(২৪০) বন্দরের ইতিবৃত্ত
ফিরে দেখা গত সংখ্যা " বহতি হাওয়া"র চুম্বক -
এক ধরনের সাহিত্যে বহু চরিত্রের ঘনঘটা যেন রঙের বহুত্বকে আলিঙ্গন করে ক্যানভাসের দেয়ালে এক পূর্ণাঙ্গ ছবিকে ফুটিয়ে তুলতে চায়, কিন্তু বিধি বাম। এক জীবনে সেই পরিপূর্নতা কখনো আসেনা । কাহিনীকারও তাঁর থেকে ব্যতিক্রম নন, তাই তিনি স্বভাবতই সেই পথেই পরিক্রমা করেন, যেখানে পূর্ণতার যেই স্বাদ নিজেই পাননি। আর বঞ্চিত লেখক অভিজ্ঞতার অভাবে কি করে এক পূর্ণাঙ্গ জীবনের ছবি তুলে ধরতে পারবেন ? তাহলে মানুষের জীবনে অপূর্ণতাই একমাত্র বাস্তব আর গোটা জীবনের বাকিটা স্বপ্ন।
এই রচনায় কুশি-লব নেই কিন্তু সংঘাত আছে । তাই সেই জায়গা দখল করেছে ছোট ছোট শব্দবন্ধের একান্ত প্রাসঙ্গিক ভূমিকা, যাদের অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমাদের কাহিনীর সহশিল্পীরা কোনো রক্তমাংসের মানুষ না হয়েও তাদের ভূমিকা আছে একটা রচনার পূর্ণাঙ্গ শরীর গঠনের ক্ষেত্রে। তাই সেই "শব্দ", "চাহিদা", "বিশ্বাস", "মায়া" প্রভৃতিকে উপ শিরনামে রেখে সবার সাথে পরিচয় করার দায়ভার না নিয়ে কোন উপায় ছিল না।
******************************
দ্বিতীয় সংখ্যা --
তারপরে কি হলো ০০০০০ এই বাক্যটাকে পূর্ণমাত্রায় গলাদ্ধকরণ করতে গিয়ে পাঠক কিংবা দর্শক ভাবী ঘটনার অনুসন্ধিৎসায় নাওয়া-খাওয়াকে অবহেলায় বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু তার সেই উদ্বেলিত শিহরণ পুনরায় পাঠে শিহরিত করতে পারেনা। মধুর আবেগ ঠিক যেন ধূমকেতু, চকিতে আলো জ্বালিয়ে হারিয়ে যাবার মতো। স্থায়ী চিহ্নের জন্য বিষয়ের সাথে অন্তরের আত্মিক সম্পর্কের প্রয়োজন।
ভারতীয় প্রাচীন ঋষিরা যেন এক একটি খেজুর গাছ। একটি গাছ যেমন তার মাথা চেঁছে রস বের হয়ে মানুষকে তৃপ্ত করে , ঠিক তেমনি তাঁদের মাথা আর হৃদয় থেকে মন্থিত অমৃত মানব ইতিহাসকে কত যে সমৃদ্ধ করেছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। তাঁরা হাজার হাজার বছর পূর্বে বিতরণ করলেও সেই সব প্রসাদের মাধুর্য্য যেন সদ্য পেরে আনা খেজুরের রসের মতো উপাদেয় এবং স্বাদ মন্ডিত।
আমরা যেন এক মুসাফির, এসেছি ক্ষনিকের বিশ্ব ভ্রমণে। এখানে এসে আমাদের পাগলা ঘোড়ার উপর সওয়ারী করে "মায়া" আমাদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। একরাশ চাওয়া-পাওয়ার পাগলামিকে দূরে ঠেলতেই পারছিনা। এই পৃথিবীর প্রথম জল পান করে ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের আত্মপরিচয়। আত্মবিস্মৃত হয়ে একই আবর্তে আবর্তিত হতে হতে ক্লান্ত পথিক সাময়িক অবসরের পর পুনর্বার সেই অমানিশিরই হাতছানিতে নিজের অবস্থানটি ভুলে যাচ্ছি , দৌড়াচ্ছি শুধুই দৌড়াচ্ছি। যেন অনন্তের পিছনে অন্তহীন যাত্রা। সময়ের সাথে আপস করে একদিন সেই মুসাফির চিরকালের মতো তার সফর শেষ করে। এই রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যের কারিগর তখন ব্যস্ত হয়ে মুসাফিরকে চিরবিদায় জানিয়ে তাঁর প্রানপাখিকে খাঁচায় বন্দী করে নতুন এক মুসাফিরকে জাপ্টে ধরে। এইভাবেই জাগতিক চক্রযানটা অবসরহীনভাবে ঘুরতে থাকে।
এই কাল্পনিক জালকে একমাত্র ছিন্ন করতে পারে চৈতন্য। এই চৈতন্যের রথের সারথী হল জ্ঞান। অজ্ঞান স্বরূপ একদল শত্রুকে নিধন করার থেকে এক এক করে নিধন করে চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছান শ্রেয় মনে করে জ্ঞান তাঁর রথকে দাঁড় করালো বন্দরে, যেখান থেকে ইন্দ্রীয়রুপী (চোখ,কান,জিহবা,নাক ও ত্বক নামক জ্ঞানেন্দ্রিয়) জাহাজ ভিন্ন ভিন্ন পণ্য নিয়ে এসে ভিড় করে। অপেক্ষামান কর্মবীররা ( মুখের বাক, হাত,পা, পায়ু, উপস্থ বা পুরুষাঙ্গ নামক কর্মইন্দ্রিয়) উদ্যত হয়ে উঠে তাকে গ্রহণ পরবর্তী কাজ করার জন্য, কখন হিসাব করে আবার কখন বেহিসাবীর মতো। এই গ্রহণ এবং বর্জনের সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একটা পরিষদ আছে (মন, বুদ্ধি,চিত্ত,অহংকার নামক চারটি অতিরিন্দ্রিয় যাঁরা জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত) পণ্যকে গ্রহণের পূর্বে গুণমান বিচার এবং বিশ্লেষণ যথাযথ না হলে গ্রহীতা অসুস্থ হয়ে পরবে আর এই দায়িত্ব হচ্ছে জ্ঞানের। গ্রহণ ও বর্জনের মাঝখানে হজমই হচ্ছে সুস্বাস্থের লক্ষণ, যে কাজটি জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত পরিষদের কাজ। এইবার পরিচিত হবার সময় হয়েছে সেই ইন্দ্রিয়ের অতীন্দ্রিয় কাজের সাথে।
ইন্দ্রিয়
মনের সহযোগী হয়ে ইন্দ্রিয়ের কাজ গ্রহণ আর বর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যাদের মধ্যে কেউবা বাইরের থেকে নীরবে তথ্য সংগ্রহ করে আবার কেউবা শুধুমাত্র প্রকাশ করেই ক্ষান্ত, তারাই ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত। এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বিশেষ লক্ষণীয়। একের সাথে অপরের এক অন্তর্নিহিত সুক্ষ অথচ দৃঢ বেষ্টনীতে আবদ্ধ। প্রত্যেকের কাজের চরিত্র নির্ধারিত হয় কর্মের নিরিখে। ধরাযাক, দেহের একটি কক্ষ বরাদ্দ করা আছে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের জন্য এবং তার কাজও পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট করা আছে। একটি বা একাধিক জড় বস্তুকে সে দর্শন করল, তার প্রতিফলন প্রতিধ্বনিত হবে চোখের তারায়। জাগ্রত মুহূর্তে চক্ষুর নির্ধারিত অবস্থান থেকে সেই তথ্য স্থানান্তরিত হবে বিষয়বস্তুর পরিচয় ও চরিত্র নির্ধারণের একমাত্র রাসায়নাগার সেই মনের কাছে। এটা উল্লেখযোগ্য যে মন ব্যতীত আর কোনো উভয়াত্মক ইন্দ্রীয় নেই যেখানে তথ্য সংরক্ষিত হতে পারে। মন শুধুমাত্র একটি সংরক্ষণাগার ব্যতীত কিছু নয়, তাকে কাজ করতে গেলে তার সহযোগী অন্যান্য সঙ্গীদের সাহায্য নিতে হয়, যেমন, চিত্ত , বুদ্ধি ও অহংকারের। এসবের পিছনে আছে চৈতন্য। সেই চৈতন্য যদি মায়ার আবরণ মুক্ত হয় তাহলে, তার প্রকাশ একরকম, আবার মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয় তাহলে, তার বিরূপ প্রকাশ। জ্ঞানই একমাত্র এই মায়াজাল ছিন্ন করতে পারে।
কতগুলো সত্যের উপর আলোকপাত করলে ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতাকে সহজেই বোঝা যায়। যেমন, চোখ কিন্তু চোখকে দেখতে পারেনা। কেননা চক্ষু ইন্দ্রিয়ের অন্তর্ভুক্ত। ইন্দ্রিয়, মন বা অন্তঃকরণ ও বিষয় হচ্ছে জড় সম্প্রদায়ভুক্ত। জড় কখন জড়কে দেখতে পারেনা। যে দেহ ভোগের নিকেতন, তারই মধ্যে বাস করে অশরীর আত্মা, তাঁকে দেখা তো দূরস্ত, এমনকি ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে অনুভব করা যায় না।
আমরা তাকেই অনুভব করতে পারি যাঁর শরীর আছে। আত্মা অশরীর বলে তার কোন সুখ-দুঃখের অনুভূতি নেই, তার জন্ম ও মৃত্যু নেই, নির্গুণ তাই কোন পাপ-পুণ্যের খতিয়ান ও নেই, সে সদাই শুদ্ধ। জ্ঞান ও যোগ চক্ষুর অভাবে আত্মা অপ্রকাশিত আবার জ্ঞান ও যোগ চক্ষুর বিকাশে সে প্রকাশিত।
নেত্রদ্বয় উন্মোচিত হবার সাথে সাথে প্রকৃতির নয়নাভিমান সৌন্দর্য্যকে আস্বাদন করতে করতে ক্লান্ত মানব যখন তার অন্তঃকরণের ডাক শুনতে পেল তখন জাগ্রত হলো তাঁর অনন্ত অনুসন্ধিৎসা। কোথা থেকে আমরা এসেছি ? কোথায় আমাদের শেষ যাত্রা অর্থাৎ পরিণতি? যে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করছি সে কখন সৃজনশীল আবার কখন ধংসলীলায় মগ্ন -- তার পিছনের কারণ কি ? এই জড় প্রকৃতির বুক চিরে এই প্রাণিজগতের আগমনের কারণ কি ? কে এই জড় আর প্রাণের যোগসূত্রের কারিগর ? আর এই ' আমি'-ই বা কে ?
শুরু হলো প্রকৃতি (বাহ্যিক) দর্শনের পাশাপাশি আত্মদর্শন। একটা হল স্থুল দর্শন আর অপরটি হলো সুক্ষ দর্শন। স্থুল দর্শন বস্তুতে তার ইতি আর সুক্ষ দর্শনের গভীরে আছে বিচার এবং বিশ্লেষণ। প্রতি মুহূর্তে তাকে চূড়ান্ত সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে, প্রতিটি ধাপে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ন হতে হয়। তাই দর্শনকে পরীক্ষা শাস্ত্র বলে সম্বোধন করলেও অত্যুক্তি হয় না।
বাধা নিষেধের গন্ডি কার কতখানি এই প্রশ্নে, দর্শন আর বিজ্ঞানের সংজ্ঞার মধ্যে একটা হেঁয়ালি আছে । জড়বিজ্ঞান বাইরের প্রকৃতির স্বরূপ নির্ণয় ও তার তত্ত্ব নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ বস্তুজগতে পদার্থের যাবতীয় তত্ত্ব নির্ণয় করাই বিজ্ঞানের কাজ। জড়জগতের মৌলিক উপাদান ও তার কার্যাবলী কি আর কি নিয়মে চলছে - এটাই বিজ্ঞানের মূল বিষয়।
এই অস্পষ্টতাকে স্পস্টতায় প্রতিষ্ঠা, অব্যক্ততাকে ব্যক্ততাতে প্রকাশমান করতে গিয়ে বিজ্ঞান যেখানে থমকে গেছে শুধুমাত্র জীব ও জগতের মধ্যে আলোচনার পরিসরে, সেখানে ভারতীয় দার্শনিকরা এই বিশ্বে জীব, জগৎ ব্যতিরেকে বা তাঁর বাইরে যে চালিকা শক্তি আছে সেই ঈশ্বরকে নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেছেন।
ইনকোয়ারি
তথ্যই হোক কিংবা কোন ঘটনাই হোক, তাকে গ্রহণ করার প্রাথমিক সোপান হচ্ছে ইনকোয়ারি বা বিচার এবং এটি কালক্রমে মানুষ বুঝতে পেরেছে। যে দেশ যত বেশী আধুনিক হয়েছে, সেখানে বিচার করে গ্রহণ করাটা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। ভারতবর্ষের ষড় দর্শন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞানের উন্নতিতে মানুষ অন্ধ বিশ্বাসের ধারণাকে পিছনে ফেলে গ্রহণ যোগ্যতার ক্ষেত্রে বিচার বিশ্লেষণকে একমাত্র মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে।
ক্ষেত্রজ্ঞ ও ক্ষেত্র- জীব ও জড় (প্রকৃতি)শক্তিকে যে বিশেষ শক্তির অভিব্যক্তি বা প্রকাশ হিসাবে ভারতীয় দার্শনিকরা বর্ণনা করেছেন। সেই শক্তিই হচ্ছে চৈতন্য। সমগ্র জাগতিক বস্তুর পশ্চাতে যেই পুরুষ কাজ করেন আর তিনিই 'ক্ষেত্রজ্ঞ ', আর যেখানে অধিষ্ঠান করেন তার নামই 'ক্ষেত্র '। ( সাধারণভাবে ক্ষেত্র যদি দেহ হয় তাহলে যে সেই দেহকে যিনি জানতে পারেন তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ বা চৈতন্য বা দ্রষ্টা)
ভগবৎগীতায় শ্রীকৃষ্ণ তার একান্ত শিষ্য অর্জুনকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এই দৃশ্যমান বিশ্বব্রহ্মান্ডই আমি। এর বিকাশ এবং লয়ের একমাত্র কারিগর আমি। বস্তুজগতের সারাৎসার প্রাণ, যা তুমি উপলদ্ধি কর, সেটাই আমি। চন্দ্র সূর্য যে আলোকে জগৎসংসারকে আলোকিত করে, সেটি আমারিই তেজ। অগ্নি যে আলোকে দীপ্তমান হয়, সেও আমার তেজঃ। আকাশের শব্দ, জলের রস, পুরুষের পুরুষত্ব, জীবের প্রাণ, সেও আমি। আমি কভু ব্যক্ত কভু অব্যক্ত, কভু বাহির আবার কভু অন্তর, আমি সেই ক্ষেত্রজ্ঞ ।
অধ্যাত্ম শব্দটিকে এককথায় বলতে গেলে বলা যেতে পারে আত্মাকে অবলম্বন করে বিদ্যমান যে শরীর ও ইন্দ্রিয় তাঁকেই ইঙ্গিত করে।
যেমন জলে না নামলে সাঁতার শেখা যায়না, ঠিক তেমনি পূর্ণ মাত্রায় ভোগ ছাড়া বোধহয় বিবেক, বৈরাগ্য, চিত্তশুদ্ধির চিন্তা ও সুক্ষ বুদ্ধির উন্মেষ হয় না। বিষয়ভোগে আছন্ন মানুষই সহজে বুঝতে পারে বিষয়আসয়ের অসাড়ত্ব এবং তখনিই তিনি সেখান থেকে মুক্তির চিন্তা করেন। কেননা প্রবৃত্তিই নিবৃত্তির দ্বার উন্মোচিত করে থাকে ।
অভিব্যাক্তি
অদ্বৈতবাদের গোড়ার কথা বলতে গেলে ঋগ্বেদ থেকে শুরু করতে হবে। যেখানে গভীর অরণ্যে বসে ভারতের প্রাচীন ঋষিরা দৃশ্যমান পৃথিবীর পশ্চাতে কোন শক্তি প্রবাহমান তার রহস্য উন্মেচনে নিজেদেরকে আহুতি দিয়েছিলেন। অবশেষে উদ্ধার করে এনেছিলেন সেই সব অমূল্য সম্পদকে, যাকে মূলধন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় দর্শন সমগ্র বিশ্বকে সমৃদ্ধ করে এগিয়ে চলছে।
পরিদৃশ্যমান পৃথিবী যেন রঙ্গমঞ্চ। বিধাতা কখন পাষান যেন, অস্ত্র সম্ভারে পরিপূর্ন তার তুন, সেখানে অলংকৃত করে আছে ঝড়,ঝঞ্ঝা, মেঘ আর বিদ্যুতের ঝলকানি, অশান্ত দাবানল আর সব কিছুকে অবলীলায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি সেই বন্যা। না জানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে তারা বর্ষিত হয় এই পৃথিবীতে, সব প্রাণী নির্বিশেষে এই ক্রোধের হাত থেকে নিস্তার পায় না। আবার সেই বিধাতাই সর্বংসহা মাতারূপে আবির্ভূত হয়ে, সে তাঁর প্রাণীদের দেহধারনের উপযোগী করে উষ্ণ আনন্দঘন ক্রোড়ে আশ্রয় দেয়। এ কেমন বিধাতা যে একই সাথে আঘাতও করে আবার সেই ক্ষতে প্রলেপ দেবারও কোন বিরাম নেই এবং সমগ্র কার্যক্রমটি ভীষণ শৃঙ্খলায় আস্টেপিস্টে বাঁধা। এই নিয়ম করে প্রাকৃতিক কার্যক্রমের পিছনের যে কোন এক পরিচালক আছেন এইটা মানুষ বিশ্বাস করলো এবং সেই অদৃশ সত্তাকে মানুষ মেনে নিলো। কার্য্য ও কারণের নিয়মগুলি সমগ্র জাগতিক ঘটনাবলীতে বাধা। প্রাকৃতিক প্রত্যেকটি কার্য্যের পিছনে নির্দ্দিষ্ট কারণ অবশ্যিই আছে।
কার্য্যের পশ্চাতে কারণ খোঁজার মধ্যে জ্ঞানের বিকাশের লক্ষণ পরিস্ফুট হয় , কার্য্য কারণ নিয়মের ক্ষেত্রে এই জ্ঞানোদয় জন্ম দেয় দার্শনিক বিচার বুদ্ধির, পরীক্ষা, বিশ্লেষণমূলক চিন্তা ভাবনার। এই চিন্তা ভাবনার সূত্রগুলি বৈদিক সাহিত্যের মাধ্যমে গোচরে আসে।
ল' অফ কর্ম
দিনের পর রাত, আবার রাতের পর দিন, দিনের আকাশ যেমন সূর্যের দখলে আবার রাত ঘনালে চাঁদ, তারার হাতে সে বন্দী, সূর্যের আলোর রেশ বিন্দুমাত্র নেই। বিরামহীনভাবে এই চক্র ঘুরছে। এই প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর পিছনে যেই অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে , তাকেই বিভিন্ন দেবতাদের নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রক হিসাবে ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির এই শৃঙ্খলাকেই ঋত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বেদে তাই বলছে, এই ঋতকে জানতে পারলে অন্ত ও বহিঃ প্রকৃতির আসল রহস্য জানতে পারা যায়। এই সদাই বহমান বহিঃ প্রকৃতির ঋত বা মৌলিক তত্ত্ব জানতে পারলে ক্রিয়ার স্বরূপ ও কর্মনীতিকে ( Law of Karma) বোঝা যায়।
এই জগতের পরিপূর্ন বৈচিত্রতাকে বোঝাতে গিয়ে কাল্পনিকভাবে দ্যুলোক, ভূলোক এবং অন্তরিক্ষলোক এই তিনভাগে বিভক্ত করে এই কাল্পনিক ভুবনগুলিতে দেবতাদের প্রতিষ্ঠিত করে তাদের সীমারেখাকে নির্দ্দিষ্ট করে দেবার মধ্যে ঋষিরা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরেই ভিত্তি করেছিলেন। এর কারণ অনুসন্ধান করে বলা যায়, প্রকৃতির অভিমুখ কোন নির্দিষ্ট ধারায় বহমান নয়, ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সে প্রবাহমান। সেই ধারাকে নিয়ে চর্চা করতে গেলে কতগুলি মুখের প্রয়োজন হয়েছিল (নাম ও রূপ দিয়ে আলাদা করে বোঝানো)। সেই মুখগুলিই অভিষিক্ত হয়েছিল কর্ম অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের নামে আর এই নামের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করেছে প্রকৃতির কার্যক্রমগুলিকে তাদেরই মহিমা হিসাবে। এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় বৈদিক ঋষিগণ কখনই জড়ের উপাসক ছিলেন না।
বহুত্বের ধারণার অসাড়ত্ব -
অখন্ড শক্তিকে খণ্ডিত আকারে দেবতাদের মধ্যে ভাগ করাতে শক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে বহুত্বের ধারণা আসতে পারে। বৈদিক যুগে অগ্নি, ইন্দ্র, বায়ু ইত্যাদি নানা নামের মধ্যে যে দেবতা বাস করেন, তিনিই পরম দেবতা। কারণ এই জগৎ সংসারে এক চৈতন্যময় মহাশক্তি, যিনি জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে, দেবতা, মানুষ, পশু , সূর্য্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রে তথা সমগ্র চরাচরে নানা রূপে, নানা ক্রিয়ায় ব্যক্ত হচ্ছেন। এই বহুত্বের মধ্যে একত্বের সন্ধান বৈদিক ঋষিরা এই সত্য প্রত্যক্ষ করছিলেন।
প্রতীকী দেবতা
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় কি ভাবে এই অখন্ড শক্তিকে তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বরুণ জলের প্রতীকী দেবতা। যখন এই বরুণ দেবতাকে স্তব করে বলছেন - "হে বরুণ ! সমুদ্র জলে ব্যাপক তোমার যে তেজঃ শক্তি আছে সেটাই আবার অন্তরীক্ষে সূর্য্য মন্ডলের মধ্যে কাজ করছে। সেই অন্তরীক্ষ থেকে সূর্য্য একধারে স্থলে অভিষিক্ত হয়ে কখন প্রাণীর দেহে অগ্নিরূপে উত্তাপ ছড়ায় , প্রাণীর অন্তরের প্রাণের প্রদীপ জ্বলিয়ে তার দীর্ঘসূত্রিতায় সাহায্য কর, আবার তুমিই মেঘের কারণ হয়ে বিদ্যুৎরূপে বিরাজ কর। রণভূমিতে বীরের শোনিত রক্তে বহে তোমারই শৌর্য্যশক্তিতে ।
'ব্রহ্মই সত্য ও জগৎ মিথ্যা'
দীর্ঘদিনের অব্যবহার্য্য আয়নাতে ময়লার আবরণ যে ভাবে পরিপূর্ন হয়ে থাকে, সেই আয়নাতে মানুষ নিজের প্রতিবিম্বকে সঠিক ভাবে দেখতে যেমন পারেনা, ঠিক তেমনি মনের উপর মলিনতা জমে থাকলে নিজের মধ্যে আত্মার উপস্থিতি অনুভব করা যায় না। এই অসচ্ছতা থেকে জন্ম নেয় ভ্রান্তির, যাকে মায়া বলে অবিহিত করা হয়। আবার সাধক যখন তাঁর দীর্ঘ সাধনা যাত্রার প্রান্তে এসে উপলদ্ধি করেন এই জগৎটি মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়, তখনিই মনের অন্দরের সমস্ত অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে গিয়ে একরাশ আলোকবর্তিকার উন্মেষ হবে, তার সাথে সাথে মুক্ত করবে তাঁকে মায়ার ছলনা থেকে এবং পরিসমাপ্তি ঘটবে তাঁর অন্বেষণ, আত্মা বা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করে ।
জগতের আপেক্ষিপ সত্তা
আপাত সত্য অর্থাৎ চিরন্তন সত্য নয় ,এই আপেক্ষিকতা কিংবা এক বস্তুর সাথে অপর বস্তুর প্রতি ততক্ষন পর্যন্ত নির্ভরশীল, যতক্ষন পর্যন্ত অপর বস্তুটি নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে।
স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দেশ্য ছিল বেদান্তের অদ্বৈততাকে প্রমান করা এবং মানুষের জীবনে সেই ধারণাকে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা। দ্বন্দ্ব একটি নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। জগৎ যেমন এই দ্বন্দ্বের ফসল, ঠিক অদ্বৈত বেদান্তও অনুরূপ প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত একটি দার্শনিক তত্ত্ব। বহু যুক্তি তর্কের বেড়াজালকে অতিক্রম করে এই অদ্বৈত বেদান্তের ধারণার জন্ম হয়েছিল আচার্য শঙ্করের মতাদর্শ ও যুক্তির উপর, যা স্বামীজিকে আকর্ষিত করেছিল। আচার্য শঙ্কর জগতের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রহ্ম ও মায়াকে নির্দেশ করেছেন।
চলবে ..............
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ১৫/০১/২৫
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ