সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া  


"আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে কোন বিশেষ সময় দিয়ে বেঁধে রাখা  যায় না। আধুনিকতা থেকে যায় সারা জীবন ধরে। আধুনিকতা আর সমকালীনতাকে এক পংক্তিতে বসানো যায় না। যাঁকে কাল তাকে স্পর্শ করতে  পারেনা, সেটাই আধুনিকতা। সেখানে না আছে কোন প্রাচীনের তকমা অথবা একান্ত বর্তমানের ঘনঘটা কিংবা আগামীর বিড়ম্বনা আর  সব কিছুকে ছাপিয়ে সে যে সর্বকালীন। 

আধুনিক সেই-ই হতে পারে, যাঁকে  চিরন্তন পরিবর্তনের জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা, সমাজের কোন মলিনতা তার উজ্বলতাকে ম্লান করতে, কোন  ভিন্ন মতবাদের উদ্দত ফণা যাঁর পদপ্রান্তে এসে নীরবে আশ্রয় নেয়, সেটাই স্বামী বিবেকানন্দের অদ্বৈত বেদান্ত।   একদিন অরণ্যের গভীরতম পরিবেশে লালিত বেদান্ত যদি না স্বামীজীর সংস্পর্শে না আসত তবে বোধ হয় পায়ে পায়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমাতে পারতোনা। 

সেই যে রূপকথার ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী দুটি পাখি কিভাবে দৈত্যের হাতে বন্দী রাজকুমারীকে মুক্ত করার জন্য রাজকুমারকে পথের দিশা দেখিয়ে ছিল, সেটাই ছিল গল্পের উপজীব্য বিষয়।  আসলে অতিরিক্ত ভোগ, লালসা আর মায়া এবং সেখান থেকে উদ্ভূত দুঃখ স্বরূপ দৈত্যের  হাত থেকে  মুক্তিই ছিল  মানুষের একমাত্র কাম্য। জীবনে শত্রু চিহ্নিত করা ভীষণ কঠিন কর্ম। আর সেই শত্রুটির প্রাণবায়ুটা কোন সিন্দুকে লুকিয়ে আছে এবং কোন অস্ত্রে তার নিধন করা যাবে, সেই রণনীতির ম্যানুয়ালটি নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো স্বামীজীর আবির্ভাব। 

মাও সে তুঙ, ভো গন গিয়াপ কিংবা চে গুয়েভারার রণনীতির ম্যানুয়ালের সাথে স্বামীজীর ম্যানুয়ালের তফাৎ হলো এই বিশ্ব বরেন্য যোদ্ধারা মানুষের মুক্তির জন্য মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করেছেন, সেখানে স্বামীজী সেই দ্বান্দিকতার কারণকে  খুঁজে বের করেছেন  মানুষের ইনবিল্ট কম্পোজিশনের মধ্যে। 

দেহ ও উভয়াত্মক ইন্দ্রীয় মনের সুস্বাস্থের পুষ্টির প্রশ্নে মনকেই  অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। এই মনের অনেক অনেক পিছনে বাস করে আত্মা। আর সেই আত্মার সম্পর্কিত কথাই  'অধ্যাত্ম' শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে।   প্রাথমিক ভাবনার শুরু হয়েছে শরীরকে নিয়ে, যাঁকে দেখা যায়, যে সর্বদা পরিবর্তনশীল অর্থাৎ বস্তু পৰ্য্যায়ভুক্ত। ভাবনা সেখানে থেমে থাকেনা, প্রশ্ন ওঠে এই জড় বস্তুকে কে   চালাচ্ছে এবং সেই অদৃশ্য শক্তিটিই বা কে ? সেই ঐশ্বরিক শক্তির ভাবনাটাই আধ্যাত্মিক ভাবনা। স্বামীজী নবরূপে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদকে তাঁর দার্শনিক ভাবনা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।   "আত্মানম়়্ অধিকৃত্য বর্ততে ইতি অধ্যাত্মম্ " - যে অদৃশ্য আত্মাকে আস্টেপিস্টে আঁকড়ে ধরে যে দৃশ্যমান শরীর আর ইন্দ্রিয় প্রতীয়মান, সেই-ই হচ্ছে 'অধ্যাত্ম'। 

সমুদ্রে নাবিক কম্পাস ছাড়া জাহাজকে ভাসাতে  পারেনা। ঠিক তেমনি যে কোন সাহিত্য কিংবা রচনা বিশেষ উদ্দেশ্যকে যদি বহন করে চলতে না পারে, তবে বিস্মৃতির গর্ভে হারাতে বাধ্য। 

সাধারণতঃ মানুষ দর্শন নামক বিষয় থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখে। একেই প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের কঠিন মুহূর্তের ঢেউগুলিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে, তার পর যদি মনের উপর বাড়তি চাপকে বরদাস্ত করাটা অসম্ভব হয়ে পরে।   

 অনেক মাটির কাছাকাছি, যেখানে ব্যাঙ্গমা আর ব্যঙ্গমী গল্প করবে তাঁদের পরের প্রজন্মের কাছে। সেখানে থাকবে ভাষার সাথে পাঠকের আত্মীয়তা, ভাবনার সাথে বিষয়ের গভীর হৃদ্রতা, গল্প যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়,  ধীরে ধীরে গল্পের জাল পাঠকের মনে বিস্তার করে বারংবার পরের ঘটনাকে জানার ক্ষিধে বাড়িয়ে তুলবে।  

জীবনের প্রথম দিনে শিশু যতক্ষন পর্যন্ত শব্দ করে কেঁদে না উঠতো, ততক্ষণ  পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারতো না সে কি আদৌ জীবিত কিনা।  তাই  ধরে নেওয়া যেতে পারে  শব্দই একমাত্র প্রাণের সাথে মানুষের  প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয়। 


"বহমান সমাজে নিম্নগামিতার কারণ অনুসন্ধান ও  ভারতীয় দর্শন " এই শীর্ষক আলোচনার  উদ্দেশ্য এই প্রবন্ধ রচনা। দর্শনের সুউচ্চ পর্বতের চূড়ায় উত্তরণের আগে ছোট, বড়, মাঝারি অসংখ্য পথ পরিক্রমা করে অতীব  ক্ষুদ্র অংশ 'শব্দ'তে এসে থেমে গেল।  তাই সেই ছোট্ট সম্ভাবনাকে নিয়ে উচ্চতার শিখরে উঠবার বাসনা হল।   

শব্দের জন্মের ইতিবৃত্ত  

প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে শব্দের সাথে আমাদের প্রথম পরিচয়। শুধু কি তাই, না, আরো কিছু আছে, সেই অনুসন্ধানে উন্মোচিত হল সেই রহস্য। দেখা যাক, তারই জন্ম বৃত্তান্ত। প্রথমত,   শব্দ থেকে শব্দের যেমন জন্ম হয়ে থাকে তেমনি  মৌনতা থেকে শব্দের জন্ম হয়; আবার ধ্যানের মাধ্যমে শব্দের জন্ম তো বেদে দেখতে  পাওয়া যায়, সেই সৃষ্টিটাকে  অপৌরুষেয় বলে অবিহিত করে থাকে।  শব্দের থেকে শব্দের উৎপত্তির ক্ষেত্রে  উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দুটি শিশু নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে, প্রথম জন অপরজনকে বলছে পাগল। রাগ হিংসায় পরিপূর্ন হয়ে দ্বিতীয় শিশুটি বলে উঠল - তুই একটি ছাগল। এইভাবে শব্দ থেকে শব্দের জন্ম নেয়। অধিকাংশ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও  তাই, কুশি-লব ও অন্যান্য সহ-চরিত্রগুলির  কথাপকথনে একটি শব্দের প্রত্যুত্তরে অপর একটি  শব্দের ব্যবহার আকছার  হচ্ছে।  এই শব্দগুলির স্থায়িত্ব স্বল্পকাল। প্রতিষ্ঠিত কবিদের মৌন থেকে উৎসারিত শব্দগুলি সময়কে অতিক্রম করে পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। আবার ধ্যানের গভীর উচ্চারিত শব্দগুলি অক্ষয় বাণী হয়ে থেকে যায়। যেমন,  মন্ত্রের  জন্ম। 

শব্দ মাত্রই হচ্ছে সুক্ষ। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের উপলদ্ধি হচ্ছে তন্মাত্র। এক শব্দ তন্মাত্র থেকে  আকাশকে নির্দেশ করে; শব্দ ও স্পর্শ এই দুই তন্মাত্র নিয়ে বায়ু; শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিন তন্মাত্র নিয়ে তেজ; শব্দ, স্পর্শ , রূপ ও রস  এই চার  তন্মাত্র নিয়ে জল ; শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ    এই পাঁচ  তন্মাত্র নিয়ে ক্ষিতি।  শব্দকে বাদ দিয়ে কোন বোধন হয় না।  

চাহিদা

 চাহিদা নামক বস্তুটি ভীষণ সংবেদন এবং গতিশীল, তার তাল এবং ছন্দ এই দুই-ই আছে। আসলে সে তাঁর সেই স্বরলিপিটা সর্বদাই অনুসরণ করতে চেষ্টা করে যা প্রত্যেক দিন  সময়ের  পাতায় তাকে নব নব রূপে সাজানো হচ্ছে। এইটা আসলে কৃত্তিমভাবে তৃষ্ণা বৃদ্ধির চেষ্টা। আসলে সেই গোলকধাঁধায় একবার  প্রবেশ করলে মানুষ বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পায়না। তৃষ্ণা ও চাহিদা একে অন্যের পরিপূরক। তাই সে একটি চাহিদার পূর্ণতা প্রাপ্তিতে, আবার নতুন করে তৃষ্ণাকে গর্ভে ধারণ করে, তখন আবার চাহিদা সক্রিয় হয়ে ওঠে, এটাই কালের প্রচলিত নিয়ম । তাঁর গুনের  যদি বর্ণনা দিতে হয়, তাহলে অবশ্যিই বলতে হয় তার দুটি গুণ। একটি তার স্থুল চেহারা যাকে ভোগ করার মধ্যে মন যেখান  থেকে সাময়িক আনন্দ লাভ করে।  অপরটি আধ্যাত্মিক বা সুক্ষ শরীর, যে মনের আরো পিছনে থেকে কৃত কার্য্যের কারণের ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ায়। এই চাহিদাই সৃষ্টির কারণ এবং যে কোন মতাদর্শকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে  বিচার-বিশ্লেষণের  অবদান অনস্বীকার্য। এই দুটি ভিন্ন ধরনের চাহিদা জীবনের গতিপথকে প্রভাবিত করে, যেমন, অপার্থিব অর্থাৎ জ্ঞানের চাহিদা মানুষকে সমৃদ্ধ করে আর পার্থিব চাহিদা অতৃপ্ত করে, কেননা সেটি নিয়মিত আবর্তিত হয়। 
বিশ্বাস
একদিন মানুষ যখন প্রকৃতির বাঁধাহীন উন্মাদনা দেখে ও তার  প্রকৃত কারণ অজ্ঞাত থাকাতে , আতঙ্কে কম্পিত হতো, সেদিন তার ব্যাখ্যা দেবার মতো  কেউ ছিল না। আবার সেই প্রকৃতি যখন এত কান্ড ঘটানোর পর খিল খিল করে হেসে উঠতো, তখন মানুষ তাঁর পূর্বেকার ভয়াবহতা ভুলে গিয়ে তাঁর সাথে একাত্ম হয়ে নাচে গানে মেতে উঠতো। প্রকৃতির এই মিশ্র অনুভবের লীলার কারণকে অনুসন্ধান করতে এবং তাকে চিনতে সেদিন মানুষ জানতো না কার পিঠে সওয়ারী হয়ে সেই অজানা পথে পাড়ি দেবে । ব্যতিক্রমী কিছু মানুষের পরাক্রমী অধ্যবসায় যৎকিঞ্চিৎ তথ্য যুগে যুগে ধারাবাহিক ভাবে উন্মোচিত হচ্ছে, তাকেই সাধারণ মানুষ প্রকৃতির অমোঘ কার্যের কারণ হিসাবে 'বিশ্বাস' নামক শব্দবন্ধের হাত ধরে হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছে। জ্ঞান যেখানে পৌঁছাতে পারেনা সেখানে বিশ্বাস অবলীলায় নিজের জায়গা করে নিতে পারে, কেননা, বিশ্বাসের সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক না থাকার কারণে।  বিবর্তনের নিয়মানুসারে তথ্য ধাবিত হয় নিজেকে তত্ত্ব হিসাবে জাহির করতে অর্থাৎ তথ্যের প্রামাণ্য কারণ খুঁজতে, সেই কার্য্যের পূর্ণতায়  যখন এক একটা বৃত্তের যখন পরিসমাপ্তি ঘটে, সে তখন বিজ্ঞান নামে আত্মপ্রকাশ করে। যেখানে বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু জীব আর জগতের সীমাব্ধতাকে  অতিক্রম করে আরেকটু এগোতে চায়, সেখানেই দর্শনের সাথে পরিচয় ঘটে। যে সমাজে বিজ্ঞান আর দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয় সেখান থেকে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাস হাত গুটিয়ে চলে যায়। এটা একটি নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া।  
মায়া ও বিশ্বাস 
একদিন পুরুষ বা চৈতন্যের ক্রোড়ে প্রকৃতি গভীর নিদ্রায় আছন্ন ছিল। এইটা তার অব্যক্ত অবস্থা।  তারপর যেইদিন পুরুষ স্থির করলেন তিনি সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করবেন। সেদিন থেকে শুরু হলো তার পথ চলা। পুরুষের স্পর্শে আন্দোলিত হলো প্রকৃতির দেহ মন। স্বাদে,গন্ধে, বর্ণে, শব্দে, স্পর্শে তার অণুতে অণুতে স্পন্দিত  হলো জীবনের উল্লাস।  সেই প্রাণের ছোঁয়ায়  প্রকৃতির কোলে  নিদ্রিত অতীব চঞ্চল  ত্রিগুন-  সত্ত্ব, রজ ও তম জাগ্রত হলো। সেই জাগরণে পূর্বেকার সাম্যাবস্থার  ঘোর কাটিয়ে তারা প্রচন্ড কোলাহলে মাতিয়ে তুললো বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের আকাশ বাতাস। পরিমিতির বেড়াকে অস্বীকার করে  মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় অন্তনির্মিত ত্রিগুণের অসম ব্যবহারে যে বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশে আশঙ্কিত হলো সবে শৈশবের গন্ডি পেরোনো  মানব সমাজ। শুরুতেই যেন এক অশুভ সংকেত।  ভাবী আশঙ্কায় ব্যথিত হল সেই মানবের  আত্মা যাঁরা চৈতন্যের আলোতে  অবগাহন করেছেন। সাধারণ মানুষ অজ্ঞ এই ত্রিগুণের পার্শ্ব  প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। একান্ত ইন্দ্রিয় নির্ভর  যে সাময়িক উন্মাদনায় বিভোর মানবকুল  হয়তো সাময়িক সুখানন্দে বিভোর হয়ে আছেন আর ঠিক তার অপরপ্রান্তে একরাশ সীমাহীন দুঃখ তাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে, সেটা তাদের কাছে অজ্ঞাত।  
মোহময় প্রকৃতি, চারিদিকে তাঁর অপূর্ব বৈচিত্রপূর্ণ সম্ভার  ছড়িয়ে দিয়েছে যাঁর  মনোহর রূপের  হাতছানিটা উপেক্ষা করার মতো নয়।  যে সেটা জানে সে যত্ন করে পাশ কাটিয়ে যায়  কিন্তু যে জানে না সে তো তাকে  পাবার জন্য ব্যাকুল হবেই। এই চঞ্চল মনের অপার আকাঙ্খা আর তার প্রাপ্তি থেকে  একদিকে ভোগের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং চুড়ান্ত ভোগের উচ্চতায় উঠে ক্রমবর্ধমান অনীহার মাত্রা বৃদ্ধি, আবার অন্যদিকে ভোগ্য বস্তুর না পাওয়ার বেদনা।  এই দুইয়ের টানা পোড়েনে মানব জীবন থেকে সুখ ও শান্তির স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটতে চললো।  

 ঋগ্বেদ এই সৃষ্টি রহস্যের খানিকটা আলোকপাত করেছে। আমরা যে ব্যক্ত ও অব্যক্ত বলে থাকি সেটি সৃষ্টির পূর্ব অবস্থায় শুধুমাত্র অব্যক্ত অবস্থায় ছিল। না ছিল সূর্য্য, না ছিল চন্দ্র, সুতরাং দিন ও রাতের কোন পার্থক্য  ছিলো না। শুধুই  ব্রহ্মাই (কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা-হিন্দুদের শাস্ত্র অনুযায়ী)একমাত্র ছিলেন। রাতের অন্ধকার যেমন সমস্ত বস্তুকে আড়াল করে করে রাখে, ঠিক তেমনি অজ্ঞানের অন্ধকারে সমগ্র পৃথিবী আবৃত ছিলো।   গাঢ় অন্ধকারে আবৃত অবস্থা সেই অর্থে অজ্ঞানের প্রতিরূপ, তাকেই তমঃ গুণে  বর্ণনা করা হয়েছে। সেই তমঃ রূপটাই মায়া আর সেই থেকে এই জগতের আবির্ভাব। আদিতে এই মায়াই ছিল পুরুষ বা ব্রহ্মের একমাত্র সহচরী।  মায়ার সঙ্গী   হবার কারণে, যে আসলে মায়ার অতীত সেই পরমব্রহ্মকে মায়াময় বলে মনে হয়েছিল। চরম মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিজনিত আকাঙ্ক্ষাকে কামনা নামে অভিহিত করা যায়, সেই কাম থেকেই জগৎ সৃষ্টি।  আর এই কামনাই মায়া। প্রলয়ের তমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে মায়ার গর্ভে সমগ্র জগৎ লুকিয়ে ছিল। জগতের এই অনির্ব্বাচ্য অবস্থাই শ্রুতিতে অসৎ বলা হয়েছে।  এই অব্যক্ত অবস্থা থেকে যখন ব্যক্ত হল মানুষ, অন্যান্য প্রাণিকুল ও প্রকৃতি, যারা জন্ম লগ্ন থেকে ভিন্ন ভিন্ন নামরূপে ভূষিত হলো মায়ার কারণে। যাঁরা সদাই পরিবর্তনশীল তারা অসৎ বস্তু রূপে চিহ্নিত হলো  আর যাঁরা কখনই পরিবর্তিত হয় না তারাই সৎ বস্তু হিসাবে পরিগণিত হলো। এক কথায় মায়াকে বলা যেতে পারে বস্তু সম্পর্কিত একটি অস্থায়ী ধারণা, সেটাই বিশ্বাস। 


 এই  বিশ্বাসের সাথে মায়ার এক নিবিড় সম্পর্ক।  জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষের সাথে সাথে অন্ধ বিশ্বাসকে মানুষ পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাইলো, অর্থাৎ মায়ার মায়াজাল ছিন্ন হতে শুরু করলো।  যখন বিশ্বাসের নেত্র থেকে অন্ধত্বের আবরণটা বিদায় নিতে শুরু করলো  তখন সেই শূন্য স্থানটি  অধিকার করার দায়িত্ব এসে পড়লো  বিচার ও বিশ্লেষণর উপর।     
জ্ঞান প্রক্রিয়া 
বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান প্রক্রিয়ার একটা ধারাবাহিকতা আছে।  গতকাল বস্তু সম্পর্কিত যে ধারণাটি ছিল, আজকে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতির বহমান অনুশীলনে পূর্বেকার বস্তু সম্পর্কিত ধারণাটি সংকীর্নতার নাগপাশ  ছিন্ন করে মুক্ত আকাশে বিহঙ্গের মতো উড়ে যেতে সক্ষম হলো।  এই নব্য চেতনার মধ্যে দিয়ে  মনোজগতে পরিবর্তনের সঞ্চার হলো এবং পরবর্তী সময়ে সেটি সামগ্রিকভাবে সমাজ পরিবর্তনের কারণ হিসাবে চিহ্নিত হলো। সুতরাং মানুষের মানসিক পরিমণ্ডল গঠিত না হলে এবং পুনঃ পুনঃ তাকে লালন পালন না করতে পারলে পরিবর্তনের স্থায়িত্ব  সাময়িক হতেই  হবে , এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোন পরিবর্তনই স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারেনি। এই জ্ঞান প্রক্রিয়ার অন্যতম লক্ষ্য  হলো কাম, ক্রোধ, অহং ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব থেকে মনকে মুক্ত করা। 

যে মস্তিস্ক মানব দেহের পরিচালক, সে যদি নেতিবাচক প্রভাবে পরিচালিত হয় তাহলে,  সমগ্র প্রভাব তার কার্যক্রমের উপর গিয়ে পরে , যা মানবিক চরিত্রের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। এই জ্ঞান প্রক্রিয়া নেতিবাচককে দূরে ঠেলে ইতিবাচককে পরিচালকের আসনে বসাতে সাহায্য করে থাকে।  যেমন, ইনবিল্ড অপারেটিং সিস্টেম কম্পিউটার বুট করার সাথে সাথে মেশিনের মেইন মেমোরিতে বসে টোটাল সিস্টেমটাকে কন্ট্রোল করে, ঠিক সেইভাবে নেতিবাচক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত মস্তিস্ক মানুষের সবধরনের কর্মকে প্রভাবিত করবে। বর্তমানে দেশ তথা  বিশ্বের অব্যবস্থা তারই  সাক্ষর বহন করছে।  

চলবে ..............
ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ - ১৭/১২/২৪ 

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

কোন মন্তব্য নেই:

ujaan

(২৩৯)বহতি হাওয়া

(২৩৯)বহতি হাওয়া   "আধুনিক " এই শব্দটিকে নিয়ে বেশ বাগবিতণ্ডা হয় মাঝে মাঝে, কোন বাক্যের প্রিফিক্স হিসাবে তাকে  বসানো যায়। আধুনিকতাকে...