(২৫০) যোগী থেকে ভোগী
(২৫০) যোগী থেকে ভোগী
উপঢৌকন দেবার মাধ্যমে স্বার্থ হাসিলের প্রথা পুরাণের যুগেও বেশ প্রচলিত ছিল। প্রসঙ্গক্রমে, তারকাসুর সে সময়ে এমন দাপট দেখাচ্ছিল যাঁর রেশে তিনলোকের প্রতিনিধিরা দেবরাজ ইন্দ্রের নেতৃত্বে এর বিহিত করার জন্য ব্রহ্মা সমীপে এসে উপস্থিত হলেন। বলা বাহুল্য, ব্রহ্মাও এই সুযোগটির অপেক্ষায় ছিলেন। আজ তাঁর মনোস্কামনা পূর্ণ হতে চলেছে। আজ তিনি তাঁর সঙ্গে পেলেন স্বর্গের সকল দেবতা আর মর্ত্যের মানুষের প্রত্যক্ষ মদত। এবার নিশ্চয়ই দেবাদিদেব মহাদেবের অবিবাহিত তকমা ঘুচাতে তিনি সক্ষম হবেন। তিনি তো আসলে সৃষ্টিকর্তা। তিনি জানতেন, শিব তার সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় কিছুতেই সাড়া দিচ্ছেন না। তাই তিনি তারকাসুরকে ব্যবহার করে একাধারে ক্ৰমবৰ্ধমান দেবতা ও মানুষের মধ্যে অনৈক্যকে দূর করতে সচেষ্ট হলেন আর অন্যদিকে তাঁর দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্যকে সফল করতে প্রয়াসী হলেন। যুদ্ধক্ষেত্র এমনি একটি জায়গা যেখানে পাশাপাশি সংগ্রাম করতে করতে জাতপাত,বর্ণ ইত্যাদির বিভেদ থাকেনা।
দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদের আগমনের সময় তিনি ধ্যানে বসে ছিলেন। বেশ কিছুক্ষন বাদে উঠে এসে বললেন, তিনি দেবতাদের সমস্যাকে অনুধাবন করেছেন এবং তিনি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, একমাত্র শিবের পুত্রই এই তারকাসুরকে বধ করতে সক্ষম হবে।
এই কথা শুনে, তাঁরা আকাশ ভেঙে বাজ পড়লেও এতটা শক পেতেন কিনা সন্দেহ, এতো রাক্ষস বধের থেকেও আরো কঠিন সংগ্রাম। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উঠে এলো, এই প্রক্রিয়াকে সাফল্যমণ্ডিত করতে গেলে প্রাথমিকভাবে একজন কুমারী নারীর প্রয়োজন। শুধু নারী হলেই চলবেনা, তাঁর মধ্যে থাকতে হবে একটা যোগীর অন্তস্থলে দীর্ঘ দিন ধরে নির্বিকার ইন্দ্রিয়ের কামনার বরফকে বাসনার প্রবল প্লাবনে ভাসিয়ে দেবার ক্ষমতা।
শুরু হলো গভীর অনুসন্ধান, যাঁর উত্তাপে, সুউচ্চ পর্বতের বরফ তার দীর্ঘদিনের ধ্যান ভঙ্গ করে জলের আকার ধারণ করে সব অহংকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে সমতলে এসে মর্ত্যের মানুষের পদসিক্ত করতে বিলম্ব করেনা, সেই উষ্ণতামাখানো নারীর খোঁজ শুরু হলো স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে। অবশেষে পাওয়া গেল সেই নারীকে যিনি নেপথ্যে থেকে হিমালয়ের বরফ থেকে জল বানানোর কারিগর, তিনি আর কেউ নন, তিনি হিমালয় কন্যা পার্বতী। যেই কন্যার পশ্চাতে রয়েছে দীর্ঘ দিনের সফলতার ইতিহাস।
কামদেবের বর্ণনায়, যৌবনের উদয়ের বাণী পার্বতীর আপাদমস্তকে সুচারু রূপে বিন্যাসিত হয়ে যেন কামনার দেবদূতরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন। সূর্য্যের কিরনের ন্যায় তার সর্বাঙ্গে উদ্ভাসিত। সেই আলোতে পথ পার্শ্বের পথিক খানিকের বিহ্বলতায় দিকভ্রষ্ট হয়ে যায়। সেই ছটা সুতীব্র তীরের ফলার মতো দেহমনে প্রবেশ করে মদিরা না হয়েও মদিরার আকাঙ্ক্ষার ন্যায় তীব্র দহনের মশাল কখন যে জ্বালিয়ে দেবে, সেটি কেউ জানেনা। সেই অগ্নি যেন ভোগ যজ্ঞের নৈবিদ্যের প্রতি সমাপিত।
কখন যেন মনে হয় সৃষ্টি কর্তা তাঁর অসীম সম্ভারের ঝুলি নিয়ে একে একে সমগ্র দেহকাণ্ডের এক একটি বৃন্তকে ভীষণ যত্ন করে ফুটিয়ে তুলেছে। ঊরুদ্বয়কে উপস্থাপন করতে গিয়ে শিল্পকীর্তির কোন কৃপণতা করেন নি। বৃত্তাকৃত উরুদ্বয় কখনো তীব্রভাবে উদ্ভাসিত হয়ে কি বিপুল উৎসাহে প্রাসঙ্গিতা বজায় রেখে ক্রমশ কৃশ হয়ে নিম্নগামী হয়েছে। উদ্ধত নিতম্বের আকাশচুম্বী স্পর্ধা একই সাথে পথচলতি প্রাণীর সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা এবং একইসাথে ইন্দ্রিয়ের বাসনাকে উস্কে দেয়। সুগভীর নাভির ব্যাসার্ধ যেন অজানা কোন এক মায়াবী গহ্বরের হাতছানি দেয়। বক্ষযুগলের অনমনীয় মনোভাব দর্শনইন্দ্রিয়ের সুকুমার বৃত্তিকে যুদ্ধার্থে আহবান জানায়। ওষ্ঠদ্বয় সর্বদাই যেন চুম্বকের ন্যায় সমগ্র প্রাণীকূলকে আকর্ষিত করে। এ যেন না পাওয়া বস্তুকে লাভ করার জন্য অন্তরস্থ এক তীব্র কোলাহলের সৃষ্টি করে। এহেন শিবের সুকুমার শরীরে পার্বতীর যৌবনের লেলিহান শিখা কতটুকু স্পর্শ করতে পারলো সেটাই লক্ষ্যণীয়।
ভারতীয় পূরণে রূপকের ছড়াছড়ি। এখানে একটি ঘটনা উহ্য রয়ে গেছে, সেটি হলো সৃষ্টি তত্ত্বের প্রারম্ভে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন।
শ্রেণী সচেনতা সেই যুগেও ছিল, শ্রেণী বিভাজন তারই একটি অঙ্গ আর সেই নিয়ে দন্দ্ব তো অবধারিতভাবে এসে যায়। কাল্পনিক দেবতা ও অসুর না থাকলে শ্রেণী দ্বন্দ্বটা কার সাথে হবে, এইটা যেমন একটি প্রশ্ন, ঠিক সেই মন্থনের অমৃতটাই বা কি? আসলে সমাজে মোক্ষকে প্রতিষ্ঠাকে করতে গেলে প্রাথমিকভাবে ভোগ করতে করতে ভোগের প্রতি বিতৃষ্ণাই মানুষকে মোক্ষের রাস্তায় টেনে নিয়ে যাবে।
তাহলে, প্রথমে ইন্দ্রীয়ের সব দ্বারকে উন্মোচিত করা, তার পর তাকে ধীরে ধীরে তাকে বাইরে থেকে টেনে নিয়ে এসে অন্তর্মুখী করার মাধ্যমে মোক্ষ লাভের বৃত্তটিকে সম্পন্ন করা।
মন্তব্যসমূহ