(২২৯ ) সংবেদন (সাংখ্য তিন )
গত সংখ্যার নির্যাস -
বেদান্তের ব্যাখ্যায় পরমাত্মাকে একমাত্র নিত্য বস্তু হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, সাংখ্যের মত কিন্তু একাধিক এবং সেই একাধিক কারণের জন্যই এই দর্শনটি সাংখ্য দর্শন হিসাবে পরিচিত। দ্বান্দ্বিকতা সৃষ্টির অন্যতম ধর্ম , গ্রহণ যোগ্যতার ক্ষেত্রে তার কোন ব্যতিক্রম নেই। এই জগৎ সংসারে খোঁজ তারই পরে যাঁর একান্তই অভাব। অনন্তকাল ধরে সেই সুখের অভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে জগৎ সংসারে, সহৃদয় কিছু মহামানব তারই অন্বেষণে সাঁতরে চলেছে সেই জটিলতায় ভরা দুঃখের সাগরের অপরপাড়ে যেখানে সুখই একমাত্র বিরাজমান। সেই সুখ-শান্তিকে পরম আল্হাদে বিতরণ করছে এই দুঃখভরা জগতে, তাদেরই অসীম ভান্ডার থেকে সংগৃহিত কিছু ঝলক।
* * * * * * * * * * * * *
ক্ষণে-ই দেখা , ক্ষণিকের জন্য তাকে পাওয়া, তাৎক্ষণিক তাঁকে আপন মনের গহন কোণে আশ্রয় দিয়ে আবার তাকেই হারিয়ে ফেলার এই ধারবাহিক বেদনা , এরা মানব মনের স্থায়ী বাসিন্দা আর সঙ্গে আছে সুখ আর অসুখের চলমান অনুভূতি। চোখ খুলেই চারিদিকে কতনা বস্তুর সমারোহ আবার আঁখি মুদিলে তাঁরা চেতনার রাজ্য থেকে বিদায় নেয়, তখন নেই কোন ইন্দ্রীয়ের পীড়ন, নেই আর কোন মিশ্র অনুভূতি , তাই তখন নিখিল বিশ্ব নিঝুমপুরী আর সেখানে অপার শান্তি, মাত্র সেই সময়টুকুর জন্য প্রকটমান। আবার পুনরায় জাগরণ, আবার সেই পরিবর্তনকামী বস্তুর সাথে মেলামেশা আর ভাবনার আকাশে ভাসমান মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি। একসময় একরাশ মিশ্র অনুভূতি নিয়ে জীবন খাতার অমীমাংসিত হিসাবের খাতার পাতায় পাওয়ার অংশ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত মনের নীরব সমর্পন দুঃখের বালিশে আর শুয়ে শুয়ে মন এখনো অপেক্ষমান সেই সুখের আমন্ত্রনের আশায়।
* * * * * * * * * * * * *
আমরা বাস করি সেই বস্তুময় জগতে, যাঁর চারপাশে বহু বস্তুর সমারোহ, তার মধ্যে কেউবা নিত্য আবার কেউবা অনিত্য, তাঁরা সব জ্ঞানের পরশে জাগ্রত আবার অজ্ঞানের কারণে অজ্ঞাত। অনিত্য যাঁরা মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল, তাঁদের যদি একবার চিহ্নিত করা যায়, তাহলে সেই অপরিবর্তনীয় যা নিত্যবস্তু, তাঁকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এই পথ ধরে দীর্ঘ সাধনায়, ভারতীয় দর্শন কারণ খুঁজতে চেয়েছে মানবসংসারে দুঃখকে।
* * * * * * * * * * * * *
মূল পর্বকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপের ন্যায় বেশ কিছু একান্ত প্রাসঙ্গিক পর্ব, যাঁদের নিয়ে গঠিত হয়েছে মানব সংসারের দুঃখের সাম্রাজ্য। দুঃখকে জানলে, তবেই তাকে জয় করা সম্ভব। তাঁর ওপারেই তো সুখের রাজ্যে। জানা আর অজানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জ্ঞান। শত্রু চিহ্নিত তো হয়েছে, সেতো বহু যুগ ধরে মনের কোঠায় বাস করছে; সে আর কেউ নয়, সে আমাদেরই নিত্য সঙ্গী অজ্ঞান। আর এই জ্ঞান কতখানি সমৃদ্ধ হলে অজ্ঞান থেকে সে সজ্ঞানে পরিণত হবে, তারই জন্য বস্তু সম্পর্কিত বিচারই একমাত্র পথ। সেই পথকে অতিক্রম করতে হবে, সেখানে আছে বহু দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যার সমারোহ, তীব্র বিচার-বিশ্লেষণের ঘনঘটা। সেখানে বিচারকের আসনে বসে আছে মানুষের জ্ঞান আর তাকে পদে পদে কখনো সমৃদ্ধ করেছে আবার কখন আছন্ন করেছে সেই ইন্দ্রীয় তার পঞ্চভূতকে [১) ক্ষিতি-গন্ধ ; ২) অপ- রস ; ৩)বায়ু - স্পর্শ ; ৪) তেজ- রূপ ; ৫) আকাশ- শব্দ] সঙ্গে নিয়ে।
* * * * * * * * * * * * *
" যৎ সৎ তৎ ক্ষণিকং "- এই জগৎ সংসারে জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নেই। বড্ডো স্বল্প সেই জ্ঞানের অধিষ্ঠান, যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার মতো। তাই সে অলীক এবং ক্ষনিকের। যে জ্ঞানের বাতাবরণে অহংয়ের আবির্ভাব , যেখানে অতীতকে জ্ঞান করে, বর্তমানকে সঙ্গে নেয় আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর সবাইকে নিয়ে এক ধারাবাহিকতাকে বহন করে চলে , একটা অবিচ্ছন্ন স্রোতের মতো, সেইতো মানব সংসার। একটা অনিত্য জ্ঞানের কাজ সম্পন্ন না হোতে হোতে ঠিক ঢেউয়ের মতো আরেকটি অনিত্য জ্ঞান পূর্বেকার জ্ঞানকে আশ্চর্য্যমণ্ডিত করে এক মিশ্র জ্ঞানের অনুভূতির সঞ্চার করে। যে পদার্থ বা বস্তু বারংবার পরিবর্তনের নিয়ম অনুসারে চলে, সে নিত্য বস্তু হতে পারেনা, তাই বেদান্তবাদীরা বলেন আত্মা ছাড়া এই পৃথিবীতে নিত্য বস্তু আর দ্বিতীয়টি নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন