(২৪৮) আমি মহাভারতের সত্যবতী -
(২৪৮) আমি মহাভারতের সত্যবতী -
একে একে পাড়িরা সবাই চলে গেছে ঘর পানে । জনমানবশূন্য ঘাটে একাকী এক কুমারী অনেকক্ষন ধরে নৌকার গলুইয়ের প্রান্তে উপবেশন করে আছে। আকাশের রক্তিম পরশ ঘোষণা করছে সন্ধ্যা আগত প্রায়। যমুনা দিয়ে বয়ে যাওয়া জল কখন যেন তার রং নীল থেকে আরো ঘন নীলাকার হয়ে উঠেছে। উর্ধাকাশে উড়ে যাওয়া ঘরমুখী পাখিদের সঙ্গবদ্ধ ডানা সঞ্চালন যেন নদীর ঢেউয়ের উঠানামার সাথে তাল মিলিয়ে এক অপরূপ সুরের মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে। তাঁর দৃষ্টিতে রয়েছে একরাশ শূন্যতা, সে যেন আকাশের মেঘের সাথে সখ্যতা করে অসীমের পানে ধেয়ে যাচ্ছে।
কবে কোন প্রত্যুষে জীবিকার তাগিদে হাতে বৈঠা তুলে নিয়ে নিত্যদিনের যাত্রীদের পারাপারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সেই কাজের অবসরে কখন যেন জীবন থেকে কৈশোর চলে গিয়ে যৌবন দ্বারে এসে কড়া নেড়েছে, এখনও সে তা মনে করতে পারেনা। আজ পাড়ে বসে আর যাত্রীর জন্য অপেক্ষা নয়, আজ তাঁর নারী জীবনের পূর্ণতার প্রতীক্ষা।
দেখতে দেখতে যমুনা নদীর ছোট কখনো বা বড় ঢেউরা একে একে পরস্পরের সাথে আলিঙ্গন করে সুখের তরে নৃত্য করতে করতে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। নদীর এই ছন্দের সাথে তার জীবনের যে বড্ড অমিল রয়ে গেল। কিন্তু অন্তরে তার সদাই সলিলের ফল্গুধারা ক্লন্তিহীনভাবে বয়ে যাচ্ছে। একদিন তাকে চুপি চুপি প্রশ্ন করছে, কবে তার জীবনতরী ঘাটে এসে ভিড়বে আর সেই ডিঙি থেকে মাঝি কিনারায় এসে হাত বাড়িয়ে তাকে আহবান করবে, আর তির্যক চোখ বলবে, বেলা যে যায়, এবার তোর ঘরে চল ।
তাঁদের সেই স্বপ্নের তরী নোঙ্গর করবে জনমানবহীন কোন এক নির্জন স্থানে। যেখানে রাত পোহালে, বনমোরগের একটানা বিউগলের শব্দ ভোরকে স্বাগত জানাবে , তার পর নিত্য দিনের মতো একে একে অন্যান্য পাখিকুল তাদের উড়তে না পারা সন্তান-সন্ততিদের ক্ষুদ্র কুটিরে রেখে বাঁচার সন্ধানে পাড়ি জমাবে নাম না জানার দেশে। দিনমনি ধীরে ধীরে খুব যত্ন করে ডালপালা সরিয়ে গৃহের চৌহদ্দিতে গুটি গুটি পায়ে তার আলোর রোশনাই নিয়ে গৃহের বেড়াটা টপকে এগিয়ে যাবে দ্বার প্রান্তে। দরজায় ভোর এসে নাড়া দেবে। নিত্যনতুন কাজের মেলায় গা ভাসিয়ে কখন যেন দিন তার আজকের মতো সমাপ্তি ঘোষণা করবে। সেই সঙ্গে আকাশ ভেঙ্গে রাতের জন্য অপেক্ষারত চাঁদ-তারারা ঝুলিতে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে আবার সেই গাছের ডাল আর পাতাকে যত্ন করে সরিয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বপনের আলোতে ভরিয়ে দেবে তাদের উঠানটাকে। বাড়িটা থাকবে একটুকরো কিন্তু তার প্রাচীরটা থাকবে শুধুমাত্ৰ গভীর ভালোবাসা দিয়ে মোড়া, জানলা দিয়ে শুধু অনাবিল আনন্দের বুদ্বুদগুলি বাষ্পায়িত হয়ে আসাযাওয়া করবে আর গৃহের বাইরে থাকবে পরিখা, তারা নজর রাখবে অনাসৃষ্টি যেন গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে।
হঠাৎই সম্বিৎ ফিরে এলো পালিত পিতার ডাকে। কল্পনাকে ঘাটে জমা রেখে গৃহ অভিমুখে নৌকা যাত্রা করলো। নিস্তরঙ্গ জীবননদীতে বিধিবদ্ধ ঢেউয়ের আনাগোনা চলতেই থাকলো। নিত্য কত যাত্রীর স্বপ্নকে এপার থেকে ওপারে নিয়ে যেতে হয়, তার কোন ইয়ত্তা নেই। এমনিই এক নিস্তরঙ্গ জীবনে ঝড় উঠলো আদ্রিকা কন্যা মৎসগন্ধার জীবনে।
সেই একদিন, ঋষি বৈশিষ্ঠের পৌত্র ঋষি পরাশর একে একে বহু তীর্থস্থান দর্শন করে অবশেষে আশ্রমে ফিরবার জন্য খেয়াঘাটে এসে উপস্থিত হলেন। এই সংযোগটা ছিল মহাভারতের ভবিতব্য। এখানে এসে ঋষির সাথে মাঝিরূপী মৎসগন্ধার সাথে সাক্ষাৎ ঘটলো। এ যেন অকালে বসন্তের আগমন, ঋষির মনে হল যে নিরন্তর তীর্থ দর্শন তার দর্শনইন্দ্রীয়কে বেজায় ক্লান্ত করে তুলেছিল, আজ যেন মদনের চকিতে বিদ্যুৎ ছটার আঘাতে তৃপ্ত হলো তার দর্শন ইন্দ্রীয়। একে একে দীর্ঘদিনের সাধনায় জমে থাকা সংযমের বরফ কামের উষ্ণতায় গলতে শুরু করলো। তীব্র অন্তঃপ্রকৃতিতে নবীন-প্রবীনের সংঘাতে ধীরে ধীরে প্রবীনের হাত ছেড়ে নবীন নিজেকে আত্মসমর্পন করলো মৎসগন্ধার রূপ আর অনাবিল যৌবনের কাছে। অসম্ভব পিপাসায় জর্জরিত ঋষি নিজ অবস্থানকে বিসর্জন দিয়ে কুমারীকে শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে পাবার জন্য বারংবার কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন। আগামীদিনের সামাজিকবাধা প্রতিকারের সবরকমের প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে যৌন মিলনের আর কোন বাধা রইলোনা। ঋষির কামনার আগুনের আঁচে দগ্ধ হলো কুমারী হৃদয়, পরস্পর দুটি দেহ একাত্ম হয়ে রচনা করলো নতুন ইতিহাস। সাক্ষী রইলো আকাশ আর এই নীল যমুনা জল। অবশেষে তৃপ্ত ঋষি পরাশর আগামীদিনের কিছু অঙ্গীকার করে বিদায় নিলেন।
আবার প্রমাণিত হলো দেহধারনের জন্য খাদ্য ও যৌনতা উভয়েরই প্রয়োজন, কোত্থেকে তার যোগান এলো সেটি ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এটাই মুখ্য আর মানুষ্যসৃষ্ট জাতি,বর্ণ ও ধর্মের ভেদ গৌণ।
ক্রমশঃ
ব্লগার -রবীন মজুমদার
তারিখ - ১৬/০২/২৫
https://rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ