(২৬৬) বেশতো ! একবার ভাবুন

(২৬৬) বেশতো ! একবার  ভাবুন     


          খুব সাধারণভাবে কোন মানুষ কিংবা গোষ্ঠী যদি অমানবিক কাজ করে তাহলে প্রথমেই  আমরা  বলে থাকি এটা চেতনাসম্পন্ন মানুষের কাজ নয় অর্থাৎ জড়ের কাজ। এইতো  সেদিন কিংবা বিগত দিনগুলিতে শুধুমাত্র ভারতে নয়, সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের জড়ের আক্রমনে নিরীহ মানুষের মৃত্যু মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির সাহায্যে তার কারণ খুঁজতে চেষ্টা করব। 

কার্য- কারণ ও উদেশ্য 

         দর্শন  বলে কার্য্যকে প্রত্যক্ষ করা যায় কিন্তু কার্যের পিছনে যে 'কারণ' থাকে তাকে অনুসন্ধান করলে কার্য্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। 'উদেশ্য' কার্য্যের কারণকে নির্দ্দেশ করে। তাহলে উদ্দেশ্যকেই আমরা  কারণের পিছনে দায়ী করতে পারি । উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় বেশ কাছাকাছি কিন্তু এক নয়। উদেশ্য একটি দীর্ঘ মেয়াদি এবং গভীর চিন্তা প্রসূত  প্রক্রিয়া, আর অভিপ্রায় হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত পূরণ।  যুক্তি সম্পন্ন বিশ্লেষণ হচ্ছে সেই উদেশ্যকে শুধু খুঁজে বার করা নয়, আবার এই উদ্দেশ্যের পিছনের কারণকে নির্দ্দেশ করা এবং এই কার্য্য সংগঠিত হবার পশ্চাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কারা কারা লাভবান হচ্ছে তাকে  যুক্তির ভিত্তিতে চিহ্নিত করা।   

জড়তার সমীকরণ 

জড়ের  বিপরীতে যে চেতন দাঁড়িয়ে থাকে এই সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে, কোন চেতনার বলে বলীয়ান হতে একদল উগ্রপন্থী হত্যা নামক কর্মকে সংগঠিত করলো। তাহলে, এটা প্রমাণিত হলো বন্দুক নামক জড় বস্তুর সাথে চৈতন্যবিহীন এক বা একাধিক জড়রূপী মানুষও  সেই জড়ের সমতুল্য। তাহলে, নেপথ্যে থেকে কারা ট্রিগারটা টিপলো এবং তাদের উদেশ্যই বা কি ? 

প্রথমত, উদেশ্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি দীর্ঘ মেয়াদী এবং গভীর চিন্তাপ্রসূত কার্যক্রম হয়ে থাকে, তাহলে সেই যুক্তিতে উগ্রপন্থা একান্তই সাময়িক একটা অভিপ্রায় মাত্র। যার অভিমুখ মৃত্যুদণ্ড নামক শাস্তি। যেমন, একটি বন্দুক জানেনা কাকে সে প্রহার করছে এবং তার পরবর্তীতে কি ঘটনা ঘটতে পারে, তাকে নিয়ে তার মাথা ব্যথাও নেই। উগ্রপন্থীদের অবস্থায় প্রায় সেইরূপ। তারা আজ্ঞা পালনকারী  মাত্র। তাহলে, আমরা সেই  আদেশ বিতরণের সেই দায়িত্বশীল মানুষ বা দেশগুলিকে খুঁজতে যাই।  উগ্রবাদী কেন হয় সেটাও জানবার চেষ্টা করি আর এই রত্নগুলিকে কিভাবে প্রযোজকরা সংগ্রহ করে থাকে। 

উগ্রপন্থা 

উগ্রতা এই সমাজ থেকে উদ্ভূত মানুষের অভিব্যক্তির একটা রূপমাত্র, যা কালে কালে  উগ্রপন্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর কারণ আসলে অনেক স্তরে কাজ করে — ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও। সংক্ষেপে বললে, মূল কারণগুলো এরকম:

  ১. অসাম্য ও অবিচার

  • যখন কোনো গোষ্ঠী মনে করে তারা ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না, তখন অসন্তোষ জমে।

  • দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য (জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গভিত্তিক) মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করে।

  • সেই ক্ষোভ কখনো কখনো উগ্রপন্থায় রূপ নেয়।

২. অপরিচিতির ভয় ("Fear of the Other")

  • ভিন্ন জাতি, ধর্ম বা সংস্কৃতির মানুষকে ভয় বা অবিশ্বাস করা — এই প্রবণতা উগ্র জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় উগ্রতার জন্ম দিতে পারে। উগ্রপন্থা গঠিত হয় যখন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকে, এবং সেই অসন্তোষকে কোনো গোষ্ঠী বা নেতা "শত্রু তৈরি করে" কাজে লাগায়।

৩. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

  • কিছু সময় রাজনীতিবিদ বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে উগ্রপন্থা উস্কে দেয় নিজেদের ক্ষমতা মজবুত করতে।

  • জনগণের মনোযোগ অন্য সমস্যা (যেমন দুর্নীতি বা অর্থনৈতিক ব্যর্থতা) থেকে সরানোর জন্যও উগ্র আবেগে খেলা করে।

৪. চরম আদর্শবাদ

  • কিছু মানুষ মনে করে তাদের চিন্তাধারা বা বিশ্বাসই একমাত্র সঠিক, আর বাকিরা "ভুল"।

  • এই মনোভাব থেকে "আমরা বনাম তারা" দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় — যা সহজেই হিংসায় রূপ নিতে পারে।

৫. আত্মপরিচয়ের সংকট (Identity Crisis)

  • বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে নিজের পরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলে, তারা সহজে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর কাছে টান অনুভব করে।

  • উগ্রপন্থী গোষ্ঠী তাদের “কিছু বড় উদ্দেশ্যের” অংশ হওয়ার অনুভূতি দেয়।

৬. ঐতিহাসিক ক্ষোভ ও প্রতিশোধস্পৃহা

  • কোনো জাতির ইতিহাসে যদি দমন-পীড়নের অভিজ্ঞতা থাকে, সেই ক্ষোভ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চিত হতে পারে।

  • সেই পুরনো ক্ষত মাঝে মাঝে উগ্র রূপ নেয়।

৭. বিদেশি হস্তক্ষেপ

  • অনেক সময় বাইরের শক্তি কোনো দেশ বা অঞ্চলের উগ্রপন্থাকে লালন-পালন করে তাদের স্বার্থে।   

কে কে এই উগ্রপন্থা থেকে লাভবান হচ্ছে

        রাষ্ট্র বিজ্ঞানে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, দেশের অভ্যন্তরীন অবস্থাকে অনুকূলে আনতে শাসকরা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে  উগ্রবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে এবং কোন কোন সময়ে বৈদেশিক  আক্রমনকেও হাতিয়ার করে থাকে। 

উগ্রপন্থার অবিসংবাদিত এক্সপোর্টার -(সৌজন্যে এ আই)

1953 | ইরান

  • ঘটনা: সিআইএ "অপারেশন অজ্যাক্স" করে গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে সরায়।

  • ফলাফল: শাহের স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা হয় → ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব।


 1954 | গুআতেমালা

  • ঘটনা: সিআইএ সরকার উৎখাতে সহায়তা করে।

  • ফলাফল: কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।


 1960 | কঙ্গো (DR Congo)

  • ঘটনা: প্যাট্রিস লুমুম্বা হত্যায় মার্কিন সহযোগিতা।

  • ফলাফল: দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধ।


 1961-1975 | ভিয়েতনাম

  • ঘটনা: দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধ।

  • ফলাফল: বিশাল প্রাণহানি; পরবর্তী বিশৃঙ্খলা কম্বোডিয়া-লাওসে ছড়িয়ে পড়ে।


 1973 | চিলি

  • ঘটনা: সিআইএ সমর্থনে অগাস্টো পিনোচে সামরিক অভ্যুত্থান।

  • ফলাফল: স্বৈরাচারী শাসন, হাজার হাজার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।


 1979-1989 | আফগানিস্তান

  • ঘটনা: সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ।

  • ফলাফল: তালেবান ও আল-কায়েদার জন্ম; পরবর্তী সন্ত্রাসবাদ বিস্তার।


1980s | নিকারাগুয়া

  • ঘটনা: "কনট্রা" বিদ্রোহীদের গোপন সহায়তা (Iran-Contra Affair)।

  • ফলাফল: গৃহযুদ্ধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন।


1989 | পানামা

  • ঘটনা: সামরিক অভিযান ("Operation Just Cause")।

  • ফলাফল: সরকার পতন; দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা ও ক্ষয়ক্ষতি।


1991 | ইরাক (প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ)

  • ঘটনা: কুয়েত মুক্ত করার জন্য ইরাক আক্রমণ।

  • ফলাফল: ইরাকে সাদ্দাম হোসেন টিকে থাকলেও ভেতরে বিদ্রোহ ও অবরোধ শুরু হয়।


 2001 | আফগানিস্তান

  • ঘটনা: 9/11 এর পর তালেবান সরকার উৎখাত।

  • ফলাফল: দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ; তালেবান পুনরুত্থান (২০২১)।


2003 | ইরাক

  • ঘটনা: সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ ("Weapons of Mass Destruction" অজুহাত দিয়ে)।

  • ফলাফল: সরকার পতন; গৃহযুদ্ধ; আইএস (ISIS) এর উত্থান।


 2011 | লিবিয়া

  • ঘটনা: ন্যাটো মিশনে গাদ্দাফির সরকার উৎখাত।

  • ফলাফল: গৃহযুদ্ধ, উপজাতীয় বিভক্তি ও আইএস-এর প্রসার।


 ২০১১-বর্তমান | সিরিয়া

  • ঘটনা: সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা।

  • ফলাফল: গৃহযুদ্ধ; লক্ষ লক্ষ শরণার্থী; আইএস-এর উত্থান।

 প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে,  হস্তক্ষেপের পর: সরকার পতন → শক্তিশালী শাসক না থাকায় বিশৃঙ্খলা → উগ্রপন্থার বিস্তার → সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ।

উদেশ্য 

        বৈদেশিক -বাণিজ্য বিস্তার ও তার সাথে তাদের  অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করা। 
            ********************************************
             সাধারণ মানুষই দেশের মূল শক্তি। সেখানে বিভেদ নয় ঐক্যই একমাত্র পথ। স্বামী বিবেকানন্দের উক্তিটি আজ ভীষণ প্রাসঙ্গিক -" ভারত আবার উঠিবে, কিন্তু জড়ের শক্তিতে নয়, শান্তি ও প্রেমের পতাকা লয়ে " /

 ক্রমশঃ 

ব্লগার -রবীন মজুমদার 
তারিখ -২৯/০৪/২৫

ভালো লাগলে অন্যকে শেয়ার করুন। 



মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
ভীষন ভালো লাগলো।
নামহীন বলেছেন…
ভীষন ভালো লাগলো।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল