২৯৭ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন - ১৭ তম পর্ব

  ২৯৭  ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন -  ১৭ তম   পর্ব  

রামায়ণ ও কালিদাসের মেঘদূত  এবং পরবর্তী সময়   (৭) 

 জীবন মানেই  নামা ওঠার খেলা। একবার বায়ুকে  গ্রহণ করো আবার তাকে ছেড়ে দাও। ঘুমের সাথে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আবার জেগে ওঠা, এটাই একটা ছন্দ।  এই চক্রটা  বন্ধ হলে তখন মনের মধ্যে শুধু পরে থাকবে অস্তিত্ব সম্পর্কের ধারণাটি; বিশ্ব অস্তিত্বের সাথে স্থুল শরীরটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। জীবনে যদি উষ্ণতার আঁচ লাগে তখন অবশ্যিই ধরে নিতে হবে ঠিক তার পিছন পিছন  শীতলতা আসবেই। তখন উষ্ণতা অতীত আর শীতলতাই  বর্তমান। বাস্তবে কোন অবস্থাটাই শেষ কথা নয়। কোন আধিপত্যই চূড়ান্ত নয় এটাই বিশ্ব প্রকৃতির নিয়ম। 

এখানেই একটা প্রশ্ন নাড়াচাড়া দিচ্ছে, সত্যিই আমরা জেগে উঠি, অর্থাৎ বাইরে পৃথিবীকে বোঝার চেষ্টা করি ? উত্তর আসবে করিনা। কেন করিনা, আসলে বুঝতে পারিনা কোনটাকে দেখা বলে আবার কাকে অনুভব বলে। যেমন, একটা কথা প্রচলিত আছে রাস্তার কোন মামুলি দুর্ঘটনা ঘটলে আহত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, দেখতে পাইনি  তো  কোথা থেকে গাড়িটি এলো ? অথচ দেখবার ইন্দিয়গুলি সজাগ  ছিল কিন্তু পিছনে থেকে যিনি সামনে আসা বস্তুটির সাথে বুদ্ধির পরিচয় করিয়ে দেন, সেই মনটি অন্যত্র ছিল। এই জেগে না থাকাটাই আমাদের কষ্টের বোধহয় আসল কারণ। 

ব্রহ্মার একচেটিয়া আধিপত্য একসময় সংকুচিত হয়ে যায়, বিষ্ণুর আধিপত্য বিস্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এই বিষ্ণুবাদের কান্ডারী ছিলেন দুই ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত  শ্রীকৃষ্ণ এবং রামচন্দ্র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাব সে যুগেও ছিল, খুব যত্ন করে ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতা ওল্টালে ঘটনার পশ্চাতে এই কারণটি বিশেষভাবে  উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। 

এবার আসা যাক, আদি ও নব্যের দন্দ্ব নিয়ে কিছু কথা। রামায়নের যুগে আদি ধর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বশিষ্ঠ মুনি এবং তিনি ছিলেন রাজা দশরথের  কুলপুরোহিত। রাম সেই বশিষ্ঠ মুনির ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে নব্য ধর্মের নেতা বিশ্বমিত্রকে গুরু বলে স্বীকার করে  নেন। রামের সাথে দশরথের রাজ্য প্রতিপালনের কৌশল নিয়ে মতান্তর ঘটে এবং তার সাথে যুক্ত হয় বশিষ্ঠের বিপরীত শিবিরে থাকা বিশ্বামিত্রের প্রবল প্রভাব। যখন সামাজিক পটে রামায়নের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, তখন  রামচন্দ্রের রাজ্য পরিত্যাগকে স্ত্রৈণ রাজা দশরথের দুর্বলচিত্তের প্রকাশ বলে পরবর্তী সময়ে প্রচার  করা হয়।  

কর্মই মানুষকে অমর হতে সাহায্য করে। আর্য ও অনার্য্যদের একটা ব্যাবধান দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষে অবস্থান করছিল। এই দুইয়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের মধ্যে বিশ্বামিত্র,  রাম ও জনক রাজার  ভূমিকা ছিল অনন্য। 

সে যুগে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে ক্ষমতার দন্দ্ব। মুলে ছিল যশ ও অর্থ লাভ। তাকে নিশ্চিত করার জন্য বংশ পরম্পরায় ব্রাহ্মণরা আর্য দলের কুলপতিকে সামনে রেখে দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য যাগযজ্ঞ ও স্তব পাঠ করতো।  গোটা ব্যাপারটা ছিল বৃত্তিভিত্তিক এবং অভিমুখ ছিল অর্থ উপার্জ্জন। সহজভাবে বলতে গেলে, ব্রাহ্মণদের কাছে যে একধরনের ধর্মীয় শোষণের  শিকার হচ্ছিলো ক্ষত্রিয়রা কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের কারণে  প্রকাশ্যে বিরোধ সেভাবে উপস্থিত হয়নি, ব্যতিক্রমও আছে, তার প্রমান পরশুরাম।  

স্বর্গের দেবতাদের সাথে মানুষের আত্মার সাথে সম্পর্ক যতক্ষন পর্যন্ত না স্থাপন না হয়, ততক্ষন তাঁদের সাথে মানুষের সম্পর্কটা অনেকটা ভয় ও চাওয়া পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে আর সে কখনও  মানুষের মনের রাজা হতে পারেনা। সে পূজা হয়ে উঠে ভয় থেকে ভক্তির পূজা কিংবা বশ্যতা। 

দেবতা যদি অন্তরের হতো তাহলে, বাইরে ঘন্টা বাজিয়ে লোক দেখিয়ে পূজা করতে হতো না, সেই দেবতা অন্তরেই পূজিত হতো। সুতরাং ধরেই নেওয়া যেতে পারে, যারা ভক্ত তারা চিরদিনই ভেবে এসেছে দেবতা তাদের থেকে অনেক দূরে বাস করে, তাই তাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা যুদ্ধকালীন পরিস্হিতির সৃষ্টি করতে হয়, যার প্রধান সেনাপতি হয় পুরোহিতরা, মন্ত্র হয় তাকে ডাকার অস্ত্র আর অর্থ হয় যজ্ঞের ঘৃত।  

মনে হয়, এই ভয় ভক্তির বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ক্ষত্রিয়দের হাত ধরে বৈষ্ণবধর্মের বিকাশ হয়। শ্রীকৃষ্ণ এই ধর্মের  গুরু হিসাবে আবির্ভূত হয়ে বৈদিক মন্ত্র ও আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধের আঘাত হানে।  ঐতিহাসিকভাবে কোন প্রমান নেই যে, কিভাবে দুই ক্ষত্রিয় মানব সন্তান শ্রীকৃষ্ণ এবং রামচন্দ্র  বিষ্ণুর অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। 


 চলবে ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ ২ ৮/ ০৭/২৫
ভালো লাগলে পরিচিতদের কাছে  শেয়ার করুন। খারাপ লাগলে ইগনোর করুন। 
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল