২৮৮ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন -অষ্টম পর্ব
২৮৮ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন -অষ্টম পর্ব
শ্লোকের উৎপত্তি সম্পর্কে রামায়ণের ' আদিপর্বে ' একটি ঘটনা আছে। প্রসঙ্গত ভারতের প্রাচীন সাহিত্যের সৌধটি এই শ্লোকের উপর নির্ভর করে তার ইমারত গড়ে তুলে ছিল।
গঙ্গার থেকে খানিকটা দূর দিয়ে তমসা নদীর জল ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। নদী পার্শবর্তী অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে সুদৃশ্য বনানীর দল, ইতি উতি যেখানেই চোখ পরে সেখানেই পাখির মেলা বসেছে। তমসা নদীতে স্নান করতে এসে হঠাৎ ঋষি বাল্মীকির নজরে এলো, অন্তরঙ্গ প্রেমে মগ্ন এক বক দম্পতি মিথুনে আবিষ্ট থাকার চিত্রটি। যেখানে পাখির সমারোহ সেখানে ব্যাধের উপস্থিতি থাকাটাই ভীষণ স্বাভাবিক। বেরসিক ব্যাধের নূন্যতম চেতনা ছিল না যে সৃষ্টি সুখের আনন্দে যারা বিভোর তাদের তপস্যায় ব্যাঘাত ঘটাতে নেই। কিন্তু অপরিণামদর্শী ব্যাধ, অচিরেই ধনুকের ছিলায় তীর বসিয়ে পুরুষ বকটিকে আঘাত করে। সেই মৃত্যুবানে শেষবারের মতো পাখাগুলি আন্দোলিত করতে করতে তার শরীরটা মাটিতে পরে গিয়ে মৃত্যুকালীন যন্ত্রনায় ছটপট করতে লাগলো। সেই দেখে স্ত্রী বকটির ক্রন্দন ঋষির হৃদয়ে গভীর বেদনার সঞ্চার করলো। ঋষি বাল্মীকি এই মৃত্যু দৃশ্য এবং ক্রন্দনরত স্ত্রী বকের অবস্থা দেখে এতোই ব্যথিত হলেন, যে তাঁর হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো গুটিকয়েক শোকের পংক্তি, তাকে অব্যক্ত রেখে ঋষি বাল্মীকি আশ্রমে এসে ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন। অব্যক্ত বাক্যগুলি অন্তরে অপরিপক্ক আহারের মতো ক্রিয়া করতে লাগলো। এমনি এক সন্ধিক্ষণে ভগবান ব্রহ্মা এসে আবির্ভূত হলেন। সেই মুহূর্তে পুনরায় মহর্ষি বাল্মীকির মনে সেই ক্রন্দনরত ক্ৰৌঞ্চির কথা মনে পরে গেল এবং তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে গিয়ে পূর্বে যে শ্লোকটি রচনা করেছিলেন, সেই শ্লোকটি আবার জগৎপিতার সামনে উচ্চারণ করলেন। বিশ্বপিতা ব্রহ্মা মৃদু হেসে মহর্ষিকে বললেন, হে মুনিবর , আমার ইচ্ছা অনুযায়ী তোমার মুখ থেকে এই ছন্দ উচ্চারিত হয়েছে। এই ছন্দবদ্ধ পদগুলিই আগামী দিনে শ্লোক নামে পরিচিত হোক। আপনি রামায়ন রচনা শুরু করুন। মুখ থেকে উৎসারিত শব্দগুলি ছন্দকে আলিঙ্গন করে যে পদের সৃষ্টি করেছে বলে, ভগবান ব্রহ্মা তাকে স্বীকৃতি প্রদান করেন "শ্লোক" নামে। মূলত সেই ক্ৰৌঞ্চির হৃদয়বিদারক আর্তনাদের প্রতিধ্বনি মহর্ষির অন্তরে যে শোক বহন করে নিয়ে এসে ছিল, তারই মূর্ত রূপকে ছন্দবদ্ধ করে যে শব্দ মূর্ছনার সৃষ্টি করে ছিল সেটিই ছিল শ্লোকের আত্মপরিচয়।
পূর্ববর্তী সংখ্যার পর ০০০০০০০০০০০০
বাল্মীকির রামায়নে প্রকৃতির প্রভাব
প্রকৃতি এক সূত্রে ঋগ্বেদ, রামায়ণ এবং মেঘদুতকে এক করে দিয়েছে। ঋগ্বেদে যে অরণ্য ছিল একান্তই সর্ব প্রকারের আনন্দের পরিপূরক। সেখানে রামায়নের কিস্কিন্ধ্যা পর্বে এসে দেখি, পত্নী বিচ্ছেদে আহত রামকে পম্পা সরোবর এবং তার পারপার্শিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দেবী নিজ হস্তে সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রকৃতি এখানে যেন আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছেন।
প্রকৃতির জীবনে বহু ছন্দ ও তালের সমারোহ আছে, সেই সুরে তাল মিলালে বিবাগীও কখন যে গৃহমুখী হয়ে যায়, সেটা সে নিজেই জানেনা। বহু জানা-অজানা অনুভূতি ভ্রমরের গুঞ্জনের শব্দের সাথে একাত্ম হয়ে রামকে এক দিকে ভালোলাগা অন্যদিকে প্রিয়ার বিরহে কাতর করে তুলছে। স্মৃতিমধুর বেদনার পাশাপাশি মত্ত কোকিলের আহ্বান আর প্রিয়ার সাথে পূর্বে এই বনে মিলনের স্মৃতি রামের দেহ-মনে কাম উন্মাদনার সৃষ্টি করছে।
ঋতু চক্রের একটা পর্য্যায়ে শীতের বিদায়ে বসন্তের যখন আগমন হলো, প্রকৃতি যেমন তার বৃক্ষের ফুলে গন্ধে , ছন্দে গীতিতে নব সৃষ্টির সম্ভারের ডালি সাজিয়ে দৃশ্যমান জগৎকে বরণ করলো, তখন রামের মনে হল, যদিও এখানে সীতা নেই কিন্তু বার বার তার অশরীরী উপস্থিতি তাকে পীড়িত করে তুলছে। এ যেন , বিরহের লুক্ক্যায়িত ধারণার বিস্ফোরণ ঘটালো কামের উপস্থিতি দিয়ে। এই কামস্রোতে দাদা রামকে ভেসে যেতে দেখে ভাই লক্ষণ এই প্রবৃত্তি পরিহার করার জন্য অনুরোধ করলেন।
মন্তব্যসমূহ