৩৫০ ঋগ্বেদের স্মৃতি ও আধুনিক প্রেমের প্রতিবিম্ব

৩৫০  ঋগ্বেদের স্মৃতি ও আধুনিক প্রেমের প্রতিবিম্ব

ঋগ্বেদ, তুমি  ভাষার প্রথম ধ্বনি, যেখান থেকে মানবচেতনার সূর্যোদয় ঘটেছিলো। আজকের যুগ  তোমার কাছে প্রশ্ন রাখে—সেদিন কী এমন লিখেছিলে, যার প্রতিধ্বনি আজও শত পরিবর্তনের মধ্যে অমলিন ? তুমি বলেছিলে—যেমন এক ভক্ত ঈশ্বরের আকর্ষণে ধেয়ে যায় তাঁর পদতলে, তেমনই এক পুরুষ তার প্রিয়ার প্রেমে  উন্মত্ত হয়ে তাকে লাভ করতে উন্মাদের মতো তার পশ্চাতে ধাবমান হয়। এই উপমা যুগে যুগে অনন্ত সত্যের মতো রয়ে গেছে। শুধু কি তাই, প্রেমিকের গোপন অভিসারে গুপ্ত প্রেমিকাকে শিকার করার জন্য প্রতিরোধহীন, প্রতিবাদহীন এক উপযুক্ত পরিবেশের জন্য কতনা শ্লোক ব্যয় করেছো তা পড়তে এখনো শরম লাগে। 

সব নদী তো বাঁধের কাছে আত্মসমর্পন করে ;  কিন্তু কিছু নদী আছে, যারা প্রতিবন্ধকতার পরোয়া করে না— তারা জানে, তাদের পথ চলাতেই আনন্দ। প্রেমও ঠিক তেমনই এক নদী—যেখানে ব্যাকরণ, বিধি, সমাজের গণ্ডি কোনও কিছুরই বালাই নেই। প্রেম একবার এসে গেলে, সে মানুষের সমস্ত অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলকে করায়ত্ব  করে ফেলে—যেন হৃদয়ের তন্ত্রীতে  নতুন জোয়ারের আবির্ভাব হয়। তখন প্রেমিক বা প্রেমিকা যুক্তিকে অতিক্রম করে আবেগের স্রোতে প্লাবিত হয়। আর সেই প্রেমের ভূত যেন চোরাবালির মতো, যতই বিরুদ্ধতা আসুক না কেন, সে যেন ক্রমেই চোরাবালির অতলে হারিয়ে যেতে চায়।  

সমাজ বড্ড বেশি রক্ষণশীল, সহজে পর্দা সরিয়ে তাদের ঘরে ঢুকতে দেয়না। শাস্ত্রের মোটা কৌটা থেকে রঞ্জন রশ্মির তলায় ফেলে শ্রেণী , বর্ণ আরো কত কি নির্ধারণ করে বিধান দেয়। সেটা কখন প্রেমাস্পদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে যায়। 

 কামুক পুরুষের কামচেতনা প্রাচীন ঋষির যুগেও ছিল, আজও আছে—কামসাপের বিষ ঠিক ততদিন অমর, যতদিন মানবদেহ আছে। সেই সাপে কামনা আছে, কিন্তু সংযম নেই। নারী সেখানে কেবল বস্তু, মাংসের গন্ধে লোভিত দৃষ্টি; তার মনের সূক্ষ্ম সুর কেউ কান পেতে শুনতে চায় না। প্রেম যেন খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক। 'প্রেম' শব্দটা এখানে অনাহুত শব্দবন্ধ মাত্র। 

ঋগ্বেদের যুগে যেমন এক কামার্ত পুরুষ বন্ধুর পত্নীকেও অগ্রাহ্য করে পেতে চাইত, তেমন আজও সমাজের অন্ধ কোণে সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আজও অসংযত পুরুষ দূরত্ব, প্রতিরোধ, সম্ভ্রম—সব ভেঙে নারীকে জোরপূর্বক অর্জন করতে চায়। সময় বদলেছে, সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু সেই হায়নার দল এখনো ঘুরে বেড়ায়—রাত্রির আড়ালে, নিরুপায় গৃহের দিকে। 

তবে এক পার্থক্য আছে—তখন নারীর জীবনপণ ছিল প্রেমের প্রমাণ, আজ তা পণের চুক্তির দামে বিক্রি হয়। সমাজ এখনো নারীকে পরিমাপ করে টাকায়, গহনায়, পিতার সম্পত্তিতে। প্রেম সেখানে কেবল মুখোশ, কাম সেখানে ‘বিবাহ’-এর আড়ালে বৈধতা পায়। 

এই পরম্পরায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি—ঋগ্বেদের আহ্বান আজও কানে বাজে, কিন্তু আমাদের হৃদয় কি তার মর্ম অনুধাবন করতে পেরেছে? প্রেম যখন ঈশ্বরের সমান পবিত্র, তখন তাকে কলঙ্কিত করে রাখার দায় মানবসভ্যতারই। 

প্রেমের নদী একদিন সব বাঁধ ভেঙে বয়ে যাবে—যেমন রুদ্রের গর্জনেই গঙ্গার জন্ম, তেমনি একদিন প্রেমও সমাজের শৃঙ্খল ছিঁড়ে নিজের মুক্ত স্বর পাবে। তখনই মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝবে—ঋষিরা যা লিখেছিলেন, তা শুধু প্রেমের কথা নয়, তা মানবমুক্তির চিরন্তন মন্ত্র।

ব্লগার- রবীন মজুমদার 
তারিখ -২২/১০/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 
 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল