(২৩৬ ) আত্মবন্দী
মানুষ কিংবা সংগঠন যাঁরা নিজেরাই তাদের মতাদর্শের বন্ধনে আবদ্ধ তারা সাধারণ মানুষকে আদৌ কোন মুক্তির পথ নির্দ্দেশ করতে পারবে ? বোধহয় না। সে তো সব সময় তার বেশভূষা সামলাতেই ব্যস্ত, অর্থাৎ সে অহংকেই আঁকড়ে ধরে আছেন, পরিত্যাগ করতে পারেনি।
অভিমুখ যদি হয় আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যমে দুঃখ-কষ্ট থেকে মানুষের মুক্তি, তাহলে আমিষ-নিরামিষ, জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজনে নিজেদের আগাপাছতলা আবদ্ধ করে মুক্তির খোঁজ করা একান্তই ভাবের ঘরে চুরি।
পুরাতন মূল্যবোধের সাথে নতুনের যদি সঠিক সংমিশ্রণ না হয় তাহলে চৈতন্যের উদয় কখনই হবে না। পুরোনো দইয়ের সাথে নতুন দুধের অপ্রতিরোধ্য মিশ্রণ যেমন জন্ম দেয় নতুন মাত্রার দইয়ের, ঠিক তেমনটি।
গ্রহণ না ত্যাগ কোনটির প্রাধান্য আজকে বেশী - এই প্রশ্নে ভারতবর্ষের সমাজজীবনে গুটি কতক মানুষ ছাড়া বাদবাকি সবাই গ্রহণের সপক্ষে। যে কারণে স্বামী বিবেকানন্দ যখন মার্কিন মুলুক থেকে ফিরে এসে ভারতবর্ষে অদ্বৈত বেদান্তের ভাবধারা কেন প্রচার করতে রাজী হন নি, সেই প্রশ্নের কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যে দেশবাসী ভোগ কি, তাই-ই জানেনা, তাকে ত্যাগের মন্ত্র কি শিখাবেন।
সামগ্রিক চাহিদার প্রশ্নে সেদিন আর আজকের মধ্যে খুব বেশী জনজীবনে ফারাক কি কমেছে ? বরং শুধু যে বেড়েছে তাই নয়, নিত্য নতুন ভোগের সামগ্রী বাজারজাত হওয়াতে, তাকে পাবার লক্ষ্যে মানুষ নিজেদের আর্থিক ক্ষমতার উর্দ্ধে উঠে তাকে লাভ করার জন্য যে কোন অসাধু উপায় অবলম্বন করতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না।
মানুষের এই নেতিবাচক মনোভাবকে এক শ্রেনীর রাজনৈতিক দল এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মের মোড়কে আচ্ছাদিত বিধর্মী পুরোহিত সম্প্রদায় এবং সামন্ততান্ত্রিক ভাবনায় দীক্ষিত সমাজের কর্ণধাররা একমাত্র শিক্ষা এবং অর্থের অভাবে পীড়িত সাধারণ মানুষকে বিভাজনের উৎসাহ দান করছে। সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্ত সময়কে কোন মন্ত্রবলে জীবনভাবনার বদলে জীবিকার ভাবনায় কেন্দ্রীভূত করেছে। তারা ভুলে গেছে শুধুমাত্র নিজের জীবন-জীবিকার সংঘর্ষে উদয়াস্ত ব্যস্ত থেকে কি ভাবে মানুষের সংগ্রামের ভাবনাকে উপলদ্ধি করা যায়। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষ একটি সিস্টেমের ব্যার্থতাকে ঢাকতে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে ঘোরাতে এই ধরনের একটি নির্লজ্জ পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। শুধু এখানেই তারা থেমে থাকেন নি, সৃষ্টিধর্মী এবং প্রগতিশীলতার অন্যতম মাধ্যম সেই শিক্ষা থেকে মানুষের মনোযোগকে সরিয়ে নেবার জন্য সিলিকন ভ্যালিতে একদল তথ্যপ্রযুক্তির কর্মীরা নিভৃতে এক বিধংসী বিষ নিত্যনতুন ফরম্যাটে পরিবেশন করে যাচ্ছেন, যার দৃষ্টান্ত মোবাইল ফোনের নিরবিচ্ছিন্ন ব্যবহার।
এই প্রবল শক্তিধর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে গেলে সাধারণ মানুষের হাতে প্রকৃত শিক্ষার হাতিয়ার তুলে না দিলে শুধু মাত্র সাইনবোর্ডের ডিসপ্লেতে কাজ হবে না। যে দেশের অস্থি মজ্জায় আধ্যাতিকতার বীজ বপন করা আছে, তাকে সেভাবেই সমৃদ্ধ হতে দেবার দরকার। ভারতীয় দর্শনের শক্তি সিলিকন ভ্যালির থেকে অধিক ক্ষমতাশালী। শুধু দরকার নিজেদের তৈরি ঘেরাটোপের বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভোরে একরাশ গভীর নিশ্বাস নেবার আর নেতিবাচক প্রচারের মধ্যে সময় নষ্ট না করে ইতিবাচক দিকটা বারংবার তুলে ধরা স্বার্থক না হওয়া পর্যন্ত।
তারিখ - ০৭/১১/২৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন