২৮৫ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন - পঞ্চম পর্ব

২৮৫ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন - পঞ্চম  পর্ব  

দক্ষকে কুবেরের দেওয়া  শাপটি কিভাবে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের  কারণ  হয়ে উঠলো, যা  মহাকবির  কালিদাসের  আঙ্গুলি লেহনে, সেটা আজও বিরহের এক অনন্য  দৃষ্টান্ত হিসাবে আলোচিত। 

কুবেরের রাজত্বে দক্ষ একজন সামান্য কর্মচারী, যার কাজ ছিল কুবেরের শিব পূজার উপকরন হিসাবে ফুল তুলে দেবার। একদিন তিনি তার প্রিয়ার সাথে প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে তার নির্দ্দিষ্ট কাজকেই ভুলে গিয়েছিলেন। ব্যাস ! আর যায় কোথায় ,  কুবের তাৎক্ষণিক শাপ দিলেন,  যে কারণে সে কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, দক্ষের সেই দুর্বল জায়গায় আঘাত দিয়ে এক বছর মেয়াদী তার প্রিয়ার সাথে বিচ্ছেদের একটা পরোয়না জারি করেদিলেন।  

শাপ পর্বের দিন, মাসগুলিও ধীরে ধীরে অতিক্রান্ত হয়ে যায়, ধিকি ধিকি করে কামাগ্নির তীব্রতা সহ্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। আবার, পাশাপাশি যক্ষ মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠে, তার প্রিয়া যেন তার বিরহে  দেহত্যাগ করে না বসে। তাই বর্ষণসিক্ত আষাঢ় মাসে কালবিলম্ব না করে মেঘকে দিয়ে খবর পাঠায় যে, কামজ্বরের ( প্রেম ও কামজ্বর সেকালে  সমার্থক হিসাবে উচ্চারিত হতো ) প্রভাবে তার দেহ-মন আক্রান্ত, আকুল হয়ে মুক্তির অপেক্ষায় রত।  

 কবিও ইত্যাবসরে দক্ষের বিরহজনিত পীড়ার বর্ণনা অপেক্ষা তার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাকে এই দীর্ঘ যাত্রার সাথী করে তোলেন। আসলে মেঘের পরিণতি হিসাবে জলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে আর জলের আরেক নামই তো  জীবন। শাপ মুক্তি প্রায় আসন্ন, তাহলে, দক্ষ কি তার প্রিয়াকে তার জীবনকে অটুটু রাখার কথা বলছে ?

পূর্বের অধ্যায়ের পর ০০০০০০০০০০০০০০০০

ভারতীয়দের ইতিহাস চর্চায় পুরাণের ভূমিকা 

পুরাণ  বিশ্বাসযোগ্যতা পেলো তার  যুক্তি নির্ভরতা  এবং বৈজ্ঞনিক ভিত্তির উপর । প্রাকৃতিক ঘটনাবলি, যেমন, বন্যা, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি কবে কোথায় হয়েছিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ-রাজাদের শাসনকাল, সামাজিক জীবন ইত্যাদি ভীষণ সুচারুভাবে সংগ্রহ করে সাজানো হয়েছে। এই সংগ্রহকালে  কতগুলি পদ্ধতি   মেনে চলতো। যেমন, প্রাচীনকালে প্রত্যেক রাজার নিজস্ব ইতিবৃত্তকার থাকতো। যাদের নাম ছিল "মাগধ"।  ভারতবর্ষ প্রাচীনকালে বহু খন্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল।  "সূত " নামে একশ্রেণীর ইতিবৃত্তকার ছিলেন, যাঁরা "মাঘধদের " থেকে স্ব স্ব দেশের ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করতো।  যজ্ঞের সময় মান্যগন্য আমন্ত্রিত রাজা এবং ঋষিদের সামনে মৌখিক বর্ণনা এই সুতরা দিতেন এবং সেখান থেকে ঋষিরা পুরাণে  লিপিবদ্ধ করতেন। তাছাড়া, কোন ক্ষেত্রে মাঘধরা  সেই  দেশের  ঘটনাবলীকে  টেম্পারিং করত,   তখন সুতরা সেটি সংশোধন করে দিতেন দিতেন। 

কিছু অতিরঞ্জন থাকা সত্ত্বেও পুরাণের ঐতিহাসিক মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না।  ভারতীয় ঋষিরা জানতেন, ভারতীয়দের ধর্মের প্রতি দুর্বলতা প্রবল, তাই তারা পুরানকে ধর্মপুস্তকের আড়ালে রেখেছিলেন। তারা জানতেন, কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলেও তারা পুরানকে বুক দিয়ে আগলে রাখবেন।  

 পুরাণ ছাড়া পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ব, ধর্ম ভিত্তিক রচনা , ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শন শাস্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ও ধারাবাহিক গবেষণার দ্বারা বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা সমৃদ্ধ হচ্ছে।  এর ব্যাপ্তি ভারতবর্ষ ছেড়ে ইন্দো-য়ুরোপীয় জনগোষ্ঠীর এই প্রথম প্রামাণ্য  দলিল। 


আর্য্য ও  বৈদিক সংস্কৃতি  - 

 ঐতিহাসিকরা  মনে করেন , ইন্দো-য়ুরোপীয় জনগোষ্ঠীর একটি শাখা ইরানের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে আসে। তারা ইরানের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত জাগ্রোস  পর্বতমালায় এসে কাসাইটদের( মেসোপটেমিয়ার এক প্রাচীন জাতি ) প্রতিবেশী হিসাবে কিছুদিন ছিল। কাসাইটরা আবার তাদের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইরানে বসবাস করছিলো।  গবেষণায় দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছরের আশেপাশে ইরান থেকে ভারতের অভিমুখে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রবেশ করে।  ইরান থেকে আসা জনগোষ্ঠীর আগমন চলতেই থাকে।  ইরানিদের সাথে মানিয়ে চলতে না পারার কারণে আর্য্যজনগোষ্ঠীর দল ভারতে এসে আস্তানা গড়ে। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে বাল্খ( আফগানিস্থানে অবস্থিত বাল্খ নদীর তীর)  এলাকায় এসে উপস্থিত হয়। এরাই পরবর্তী সময়ে বৈদিক আর্য্য নাম প্রতিষ্ঠিত হয়। আর একদম প্রথমে যারা এসে ছিল, তারা প্রাগার্যদের সাথে মিলেমিশে আর্য্যবর্তে বসবাস করতে শুরু করে। 

কেন ইতিহাস চর্চা 
 আজ  কেন এই চর্চার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।  যখন যুগে যুগে শাসকে ও সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে নিজের মতো করে পরিমার্জন করছে, তখন তথ্য সমৃদ্ধ ঘটনাবলীকে তুলে ধরার একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে, সাহিত্য হচ্ছে সেই অমূল্য সম্পদ যেখানে  যুগের পর যুগ ধরে  তৎকালীন সমাজের যে প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল তারই  এক প্রামাণ্য দলিলইতিহাসের সতীত্ব হরণ করার প্রচেষ্টা সেই রামায়ন-মহাভারতের যুগ থেকে শুরু করে আজও একই ধারায় প্রবাহমান। 

 স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীরা তাদের মতো করে  ইতিহাসকে বিকৃত করে কিংবা অবাঞ্চিত ঘটনাকে সাহিত্যের মধ্যে সংযোজন করে তাদের হারিয়ে যাওয়া গৌরবকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা যে করেছে, তারও সাক্ষী ইতিহাস। রামায়ন, মহাভারত থেকে শুরু করে বর্তমান কালে ইতিহাসের পাঠক্রমে প্রক্ষিপ্ত  ঘটনাবলীর সংযোজন এবং প্রকৃত ঘটনার বিসর্জিত হবার এক  ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। এইসব প্রতিকূলতা থাকা  সত্ত্বেও প্রকৃত ঘটনাকে তুলে আনবার জন্য পদ্ধতিগত অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে, যাতে  আগামী প্রজন্ম সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত না হয়। সে  দায়ভার বর্তমানকে নিতে হবে। 

চলবে ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -০৬/০৭/২৫
ভালো লাগলে পরিচিতদের কাছে  শেয়ার করুন। খারাপ লাগলে ইগনোর করুন। 
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
তুমি মোটামুটি একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করছো। খুব ভালো লাগছে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল