২৮৯ ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন -নবম পর্ব

 ২৮৯  ইতিহাসের পূর্ণ আলোকে মেঘদূত দর্শন -নবম   পর্ব  


ভারতীয় সাহিত্যে প্রকৃতির প্রভাবের পরম্পরা কিংবা প্রকৃতি কেন্দ্রীক  প্রাচীন সাহিত্যের অসঙ্খ্য নিদর্শন  আছে। কিভাবে মহাকবি কালিদাস শুধুমাত্র  প্রত্যাশার প্রতিরূপ মেঘ নিয়ে একটা গোটা খন্ড কাব্য লিখে ফেললেন।  সেই আলোকে আমাদের  অন্বেষণ, নবীন মেঘদুতর উপর প্রবীণ বেদ ও রামায়নের কতখানি আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল।  

একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধান যেমন পথের দিশা দেখায় , ঠিক তেমনি বেদও  এমন একটা শ্রুতি, যার ভিত্তি ছিল বিশ্ব সৃষ্টির রহস্যের আঁধারে দেবতা, ধর্ম, অধ্যাত্বিকতা ও নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে আগামীদিনের সমাজের আচরণ কি হওয়া উচিত তার পূর্ণাঙ্গ একটা মানচিত্র। যে চারাটা একদিন প্রোথিত হয়েছিল বেদের উর্বর জমিতে, সে রামায়ণে গিয়ে ফুলে ফলে  বিকশিত হয়ে ধর্ম ও নৈতিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। 


বেদ যদি মননে  হয়, তাহলে রামায়নের রাম হল তার স্বার্থক প্রয়োগ। বেদে "ঋত" শব্দটির অর্থ হলো যে শত পরিবর্তনের মধ্যে সে অম্লান থাকে , সে চিরন্তন সত্য ও ন্যায়ের মিশেল।  তাই ঋগ্বেদে আমরা দেখি, মানুষের সাথে একটু  উচ্চতায়  দেবতাদের প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের আচরণের মধ্যে দিয়ে সেই আদর্শকে  প্রচার করা হয়েছে। বেদের ধর্ম হচ্ছে সমাজে সাম্যের প্রতিষ্ঠা আর নিঃসংকোচে কর্তব্য পালন।  

রামায়নের রাম ব্যক্তির উর্ধে এক ন্যায়ের দৃষ্টান্ত, ধর্মের এক মানবিক মুখ।  একধারে পিতার কথাকে মান্যতা, পত্নীকে রক্ষা, প্রজাদের প্রতি দায়িত্ব পালন আবার শত্রুর প্রতি উপযুক্ত ব্যবহার করার মধ্যে দায়িত্ববোধ ও নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।  তাই রাম হচ্ছে বেদের দেবতাদের আদর্শে  তৈরি এক  মানবীয় মডেল। 

বেদের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে ঋগ্বেদে, প্রকৃতির উপাদান যেমন নদী, অরণ্য, পশু-পাখি ইত্যাদিকে দেবত্বের সঙ্গে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, “গাছ কেটে ফেলো না, কারণ তারা দূষণ দূর করে” । এই দৃষ্টিভঙ্গি রামায়ণেও প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে প্রকৃতিকে পবিত্র ও সন্মানীয় উপাদান  হিসেবে দেখানো  হয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের পরিবেশ সচেতনতা ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীরতাকে নির্দ্দেশ করে। 

বেদ ও রামায়ণের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে  রামায়ণ যে বেদের উত্তরসূরি সেটার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যাবে। যদি বেদে উল্লেখিত চারিত্রিক গুণাবলী,  নীতি শিক্ষা, পিতৃভক্তি, সত্যবাদিতা, অতিথি সেবা ইত্যাদি পালনের উপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল তাঁর বাস্তব রূপায়ণ এবং পূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায় রামায়নের  রাম ও অন্যান্য ভাই  এবং সীতার মধ্যে।   রাম ও রাবনের যুদ্ধ যেন ক্ষমতার উষ্ণতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরাচরিত প্রতিবাদের মাধ্যমে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত হিসাবে অনেক বেশী  পাঠককে নাড়া দেয়। 

বেদের রাজার মডেলটি রাজনীতি অপেক্ষা নীতি ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যাগযজ্ঞের  উপর বিশেষ জোর আরোপ করেছে।   সেখানে, রামায়ণ অযোধ্যাকে বেদের সব ঐশর্য্য দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলো। সেখানে ছিল এক আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যেখানে প্রজাদের সার্বিক  বিকাশের সব উপকরণ উপস্থিত ছিল।   

বেদের নারী ছিল সক্রিয় অংশীদার; রামায়ণে তার ভূমিকা অনেক সময় প্রতীকি ও নির্লিপ্ত। বেদ যেখানে আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তির কথা বলে সেখানে, রামায়ণ ত্যাগ ও ধর্মানুষ্ঠানের  মাধ্যমে  মোক্ষের পথ খোঁজে। বেদের ধর্ম হল বিশ্বচরাচরের সত্য; রামায়ণের ধর্ম হল মানুষের আচরণে সেই সত্যের প্রতিফলন।

চলবে ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

ব্লগার -রবীন মজুমদার 

তারিখ -১০/০৭/২৫
ভালো লাগলে পরিচিতদের কাছে  শেয়ার করুন। খারাপ লাগলে ইগনোর করুন। 
rabinujaan.blogspot.com ক্লিক করে যে কোন সার্চ ইঞ্জিন থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল