৩৩৪ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - ৫
৩৩৪ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - ৫
স্বামীজীর পত্রাবলীর থেকে উদ্ধৃত -
১৯শে নভেম্বর, ১৮৯৪ সালে জীবনের অর্থ সম্পর্কে এক চিঠিতে স্বামীজী যেটি লিখেছিলেন, তাকে অনুসরণ করে লেখা -
ধর্মের পাতে একরাশ ঝাল ঝাল তরকারি -
ধর্ম- যে নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে এক স্বল্পবাস পরিহিত ব্রাহ্মণের গম্ভীর গলায় শ্লোক আওড়ানো, ঘন ঘন ঘন্টাধ্বনি, কাসর ঘন্টার একনাগাড়ে অন্তরস্পর্শী শব্দ, একরাশ ধুপকাঠি আগুনের সংস্পর্শে এসে নিজেকে উজাড় করে যতটা গন্ধ হৃদয়ে লুকিয়ে রেখেছিল, তাকে যুগপৎ একসাথে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করা, সেই ঘ্রানে মশাদের যারপরনাই নীরবে মূর্ছা। কিন্তু এই ধর্মের গল্প, অন্য সব ধর্মের গল্পের থেকে আলাদা। সেখানে ঘন্টা আছে বটে, কিন্তু সেই ধ্বনিতে পুরোহিতের স্বল্প কেশরাশি বেশ খাঁড়া হয়ে ওঠে।
যাঁরা অন্তরে বাহিরে পরাধীন তাদের ধর্ম কি হবে- সেটা কি কেউ বলতে পারে? অবশ্যই বলা যায় , তাদের ধর্ম হবে স্বাধীনতা অর্জন। তাই ধর্মের প্রধান শর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। বাস্তবে মানুষ কি পাচ্ছে, শুধু একের পর এক বাধা নিষেধ। সমাজে তাই চাই, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পোশাক-আসাক, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে স্বাধীনতা। সব কিছুতে স্বাধীন না হলে তো সংস্কার বার বার তোমার পিছু টেনে ধরবে, ফলত, মানব মনের বিকাশই ব্যাহত হবে, মানুষ যদি এগোতে না পরে তাহলে সমাজ পিছিয়ে যাবে।
যে ভগবান অন্ন দিতে পারেন না, তিনি আবার পাঁচতলা হোটেল খুলে আমাদের আনলিমিটেড সুখ দেবেন- সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। খালি 'পেয়ারা ভগবান' বলে সারাদিন ডাকলে যদি ভাত জুটতো, তা হলে বস্তির মেয়েদের হাঁড়িতে ফাঁকা ধোয়া উঠতো না !
ভারতকে উঠতে হবে, গরিবকে খাওয়াতে হবে, শিক্ষার আলো দিতে হবে। আর পুরোহিতবৃন্দ—যারা সমাজের গায়ে গুঁজে থাকা পুরোনো তিলের মত—তাদের এমন ধাক্কা দিতে হবে সে যেন ঘুরতে ঘুরতে সোজা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণ হোক, সন্ন্যাসী হোক, যে-কেউ হোক—পৌরোহিত্য ও সামাজিক অত্যাচারকে অবশ্যি উৎখাত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, যে অন্যকে স্বাধীনতা দেয় না, সে স্বাধীনতা পাবারও যোগ্য হতে পারেনা। দাসেরা শক্তি প্রার্থনা করে - কিন্তু শুধু মাত্র অন্যকে দাস করে রাখার জন্য। অনেকটা পুরানো হাঁড়ির মতো, যতই চুনকাম করা হোক না কেন, তার কিন্তু গন্ধ যায় না।
প্রেম সেই জিনিস যা এক গ্লাস জলের মতো; নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, জাতপাত, কিছু মানে না। তবে সমস্যা হলো, প্রেমের পাতে অহং আর ঈর্ষা এক চামচ লবণের মতো ঢুকে পড়ে, ফলত মাংসের ঝোল হালকা নোনতা হয়ে যায়। তাই প্রেম করতে গেলে প্রথমেই অহং-ঈর্ষা নামক টিকটিকিগুলোকে বাড়ির বারান্দা থেকে তাড়াতে হবে।
আমাদের বইগুলি বড্ড কাগুজে, ভিতরের শব্দগুলি বেজায় জব্দ করে শুধু চোখের দেখা দেয় কিন্তু মনে ধরতে চায় না, তাই সে একান্তই নিরস। আমাদের পুস্তকগুলোর কথাও শোনেন—ওই যে, বইয়ে মহাসাম্যবাদ, মহা নিষ্কাম কর্মের বুলি, বাস্তবে সব গুলে খেয়ে ফেলি। আমাদের মন এত হৃদয়হীন যে, মনে হয় রক্তমাংসের শরীরটাই একমাত্র ব্রহ্ম। ব্রহ্মদেবও বেচারা মনে হয় গা ঘেঁষে ঘুমোচ্ছেন।
শিক্ষা ছাড়া মুক্তির ঢাক বাজবে কী করে? শিক্ষার বলে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়ে অন্তরস্থ ব্রহ্মের জাগরণ। শিক্ষা কেড়ে নিলে, সব শেষ—টিনের ছাদের বৃষ্টির শব্দের মতো স্বপ্নগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে হারিয়ে যাবে।
তাই বলি ভাই, ধর্ম মানে শুধু কপালে চন্দন নয়, ধর্ম মানে সোজা মেরুদণ্ড। যতক্ষণ ধর্মের পাতে প্রেম, সাহস আর স্বাধীনতার ঝাল ঝোল না থাকবে, ততক্ষণ সে ভাতের হাড়িতে কেবল গরম হাওয়া বাজবে, ভাত আর হবে না।
ক্রমশঃ
ব্লগার- রবীন মজুমদার
তারিখ -১৮-০৯-২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ