৩২১ পরিবর্তনের পরিবর্তন-- চতুর্থ খন্ড
৩২১ পরিবর্তনের পরিবর্তন-- চতুর্থ খন্ড
(একটি সময়োপযোগী বিশ্লেষণধর্মী গল্প )
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর বামপন্থী অরিন্দমের আত্মবিশ্লেষেণ - তৃতীয় খন্ডের পর ,,,,,,,,,,
কিছুক্ষন ধরে লোডশেডিং চলছে। ঘরে তখন হালকা আলো বিচরণ করছে, অনেকটা অংশই অন্ধকার জুড়ে বসেছে। সুচেতা হারিকেনের আলোটা জ্বালিয়ে দিলো। আর সেই অন্ধকারে প্রবালদার চাহনিটা দেখে মনে হলো কিছু একটা খুঁজছে।
বিপ্লবের সাথে আধ্যাতিকতার বিলক্ষণ যে একটা যোগসূত্র আছে, সেটা এই প্রথম শুনে সবাই বেশ হতচকিত হয়ে গেলো। অবশ্য প্রবাল দা একসময় হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং শিক্ষকের বেশ শ্নেহধন্য ছাত্র ছিলেন।
নিঃশব্দতা ভাঙার জন্য সুচেতা বলল - "আপনি ভারতীয় দর্শনের অদ্বৈত বেদান্তের কথা বলছিলেন কিন্তু রাজনীতি বা সমাজতন্ত্রের সাথে কখন সে সম্পর্ক যুক্ত হয়ে উঠল আর পরিবর্তনের সাথে সে কিভাবে জড়িয়ে পড়লো, সেটা যদি একটু ভেঙ্গে বলো।"
প্রবাল প্রশ্নটা শুনে মৃদু একটু হেসে বলল - "তোমরা যাই বল ভাই, এইটা আমি জীবন দিয়ে উপলদ্ধি করেছি। যদি শুনতে চাও, তবে বলতে পারি। "
ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনেই এক সাথে মাথা নাড়লো।
প্রবাল স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে গেল।
বয়স তখন কত আর হবে উনিশ কিংবা কুড়ি। সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। বাংলার বাতাসে তখন বারুদের হালকা গন্ধ ভেসে আসছে আর সেই ঘ্রাণেতে আমরাও বেশ মশগুল। শয়নে স্বপনে শুধু বিপ্লব। মিছিল, গোপন মিটিং, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারের ছড়াছড়ি - এসবই করেছি। সবাই ভাবতাম, এই রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক বৈষম্য, শোষণকে উপরে ফেলে দিয়ে নতুন সমাজ গড়বো। সেখানে থাকবে শুধুই সাম্যের ভিত্তিতে এক শোষণহীন সমাজ।
সেদিন শ্রেণী সংগ্রাম বলতে যা বুঝতাম, তাকেই সম্বল করে বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হল শাসকের বাহিনী, শ্রেণী শত্রুর উপর বিক্ষিপ্ত আক্রমণ। রাষ্ট্রের প্রতিআক্রমন শুরু হল , প্রতি রাতে প্রায় নিয়ম করে পাড়ায় পাড়ায় পুলিশি অভিযান আর সেই সঙ্গে ছাকনি দিয়ে ছেঁকে যৌবনকে খাঁচায় বন্দি করলো আর কিছু যুবাকে খতম করতে লাগলো।
তখন থেকে ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে বিশাল ফারাক। গোপন খবরগুলো কি ভাবে পুলিশ জানতে পারছে, এই ভাবনা নিয়ে পরস্পরের মধ্যে এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হল।
এক নাগাড়ে পুলিশের হানা, গ্রেফতার আর স্থান পরিবর্তন লুকিয়ে থাকতে থাকতে এক ধরনের একঘেয়েমিতে পেয়ে বসল। পাশাপাশি দেখলাম, যাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছি, পরবর্তী সময়ে তারাই ক্ষমতার জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে গেলো। বুঝতে পারলাম- যদি মানুষের মধ্যে লোভ, হিংসা আর ভেদবুদ্ধি থাকে তাহলে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই-ই থাকুকনা কেন, ঐ কামনা-বাসনারা সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করবে। একদিকে পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হতাশা আর প্রতিনিয়ত পুলিশি আক্রমণ এই দুই মিলে আমাকে বাধ্য করলো দেশের বাইরে পা বাড়াতে।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পেয়ে গেলাম অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তীকে, দর্শনের উপর ওনার অগাধ পান্ডিত্য। অদ্বৈত বেদান্তের সাথে সেখানেই আমার প্রথম দর্শন এবং সেখান থেকেই ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণা।
রূপম নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না, প্রবাল দা " অদ্বৈতবাদ কিভাবে সমাজ বদলের একটা স্থায়ী ভিত হিসাবে চিহ্নিত হলো - তারই ব্যাখ্যা তোমার কাছ থেকে শুনতে চাইছি। "
প্রবাল রূপমের কথার উত্তরে যা বলল, তাই শুনে সবার চক্ষু চরক গাছ।
" আজ সারা পৃথিবীতে বেদান্তের ঝড় উঠেছে। আমি তোমাদের ব্যাপক আলোচনায় না গিয়ে শুধু কয়েকটি শিরোনাম বলবো। বহুদিন ধরে মানুষ জানতো না নিজে কে ? জানতোনা যে তুমি এবং আমি আলাদা নৈ , একই সত্তার দুটি রূপ, আমি যদি তোমাকে আঘাত হানি, সেটা নিজেকে আঘাত দেবার সমান। আর প্রকৃত মুক্তি বাইরে থেকে আসা কোন তত্ত্ব নয়, সে আসে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহমর্মিতা থেকে, ক্ষমতাকে থেকে কখনই নয়।
সমাজতন্ত্রের সাথে যদি চেতনার স্থায়ী যোগসূত্র স্থাপন করা হতো, তাহলে, সমাজতন্ত্র কোন দিন ভেঙে পড়তো না। রাষ্ট্রের আইনের ক্ষমতা সেই কাঠামোর মেরামতের মধ্যে সীমাবদ্ধ , মানুষের হৃদয়বৃত্তির মধ্যে সমতাকে প্রতিস্থাপন নয়। "
এককালের ডাকাবুকো বামপন্থী রাজনীতি করা অরিন্দম যুক্তির মুক্ত বায়ু সেবন করে আত্মপোলদ্ধি থেকে বলল -"তাহলে এতো দিন যে স্বপ্ন দেখছিলাম তা ভ্রান্ত ? ভেবেছিলাম চে গুয়েভারার মতো স্বপ্নের 'গ্রানমা' নামক জাহাজে চেপে বন্দুক আর মিছিল করে শাসক আর শোষকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেটে দেব। "
সুচেতা বাবার ধরা গলায় স্বগোক্তি শুনে তার মনটা ভার হয়ে গেলো - সে নরমভাবে বলল -" বাবা আপনাদের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়নি -শুধু পথটা অসম্পূর্ন ছিল। "
অরিন্দম তাকিয়ে রইলো কন্যার দিকে। মনে মনে ভাবলো - নতুন প্রজন্ম কিন্তু অতীতের সব ভুল ভ্রান্তি শুধরে নিশ্চই নতুনভাবে তাদের অসমাপ্ত কাজকে সম্পূর্ণ করবে। সেই আশার আলো তিনি আজকের প্রজন্মের ভিতর বিচ্ছুরিত হতে দেখলেন।
ক্রমশঃ
তারিখ ২২/০৮/২৫
ভালো লাগলে পরিচিতদের কাছে শেয়ার করুন। খারাপ লাগলে ইগনোর করুন।
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ