনের মধ্যে রেখে যায় তার স্মৃতি। জ্ঞান আসলে ক্ষনিকের, কিন্তু তার ধারাবাহিকতা নিরবিচ্ছিন্ন। তার ফলে, একটি জ্ঞান অপর জ্ঞানকে এমনভাবে প্রভাবিত করে তাতে করে আরেকটি মিশ্র ক্ষনিকের জ্ঞানের জন্ম দেয়।
যে জগতে প্রত্যক্ষ সব বস্তু যেহেতু চৈতন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেনা,তাই তারা জড়বস্তু এবং চারদিকে সেই একই ধরনের বস্তুর সমারোহ তাই দৃশ্যমান জগৎটা জড়জগত। এই জড়জগতটা সদাই পরিবর্তনশীল বলে সে অনিত্য পৰ্য্যায়ভুক্ত। অধ্যাত্মজগতে জ্ঞান ও তার ধারাবাহিকতার বাইরে যাঁকে আমরা সর্বক্ষণ উপলদ্ধির মাধমে প্রত্যক্ষ করেছি সেই পরমাত্মাই হচ্ছে অপরিবর্তনীয়, এবং সেই কারণে তিনি নিত্য।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ০১/০৭/২৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন