(২৪৬) মহাভারতের অন্দরে ও বাহিরে - প্রথম পর্ব
(২৪৬) মহাভারতের অন্দরে ও বাহিরে - প্রথম পর্ব
মহাভারতের অতল জলরাশি
মহাভারত আসলে যেন অতলান্তিক সমুদ্রের বিস্তীর্ন জলরাশি, কত যে প্রাণী সেখানে বাস করে তার ইয়ত্তা নেই। তাদের মধ্যে কেউ বা সহিংস আবার কেউ বা অহিংস কিন্তু সবারই আশ্রয়স্থল সেই সমুদ্র। যেখানে ছোট বড় বহু নাম না জানা নদীর শেষ গন্তব্যস্থল সেই মহাসাগরে। এক একটা নদীর এক এক ধরনের চরিত্র। কেউ ভীষণ খরস্রোতা, কেউ বা পাথরের বারংবার আঘাতে শেষের মাঝে তারা যে অশেষ তাই তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে কোন ভুল হয়নি। জলের তোড়ে ভেসে আসা অন্য কোন উপাদান মূল স্রোতের সাথে বারবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিলিত হতে চায় সাগর তাকে জায়গা দেয় কিন্তু মিশতে দেয় না। কেননা তেলের সাথে জলের জন্ম জন্মান্তরের ব্যবধান। ব্রাহ্মণ্যবাদ বৌদ্ধের উদারতার কাছে পর্যদুস্ত হয়ে ক্ষয়িষ্ণু গৌরবকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অতীব জনপ্রিয় মহাভারতের অন্দরে প্রবেশ করতে উদ্দত হয়েছে। কতখানি মহাভারতের মৌলিকত্বকে কলুষিত করতে পেরেছে তারই জন্য অনুসন্ধান।
মহাভারত সারা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সম্পদ, এত বেশি উপাদানের বিচিত্রতা তাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের শিরোপাতে ভূষিত করেছে। তাই সেই সম্পদকে ঐতিহাসিকরা খুঁজেছে তাদের ভাবনার আঙ্গিকে , সাহিত্যিক খুঁজেছে তার সাহিত্যের উপাদান, সমাজবিজ্ঞানীরা মহাভারতের সামাজিক রীতিনীতির কতখানি রেশ রেখে গেছে বর্তমানের কাছে, সেটাই তাদের বিবেচ্য। তাছাড়া আচার-আচরণ, মূল্যবোধ, ধর্ম, আর্য্য ও অনার্য্যের মধ্যে যুযুধান অবস্থান থেকে সরে এসে পারস্পরিক আলিঙ্গনবদ্ধ হবার সূত্র। মহাভারতের সমাজ জীবনে যৌনতার মানচিত্র ও তার সামাজিক প্রভাব। কেননা একমাত্র যৌনতাই আর্য্য-অনার্য্য , উচ্চ-নীচ, সংকীর্ণ বর্ণ ভাবনার মতো অসামাজিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে এক অদ্বৈত ভাবনার জন্ম দিয়েছে। মহাভারতের সমাজে নারীর আসন , ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কর্মের অভ্যাস ইত্যাদি। তাই মহাভারতের অলিন্দে সারা বিশ্বের পণ্ডিত সমাজ বারবার হানা দিয়েছে তার মৌলিকত্বের খোঁজে। কেননা তাঁরা জানতেন শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে যাওয়া ইতিহাসে এক শ্রেণীর মানুষের অগৌরবের কার্য্যকলাপকে মহাভারতীয় মাধুয্যে দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা চালাবে, তাকে ইঙ্গিত দিতে।
ভারতবর্ষের ইতিহাস সংরক্ষণের শ্রেণী বিন্যাস
"ভারতবর্ষের কোন প্রাচীন ইতিহাস নেই" - এই কথাটি মাঝে মাঝে ভারতীয়দের শুনতে হয়। আসলে পুরাণই ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস। কাহিনীর বিন্যাসে প্রাথমিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে সর্বশেষে কেন্দ্রীয়করণ হয়ে তাকে লিপিবদ্ধ করা এবং পরিশেষে তার দীর্ঘজীবনের জন্য ধর্ম পুস্তকের বেশে পুরাণকে উপস্থাপন। কেননা পুরাণবিদরা জানতেন ভারতবাসীর কাছে ধর্ম পুস্তকের একটা বিশেষ জায়গা আছে আর বহু ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে বুকে ধরে পুরাণরুপী ইতিহাসকে তাঁরা বাঁচিয়ে রাখবে ।
সেই সময়ে বহুধা বিভক্ত ভারতবর্ষে বহু ছোট- বড় রাজার রাজত্ব ছিল। প্রত্যেক রাজদরবারে 'মাগধ' নামক একশ্রেণীর রাজকর্মচারী থাকতো। তারা সেই দেশের রাজাদের বংশপরিচয় থেকে শুরু করে তাদের কীর্তিকলাপ সংরক্ষন করে রাখতেন। 'সূত' নামক এক সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা যজ্ঞস্থানে সেই কাহিনী পাঠ করতেন। শুধু তাই নয়, এনারাই বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ঘুরে মাগধদের কাছ থেকে সমসাময়িক ঘটনাবলী সংগ্রহ করতেন। সেই সময় যজ্ঞ ছিল একধরনের মিলনমেলা। সেখানে উপস্থিত হতেন ঋষি এবং বহু আমন্ত্রিত রাজা ও গন্যমান্য অতিথিগণ। সূত'রা সেখানে কাহিনী পড়তো আর এক শ্রেণীর ঋষির উপর দায়িত্ব ছিল সেই কাহিনীগুলিকে লিপিবদ্ধ করা। এইভাবেই পরম্পরাপ্রাপ্ত সুতকাহিনী ঋষিদের দ্বারা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হলো, তখন জন্ম হল পুরাণের। সেটাই ভারতের ইতিহাস।
মহাভারতের বেনোজল প্রবেশের অন্তরালে
হৈ হৈ করে ধেয়ে আসা বৌদ্ধধর্মের প্লাবনে হিন্দু ধর্মের গোড়ামীর গেরোটা যখন ক্রমশই দুর্বল হয়ে উঠছিলো, তখন বড্ড বেশি দরকার হয়ে পড়েছিল একটা সুদৃঢ় ঢালের। ব্রাহ্মণ্যবাদিরা, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মহাভারতের আঁচলকে আঁকড়ে ধরল। এহেন আপামর ভারতীয়দের কাছে এবং তার বাইরেও মহাভারতের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। তাই একে ধরেই হয়তো হারানো গৌরবকে ফিরে পাওয়া যেতে পারে। সেই উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদ তাদের কাহিনীকে রঙে-রসে পূর্ণ করে মহাভারতের দেওয়ালে রাঙ্গিয়ে দিলো।
আসলে মহাকাব্যটি দূষিত হবার পূর্বে এটি ক্ষাত্রইতিহাস ছিল। আর ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধ ছাড়া কি ই বা আছে , তাই তার বুননিটা যুদ্ধ-বিগ্রহ দিয়ে মোড়া। অপরিণত কলমের অনুপ্রবেশ মহাভারতে, মহাভারতের পাণ্ডুলিপির সাথে বর্ধিত মহাভারতের অমিলগুলিকে তুল্যমূল্য বিচার করলে অনায়াসে তাকে এডাল্টেশনের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। এর অসংখ্য উদাহরণ অনুশাসন পর্বে লক্ষ্য করা যায়। আসলে মহাভারতে অনুশাসন পর্বটি আদৌ ছিল কিনা সেটাই বিচার্য্য। অনুসন্ধান চলছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং পন্ডিতদের রেখে যাওয়া পত্রালোকে। আগামী দিনে সেটি ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
চলবে ০০০০০০০০
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ১২/০২/২৫
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ