৩৫১ সীমার মাঝে অসীম: রবীন্দ্র-ভাবনা ও রামকৃষ্ণের কালিতত্ত্ব
সত্য-মিথ্যা চিরকাল একসাথে বাস করে, উপলদ্ধি নাহলে তার থেকে সত্যকে আলাদা করে চেনা যায় না। যে গভীর আত্মজ্ঞান থেকে মহাপুরুষরা একটু একটু করে মিথ্যার থেকে সত্যকে আলাদা করে আমাদের জ্ঞাতার্থে যে নৈবিদ্য উৎসর্গ করছেন, সেটি পান করে আমরা তাদের উপলদ্ধির সাথে সহমত হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করি। অনন্তকাল ধরে মানুষ সৃষ্টির রহস্য জানতে আগ্রহী। আজ পৃথিবীর নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জানা-অজানার তথ্য উদ্ঘাটনের উপর গবেষণা অব্যাহত আছে। সীমিত পরিধির মধ্যে কতটা উপলদ্ধি করতে পারলাম আর কতখানি বাকি রয়ে গেল, সেই সম্পর্কে একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ধারণার নেপথ্যে যাঁদের একনিষ্ঠ সাধনা আছে, সেই সম্পর্কে অবগত হই।
“সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর” — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙক্তিটি আমাদের অস্তিত্ব ও চেতনার এমন এক গভীর সত্য উন্মোচন করে, যেখানে সীমিত জগতের প্রতিটি রূপে লুকিয়ে থাকে অসীমের প্রতিধ্বনি। জগৎ যেন এক বাঁধা বীণা, আর অসীম সত্তা তার তারে তারে সুর তোলে। প্রশ্ন জাগে — এই জগৎ কি সীমিত না অসীম? মানুষের জ্ঞান কতদূর প্রসারিত, আর কোথায় এসে থেমে যায় তাকে অনুধাবন? এখানেই এসে পড়ে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের কালিতত্ত্ব, যা সীমা ও অসীমের সম্পর্ককে এক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকাশ করে।
আমরা সেই পর্যন্তকেই অসীম বলে জানি, যেখান পর্যন্ত জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে আর বাদবাকি সবই অবগুন্ঠনের আড়ালে রয়ে গেছে। লর্ড কেলভিনের 'ডার্ক ম্যাটার' থেকে জানতে পারি, এই বিশ্বে এখনো কালোর জয়জয়কার, এই আলো-আধারির জগতে তার সম্মিলিতভাবে ৯৫% তারা দখল করে রেখেছে। তাহলে নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিকরা মহাবিশ্বের গঠনকে পরিমানের অঙ্কে ভাগ করতে পেরেছেন, তাই তারা বলতে পারছেন, যে এখনো পর্যন্ত ৫% মানুষের জ্ঞানের আওতায় এসেছে। আধ্যাত্মিক জগতে বিজ্ঞানের মতো বস্তুকে বিশ্লেষণ করার মতো যন্ত্র নেই কিন্তু সেই অনুপস্থিত অংশের আভাস তাঁরা গভীর ধারণা ও ভাবনার মাধ্যমে অনুভব করেন। এখানে প্রমাণিত হয় বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা আর চৈতন্যের অসীমতার ক্ষমতা অনন্ত তার স্বভাবকে।
রামকৃষ্ণের কালিতত্ত্ব: সীমা ও অসীমের মিলন
শ্রী রামকৃষ্ণের কাছে কালী ছিলেন সময় (কাল) এবং সেই সময়েরও বাইরে থাকা চিরন্তন শক্তি। তিনি বলেছিলেন —
“যে ব্রহ্ম নিরাকার, সেই আবার কালী রূপে সাকার হয়ে প্রকাশিত।”
অর্থাৎ, অসীম ব্রহ্মই নিজেকে সীমিত রূপে প্রকাশ করেন, যাতে মানুষ তাকে উপলব্ধি করতে পারে।
রামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে কালী সীমা ও অসীমের যুগলরূপ —
তিনি আছেন আকারেও, নিরাকারেও; সময়েও, কালাতীতেও।
এই দর্শনের মূল তাৎপর্য হলো —
অসীম নিজেকে সীমারূপে প্রকাশ করেই বিশ্ব সৃষ্টি ও জীবনযাত্রার সুর তোলে।
যে মানুষ সেই রূপে অসীমকে দেখে, সে সীমার মধ্যেই ঈশ্বরের অসীম লীলা উপলব্ধি করে।
রামকৃষ্ণ বলেছিলেন —
“জ্ঞানে ব্রহ্ম, কিন্তু ভক্তিতে ব্রহ্মের রস।”
অর্থাৎ, যুক্তিগত জ্ঞান ঈশ্বরকে চিনতে পারে, কিন্তু অনুভবের মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরকে ‘পায়’। জ্ঞান যেখানে থেমে যায়, সেখান থেকেই শুরু হয় অনুভব। তাই, “ধারণা হয়তো পৌঁছায় কিন্তু জ্ঞান পৌঁছায় না” — এই কথাটি রামকৃষ্ণীয় ভাবনাতেও সত্য। কারণ, কালী বা ব্রহ্মকে বিশ্লেষণে নয়, কেবল অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও সীমার মাঝে অসীমের সুর
রবীন্দ্রনাথের পঙক্তিটি —
“সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর”—
একটি দার্শনিক উপলব্ধির কাব্যরূপ। এখানে ‘সীমা’ মানে মানবজীবনের রূপ, সময়, দেহ, প্রকৃতি; আর ‘অসীম’ মানে ঈশ্বরচেতনা ।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ঈশ্বর দূরে নন — তিনি মানবজীবনের সীমার মধ্যেই প্রকাশিত। অন্যভাবে বলা যেতে পারে - মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বাস।
তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’-তে তাই বারবার প্রতিধ্বনিত হয় —
“তোমারি সৃষ্টির পথে চলি, হে অসীম।”
রবীন্দ্রনাথের কাছে, মানুষের প্রেম, শিল্প, সৃজন ও করুণার ভিতর দিয়েই অসীমের সুর বাজে।
এ যেন রামকৃষ্ণের কালিতত্ত্বেরই কাব্যিক ব্যাখ্যা —সীমিত দেহে, সীমিত জীবনে, অসীমের প্রকাশ। যত ভাবেই সত্যকে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন সত্যের গুনগত কোন পরিবর্তন হয় না।
কালিতত্ত্বের দৃষ্টিতে জগৎ
রামকৃষ্ণের কাছে কালী ছিলেন “আদি শক্তি” —তিনি সৃষ্টি করেন, সংহার করেন, আবার পুনর্জীবন দেন। তাই তাঁর কাছে কাল (সময়) কখনও ধ্বংস নয়, বরং চিরপ্রবাহমান অসীমের প্রকাশ।
যেমন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন —
“মৃত্যুর মাঝে জন্ম তব, ক্ষয়ের মাঝে তব অমরতা।”
এখানেই দুই মহাপুরুষের ভাবনার মিলন ঘটে।একজন কালীতে দেখেছেন অসীম ব্রহ্মের নিত্য রূপ, অন্যজন জীবনে দেখেছেন ঈশ্বরের নিত্য সঙ্গীত।
সীমার ভেতরে অসীমের আভাস
মানবজীবনের সৌন্দর্য ও মর্ম এই যে, আমরা সীমিত হয়েও অসীমকে অনুভব করতে পারি। রামকৃষ্ণের কালী সেই সীমিত অস্তিত্বে অসীম শক্তির প্রকাশ;
রবীন্দ্রনাথের অসীম সেই সীমার ভিতরেই সুর তোলে। তাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই — বরং গভীর ঐক্য।
জগৎ সীমিত হলেও তার অন্তরস্বর অসীম।
আর সেই অসীমই সর্বদা মানুষের হৃদয়ের তারে বাজায় আপন সুর —যেমন রামকৃষ্ণ কালীতে দেখেছিলেন ব্রহ্ম, তেমনই রবীন্দ্রনাথ জীবনে দেখেছিলেন ঈশ্বর।
ব্লগার- রবীন মজুমদার
তারিখ -২৪/১০/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ