(২৪১) কৃষ্ণ বলয়


(২৪১) কৃষ্ণ বলয় 


শ্রীরামকৃষ্ণের কালী তত্ত্ব আর লর্ড কেলভিনের  ডার্ক ম্যাটারের মধ্যে আদৌও কোন ব্যবধান আছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কৃষ্ণ বলয়ে প্রবেশ -

কালো শব্দটা  বোধহয় ভীষণ বিতর্কিত। না পারা যায় তাকে গ্রহণ করতে আবার তাকে বর্জন করা অসম্ভব। জ্ঞানের রং যদি সাদা হয়, তাহলে  অজ্ঞানের  রংটি অবশ্যিই কালো কিংবা অন্ধকার, যা যে কোন প্রাণীর পক্ষে সেটি ভীষণ বিপদজ্জনক।  সেখানে কেউ যদি প্রমান সহকারে বলে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে এই কালোরই  জয়জয়কার, কেননা ডার্ক ম্যাটারই বল আর ডার্ক এনার্জিই বল, এরা সম্মিলিতভাবে এই আলো আঁধারি  জগতের ৯৫ শতাংশ দখল করে রেখেছে। তারাই শক্তিমান।

 শ্রীরামকৃষ্ণ এই কালোর প্রতিভূ মাকালীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন জগতের যাবতীয় শক্তি। এহেন এই বাস্তবতাকে বস্তু এবং আধ্যাতিক জগৎ উভয়েই যেখানে তাদের যুক্তি দিয়ে এর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, তার প্রতি কৌতূহল জাগাটা ভীষণ স্বাভাবিক। চলুন, এবার যাওয়া যাক সত্যান্বেষীদের হাত ধরে তাঁদের  বিচার ধারার স্রোতে নিজেরা  একটু  অবগাহন করি। 

বস্তুকে গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে  সর্বজনগ্রাহ্য একটি পদ্ধতি থাকা বাঞ্চনীয়, হোক না তার মাধ্যমটি  বিচার । অন্ধকার নামক শব্দটি অজ্ঞানতার একক রূপ, তার অজানিত ও অভাবনীয় সম্পদের সীমাহীন অস্পর্ধায়  যুগ যুগান্ত ধরে সব ধরনের জীবসহ মানুষের সম্ভ্রম সে আদায় করে নিয়ে চলছে। সেই নিয়ে বিজ্ঞান পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে  তার বস্তুনিষ্ঠ সাধনায় আর দর্শন ও অধ্যাত্বিকতা তার অনসুন্ধান চালাচ্ছেন তাদের নির্দ্দিষ্ট পথে। লক্ষ্যবস্তুটি এক, কিন্তু যাত্রা পথটি ভিন্ন। ওপারে, সত্য উদ্ঘাটনের তথ্য জানার জন্য একদল উৎসাহী দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। 

  সুদূরের ঐ  আকাশপানে আঁখি মেলে অনন্তের আহবানে দৃষ্টির ডানা  ক্রমেই দূরত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথমে একটু হালকা নীল, তারপরে সে যেন আরো ঘন থেকে ঘনতর হয়ে নিকষ কালো অন্ধকারে বিলীন হয়ে সে প্রবেশ করলো সেই প্রান্তে যেখানে চেতনার প্রবেশ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ। 

সেই অন্ধকারে কি আছে ?  সৃষ্টির শুরু থেকে সেই প্রশ্ন নিয়ে মানুষ চলতে শুরু করে ছিল আজও তার ব্যাঘাত ঘটে নি।  কিছু জানা আর অনেককিছু  অজানাকে  নিয়ে  এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের দেহ সৌরভ। এক দিকে আলো আর অন্য দিকে শুধুই গাঢ় অন্ধকার। 

চেতনার এই ব্যাতিক্রমী উপস্থাপনা  নিয়ে সাধারনের মনে এই প্রশ্নের উদয় কখন যে হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা, বরং ভেবেছে, মনে মনে বলেছে, 'প্রকৃতির রাজ্যে বোধহয় এমনটি হয়েই থাকে'। কিন্তু অনুসন্ধিৎসা মানবের দুরারোগ্য ব্যাধি; তাই তাকে নিরাময় করার বাসনায়  শুধুই  এগিয়ে যাওয়া। একে একে অজ্ঞানের  সিঁড়ি ভাঙা আর সেই সঙ্গে সিঁড়ি উত্তরণের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যার অবতারণা। কেউবা, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোন থেকে তার ব্যাখ্যা  দিচ্ছেন আবার পদার্থ বিজ্ঞান বিশ্লেষণ করছেন সেই একই বিষয়কে বিজ্ঞানসম্মত কারণ দেখিয়ে। উভয়েই কিন্তু   বিশ্বাসযোগ্য এজাহার  পরিবেশন করে আসছেন। 

 অরূপের স্বরূপ উন্মোচনের বিষয়বস্তু হল "ডার্ক ম্যাটার", তাঁকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই দীর্ঘতম বিবরণের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের   পরিক্রমা হচ্ছে বিজ্ঞান এবং দর্শন ও  অধ্যাত্ম জগতের প্রমান ও অনুমান আর উপলদ্ধিকে  নিয়ে।  বস্তু জগতে প্রাণপাত করছেন পদার্থ বিজ্ঞানীরা তার রহস্য উন্মোচন করতে।  দর্শন আর অধ্যাত্বিকতা একে অন্যের সাথে অনেকাংশে পরিপূরক।  উভয়েই সত্য, চেতনা ও অস্তিত্বের সন্ধানে নিয়োজিত। আধ্যাত্বিক জগতে ব্যক্তিবিশেষের বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে কিংবা উঠতে পারে।  

বস্তু জগৎ  এবং আধ্যাত্বিক জগৎ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই "ডার্ক ম্যাটারে"র ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  পদার্থ বিদ্যার "ডার্ক ম্যাটার" বা কৃষ্ণ বিজ্ঞান  আর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের মা কালী তত্ত্ব এই দুটিকে নাম আর রূপ দিয়ে তাকে  যতই ভিন্ন করা হোক না কেন, কোন এক জায়গায় এসে তাঁরা  মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কেননা সত্য বস্তুর কোন ভিন্ন রূপ হয় না। 
 
শূন্যের করি জয় - এই সেই শূন্য যাঁর নির্গুণ রং ঘন নীল বা দৃশ্যতঃ কালো।  যাঁকে পদার্থ বিদ্যা বলে ডার্ক ম্যাটার আর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বলেন মা কালীর রূপ, যেখানে ব্রহ্মের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সাথে যথেষ্ট মিল আছে আবার সময় বিশেষে পরিবর্তিত রূপে আবির্ভূত হয়ে ধ্বংস প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহনের লীলায় পিছপা হন না। তার যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক  ব্যাখ্যা খুঁজতে ঘটনার গভীরে প্রবেশ। 

যে  সব বস্তু আলো শোষণ বা বিকিরণ করে না, তখন সেই ধরনের বস্তুকে পর্যবেক্ষন করা অসম্ভব, শুধুমাত্র অনুভবই তাঁর অস্তিত্ব জাহির করে। তাই তো আজও সে রহস্যময়ী। বিজ্ঞানের জানার পরিসরে প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেক্ট্রন জাতীয় কোন পদার্থের উপস্থিতি সেখানে নেই, হয়তো নতুন ধরনের কণিকার উপস্থিতি আছে, যা এখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত।  

কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা মহাবিশ্বের গঠনকে পরিমাণের অংকে ভাগ করতে  গিয়ে ২৭% ডার্ক ম্যাটার, ৬৮ %  ডার্ক এনার্জি এবং ৫ % দৃশ্যমান বস্তুর পরিমান  পেয়েছেন। অর্থাৎ ৯৫% ভাগই ডার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত। 

প্রমান, অনুমান আর উপলদ্ধিতে  বস্তু আছে অথচ সে অদৃশ্য তাকে নিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিনের ডার্ক ম্যাটারের সাথে শ্রী রামকৃষ্ণের কালী ভাবনার কোথায় কতটুকু মিল কিংবা অমিল রয়ে গেছে, সেটাই এই নিবন্ধের উপজীব্য বিষয়। 

যদিও ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও সম্পূর্ণরূপে অবগত নন। এটি রহস্যময় এবং এর প্রকৃতি এখনো অজানা।   

যে পদার্থ  প্রত্যক্ষ করা যায় না কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায়, সেই প্রশ্নের  অবতারণা করে লর্ড কেলভিনের ডার্ক ম্যাটার তত্ত্বটি  অদৃশ্যতার ধারণার চিরাচরিত ভাবনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।  

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছে বলে মনে করা হয়, যদিও এটি প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। 

কালী বা শাক্ত দর্শনে কালীকে সৃষ্টির মূল শক্তি বা আদ্যাশক্তি বলা হয়, যাঁর দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি টিকে থাকে। 

শ্রীরামকৃষ্ণের কালী ভাবনায় মা কালীকে দেখা যায় না, তবে তাঁর শক্তি ও উপস্থিতি অনুভব করা যায়। কালীকে মহাশক্তি বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোপন চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি  অধ্যাত্বিকতার ব্যক্তিগত উপলদ্ধির দৃষ্টান্ত। কালী বা শাক্ত দর্শনে কালীকে সৃষ্টির মূল শক্তি বা আদ্যাশক্তি বলা হয়, যাঁর দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি টিকে থাকে। 

ভারতীয় প্রাচীন দর্শন সাংখ্যের মতে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পিছনে পুরুষ ও  প্রকৃতি তত্ত্বটি মূল তত্ত্ব। একই সত্ত্বার দুটি পরিবর্তিত রূপ হলো জড় পদার্থ এবং শক্তি। এরা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাহলে পুরুষ আর প্রকৃতিকে আলাদা ভাববার কোন কারণ বেদান্তবাদীরা দেখতে পারছেন না। বেদান্ত বলেছে, বিশ্বের যা কিছু শক্তির নাম 'প্রাণ' আর সব ধরনের পদার্থ হলো আকাশ।  

অদ্বৈত বেদান্ত বলে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কোন ছোট ছোট পৃথক কণার দ্বারা তৈরি  হয়নি। এটি একটা সিঙ্গেল হোমোজেনিয়াস থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং সে স্থান ও কালের অতীত। 
২৬টি কণা এবং ৪ টি শক্তি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মডেলটি দাঁড়িয়ে আছে। অদ্বৈতবাদীরা দাবি করে  থাকেন বিশ্বের উৎপত্তির পিছনে শুধুমাত্র একটি  পদার্থকে লক্ষ্য করা যায়। এটি অপরিবর্তনশীল, এটি কোন কণাও  নয়, তরঙ্গের অভিঘাতও  এখানে অনুপস্থিত। স্থান ও কালের উর্ধে। অদ্বৈত বেদান্তের চরম পদার্থই 'ব্রহ্ম' নামে পরিচিত।  
বিজ্ঞানের প্রেক্ষিত হল  পরমাণু সংক্রান্ত তত্ত্বের আলোকে বিশ্বের মৌলিক উৎসকে অন্বেষণ, সেখান বার বার অসম্পূর্ন থেকে যাচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এসবের বাইরেও একটা সিঙ্গেল সাবস্টেন্স আছে, আর সেটাকে নিয়েই  অদ্বৈতবেদান্তের চরম পদার্থের অবতারণা।  এই চরম পদার্থকেই বলেন ব্রহ্ম। এটাই চেতনা, যার আলোকে ব্রহ্ম দর্শন হয়। 

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের কালী তত্ত্ব হঠাৎ করে উঠে আসা কোন ধারণা নয়, এর পিছনে কয়েক হাজার বছরের  এক সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। সমগ্র সময়ের যাত্রায় রয়ে গেছে সত্যকে অনুসন্ধান আর তাকে প্রকাশের ব্যাখ্যায়। যেখানে বস্তু সম্পর্কিত ধারণা ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হয়, তাই সে কখনো নিত্য বস্তু হয়ে উঠে না। কিন্তু ব্রহ্মের কোন পরিবর্তন সংঘঠিত হয় নি, তাই সে নিত্য। বেদান্তের অদ্বৈত তত্ত্ব আর সাংখ্যর পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্ব দীর্ঘ যুক্তি প্রক্রিয়ার অন্তে একাকার হয়ে যায়।  

ভিন্ন ভিন্ন  ধারাকে যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে একই ছাদের তলায় যখন তাদের মিলনভূমি গড়ে ওঠে তখন যে সুরের সৃষ্টি হয় সেটাই ঐকতানের সুর।  শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মভাবনা তারই জীবন্ত নিদর্শন। সব ধর্মের মূল সুর তখনিই একত্রিত হতে  পারে, যখন দ্বৈত ভাবনা ঘুচে গিয়ে অদ্বৈতভাবনা গৃহীত হয়। সব ধর্মের অন্দরমহলে ঢুকে অন্তর্নিহিত সত্যের একত্বের প্রকাশকই শ্রীরামকৃষ্ণের  বাণী। এই একত্বই নির্দ্দেশ করে সমগ্র ব্রহ্মান্ডকে, এটিই একটা  অবিসংবাদিত বিশ্বজনীন চেতনা। এটিই অদ্বৈতবাদের মূল সুর। 
ধরাবাঁধা জীবনের জাল ছিড়ে অধ্যাত্ম জীবনে প্রবেশ করলে প্রথমেই যেটা অনুভূত  হয়, সেটি হলো বেদান্তের শোনিত রক্তধারার স্রোত আর সেই-ই যেন বেঁধে রেখেছে সেই অধ্যাত্ম সংসারকে। এই অনুভূতি বইয়ের ছাপা অক্ষরের সীমাব্ধতাকে অতিক্রম করে  অসীমকে আলিঙ্গন করতে চায়। 
 
বিশ্বজনীন ধর্ম কোন আবাদি জমি নয় যে তাকে মতবাদ কিংবা সম্প্রদায়ের আল তুলে দিয়ে  তার অসীমতাকে সসীম রূপ দেবে। ধর্ম কোন নামাবলী নয়  বরং  একটা সার্বজনীন অনুভূতি। এটাই ছিল শ্রী রামকৃষ্ণের ধর্মভাবনার অভিনবত্ব।  
 
বনের পশু-পাখিরা নিজ নিজ অনুভূতিকে  স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় কখন উচ্ছ আবার কখন বা মৃদু সুরে তাদের অভিব্যক্তি  জানায়, তাকে নিয়ে কোন বাদ - প্রতিবাদ  সংগঠিত হয়েছে বলে জানা যায়নি। সৃষ্টি কর্তা যে স্বাধীনতা তার জীবদের দিয়েছেন, তারা সঠিকভাবে সেটা পালন করছেন, সেটাই জীবের ধর্ম। কিন্তু এই স্বাধীন ধর্মাচার ও মতবাদ সভ্য সমাজে বিরল। অর্থাৎ রাষ্ট্র কিংবা সমাজ যে সুর বেঁধে দিয়েছে, সাধারণকে সেই সুরেই গাইতে হবে, নচেৎ শাসকের খাঁড়া বেসুরো গায়কের গর্দানে পড়বে, এটাই এখানকার রীতি।  তাহলে কি সভ্য সমাজ  আসলে একটা কাগুজে সভ্যতার  আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা আগাপাছতলা অসভ্য সমাজ, যেখানে বিভাজনই  হচ্ছে একমাত্র শাসকের শক্তি।

কোন বিশেষ প্রতীকের সামনে বসে মানুষ তার মনকে  একত্রিত করতে পারলে সে ধীরে ধীরে সেই প্রতীকের ওপারে যেতে সক্ষম হবে।  একাগ্রতার অভ্যাসের জন্য প্রতিমা পূজার বিশেষ ভূমিকা আছে।  

নির্দ্দিষ্ট মতবাদ বা সম্প্রদায়ের হাতে বন্দী ধর্মকে মুক্ত হাওয়ায় মেলে দেবার  পিছনে শ্রীরামকৃষ্ণের বিশাল ভূমিকা আছে। 

এক মাকালীর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ধ্যান করে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলদ্ধি  করেছেন, তৎসত্ত্বেও নৈর্ব্যক্তিক (অপৌরুষেয় ) ঈশ্বরীয় ধারণাকে অস্বীকার করেন নি। 
ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা - এই বেদান্তের মূলভাবকে উপলদ্ধি করার জন্য  বেদান্তগ্রন্থ পড়ার প্রয়োজন নেই। বেদান্ত ভারতীয়দের আধ্যাত্মিক প্রাণবায়ু। যাঁকে অন্তরে গভীরভাবে কান পাতলে শোনা যায়। 

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুইই | যেমন, এই বিশ্বে অনন্ত জলরাশি যার কুলও নেই কিনারা নেই, আবার কোন স্থানে ভীষণ ঠান্ডায়  সে জমে বরফ হয়ে গেছে। ঠিক যেমন ভক্তি-জমে গিয়ে বরফের আকার ধারণ করে।  আবার সেই বরফ প্রচন্ড সূর্য্যের তাপে সেই বরফ  গলে যায় - যেমনটি আগে ছিল ঠিক তেমনটি জল হয়ে যায়। ঠিক  সেইমতো বিচার আর জ্ঞানের পথে গেলে সাকার রূপের জায়গায়  সবই নিরাকার মনে হয়। জ্ঞানসূর্যের আলোকে আপাত অস্তিত্বের অস্তিত্বহীনতা প্রতীয়মান হয়, যাকে বলা যেতে পারে সাকার থেকে নিরাকারে উত্তরণ। 

পদার্থ বিজ্ঞানের সাথে  আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু ব্যতিক্রম তো থাকবেই। যেখানে  লর্ড কেলভিনের ডার্ক ম্যাটার একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা পর্যবেক্ষণ ও গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এটি পদার্থের এমন একটি রূপ যা তত্ত্বীয় এবং গাণিতিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে।  সেখানে রামকৃষ্ণের কালী ভাবনা পুরোপুরি আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক। এটি বিশ্বাস, অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার মিশেল। সেখানে নেই কোন গাণিতিক মডেল কিন্তু যে অনভূতি দিয়ে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বকে  বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করেছেন ঠিক সেই অনুভূতির সাথে বিশ্বাস আর অভিজ্ঞতার আলোকে রামকৃষ্ণ মা কালীকে  উপলদ্ধি করেছেন। 

ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের গঠন ও বিকাশে প্রভাব ফেলে, এটি একটি নিরপেক্ষ পদার্থ যা মহাকর্ষীয় প্রভাব তৈরি করে।

কালী ভাবনা আধ্যাত্মিক মুক্তি এবং ব্রহ্মাণ্ডের গূঢ় সত্য উপলব্ধির জন্য। কালীকে মায়া ভেদ করে সত্য উপলব্ধি করার পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখা হয়। 

ডার্ক ম্যাটার পুরো মহাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বস্তুগত ধারণা। 

কালী ভাবনা প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে, যদিও এর দার্শনিক দিকটি বিশ্বজাগতিকও হতে পারে। 

দুইটি ভিন্ন ধারার মধ্যে কোন দ্বন্দ নেই কিন্তু কিছু ধন্ধ আছে। লর্ড কেলভিনের ডার্ক ম্যাটার এবং রামকৃষ্ণের কালী ভাবনার মধ্যে মিল হল উভয়ের রহস্যময় প্রকৃতি ও মহাজাগতিক গুরুত্ব। তবে অমিল হল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্য। ডার্ক ম্যাটার জড়বিশ্বের একটি গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, আর কালী ভাবনা আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অভিজ্ঞতার একটি প্রতিচ্ছবি। 



ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ - ০১/০২/২৫

 https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৩৩) একটি ফোঁড়ার জন্মবৃত্তান্ত -

(২৩২)বোধোদয়