(২৩৫ ) ভক্তির অন্বেষণে ( প্রথম অংশ) -
(২৩৫ )ভক্তির অন্বেষণে ( প্রথম অংশ) -
আমার বেলুড় মঠ ভ্রমণকে অনায়াসে দুটি পর্বে বেটে দেওয়া যায়। একটি ভ্রমনের পূর্বে আর অন্যটি ভ্রমনের পরে। অবশেষে বেরিয়েই পড়লাম। যাত্রাপথ আপাতত বেলুড়মঠ। ঘড়ির কাটায় ঠিক সকাল ৯টা, নিউটাউন বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। আমার সাথে সেই স্ট্যান্ডে অনেক চাকুরীরতা যুবক-যুবতীরা অপেক্ষা করছিল তাদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাবে সেই বাসগুলির জন্য। আমার কোন তাড়া ছিল না। খুব প্রয়োজন না থাকলে আজকাল বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোই না। কথাবার্তা, আবদার সবটাই আমার নিজের সঙ্গে। কিছু খেতে ইচ্ছা করলে নিজেকে দিয়েই সেটি পূরণ করে থাকি অর্থাৎ কারোর সাহায্য নিতে চাই না। মনে হয় ভালো থাকার পাসওয়ার্ড হচ্ছে যতদূর সম্ভব নিজের চাহিদা কমানো। ভাবলাম, মানুষ তো নিজের বাধা ধরা বৃত্তের বাইরে তখনিই যায় যখন নিজেকে পূর্বের জায়গায় খুঁজে পায়না। নিজের প্রয়োজনকে মিটাতে, সেখানে সব ধরনের উপকরণ আছে। আমিও বেরোচ্ছি সেই উদ্দেশে যেটা ঘরে বসে এই মুহূর্তে পাচ্ছিনা বলে।
ভীষণ ইচ্ছা করছিল গভীর ভাবে জানতে যাঁরা মূর্তির পূজা করে থাকেন তাদের ভক্তির উৎসটাকে জানতে ও বুঝতে। না বুঝে কোন দিন কারোর কাছে নিজেকে সঁপে দিইনি। বাবা যতদিন ছিলেন, ততদিন বাড়িতে পূজা-আর্চ্চা একদমই হতোনা , সেই রেয়াজটা আমাদের বাড়িতে চলে আসছিল। ইদানিং কন্যা মূর্তি পূজার রেওয়াজ শুরু করেছে। মনে হয়, কোন প্রাপ্তির আশা করছে, যা তার পুরুষকার দ্বারা সম্ভব হচ্ছেনা। আমি দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করি কিন্তু তার ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনা, কেননা অন্তরের সাথে অন্তরের হয়তো মিল হয়নি বলে। এই অন্দরমহলের অনুপ্রবেশের প্রবেশ পত্রটি খুজতেই বেলুড় যাত্রা।
দীর্ঘ আধ ঘন্টা বিশেষ একটি বাসের জন্য অপেক্ষা করে না পাওয়াতে বালিহল্টগামী একটি প্রাইভেট বাসে উঠে বসলাম। জীবন যুদ্ধের সৈনিকরা একে একে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে নেমে যাওয়াতে বিশ্ব বাংলা পার হবার পর একটা বসার জায়গা পেলাম। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাসটি উর্ধশ্বাসে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবার জন্য ছুটতে শুরু করলো। বেগতিক দেখে সামনের সিটের উপরের হাতলটি শক্ত করে রাখলাম। মনে মনে পণ করছিলাম, আজকের যাত্রাপথে বাইরের কাউকেই আমার চক্ষু ক্যামেরার নজর থেকে হারাতে দেব না। নিউটাউনের চারপাশে বহু গাছের সমারোহ। কোন কোন জায়গার অবিন্যস্তভাবে গাছের উত্থান দেখে মনে হয়, যারা পুঁতেছিলো তাদের যে বেশ আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। এখন বেলা প্রায় ১০টা , মাঝে মাঝে লালবাতিতে বাসটি দাঁড়াচ্ছিলো, নারী-পুরুষেরা বেশ ব্যস্ততার সাথে রাস্তা পারাপার করছিলো। আজকে নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জীবিকার সংগ্রামে লিপ্ত যারা, তাদের মধ্যে লিঙ্গ ভেদাভেদ ঘুচে গেছে , কেননা রাস্তায় নারী-পুরুষের উপস্থিতি মোটসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ। তাঁরা তাদের নির্দ্দিষ্ট যাত্রা পথে পৌঁছাতে দৌড়ে যাচ্ছে । অবশেষে, বালিখালে এসে উপস্থিত হলাম। এবার নামার পালা। নেমেই একটা টোটোতে গতির উল্টো দিকের আসনে জায়গা পেয়ে গেলাম। আমার পাশে একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি, ঠিক তার বিপরীতে একজন যুবতী মা, যিনি কেজিতে পাঠরত সন্তানকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। শুরু থেকেই সেই মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি সেই শিশুটিকে তার অপছন্দের উত্সগুলিতে নাড়া দিয়ে শিশুটির বিরাগভাজন হবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। শিশুটির ক্রোধ দেখে মানুষটি একধরনের একটা আদিম আনন্দ উপভোগ করছেন, যেন খাঁচায় থাকা বাঘকে কাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখার মতো। কিছু না ভেবে তার মাতৃদেবীও সময়ে সময়ে সেই পরিহাসে যোগদান করছেন। অবশেষে, বেলুড়মঠ এসে গেলো, ঘড়িতে সময় প্রায় ১১:৩০মিঃ। যেহেতু ইতিপূর্বে এখানে আসিনি তাই এই জায়গাটির সম্পর্কে আগে থেকেই বেশ খানিকটা রোমান্টিক ধারণা পোষন করছিলাম। বেশ খানিকটা ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ইয়ারো আনভিসিটেড-এর মতো। দিল্লির লালকেল্লায় একবার লাইট এন্ড সাউন্ডে ভারতের ইতিহাসের একটি অধ্যায় অনুভব করে ছিলাম। ঠিক সেরকম একটা অনুভূতির ভাবনা নিয়ে প্রবেশ করলাম। ভেবে ছিলাম প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই শুনতে পারবো সেই বেদ মন্ত্রের পাঠ। যদিও সেই মন্ত্রের সব অর্থ বুঝবোনা কিন্তু হৃদয়ের তন্ত্রীতে সেই মূর্ছনা তো প্রতিধ্বনি হবে, সেটাই আমার কাছে যথেষ্ট। সারা মঠ জুড়ে অনুরণিত হবে সেই সুর আর তার সাথে তাল মিলিয়ে গাছে গাছে পাখির কোলাহল, মন্দিরের বিলম্বিত ঘন্টাধনি , হুগলী নদীর জলের ফেনারাশি যেন নিজেকে তার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। গাছের তলায় ঋষিমুনিরা দেশবিদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্য পড়াচ্ছেন গভীর মনযোগে। একবার সংস্কৃতে পাঠ করে তাকে ইংরেজিতে তর্জমা করে দিচ্ছেন। পরিছন্ন মাটির বাড়িগুলি বাগান আর গাছপালা পরিবৃত হয়ে একটা প্রাচীন আশ্রমের গন্ধ বহন করছে। গাছের তলায় বাঁধানো বেদীতে ধ্যানমগ্ন সন্যাসীদের মূর্তি বসানো আছে। বড় বড় গাছের মেলে দেওয়া ডালপালা সূর্য্যের কিরণকে বেশ খানিকটা আড়াল করে রেখেছে। মনে হচ্ছে এই সেই আদর্শ জায়গা যেখানে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে এক বিশাল সন্যাসী বাহিনী রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের কুচকাওয়াজ সংগঠিত করছে বিশ্ব জয়ের জন্য। একই সঙ্গে ভারতবাসীকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে বিদেশী শক্তির হাত থেকে ভারত মাতাকে মুক্ত করার পটভূমি রচনা করার দৃশ্যের অবতারণা করছেন। যেন অদ্বৈতবাদে দীক্ষিত একদল যুবক যারা সন্যাসী অপেক্ষা অধিকতর ছিলেন সৈনিক , তাদের পদশব্দে মুখরিত এই লাইট এন্ড সাউন্ডের অনুষ্ঠানটি।
পরবর্তী সংখ্যায় কি দেখলাম ০০০০০০০
ক্রমাশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ৩০/১০/২৪
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ