৩৫২ একঘর জানালা ও দৃশ্যভ্রম

৩৫২  একঘর জানালা ও দৃশ্যভ্রম 



অরুণ দক্ষিণের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো , বেশ ঘননীল অম্বর। যেহেতু মাসটা ছিল আষাঢ়ের মাঝামাঝি তাই  উত্তরের জানলা দিয়ে উঁকি মারলো অরুণ, আকাশটা কখন যে নীল থেকে বেশ কালো হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারেনি। দূর ! এতো ভাবছে কেন-  মেঘরা তো আকাশের অতিথি, ওই যে হরিবাবুর কারখানার ধুয়াগুলি একবার সেই পাইপ দিয়ে বেরোতে পারলে হু হু করে আকাশ পানে দৌড়োতে থাকে, ওঁরা হয়তো জানে ঐ উপরের যে আকাশটা আছে সে তার হৃদয়ে সবাইকে স্থান দেয়। আবার আরেক অতিথির বাড়ি ফেরার তাড়ায় কি অদ্ভুত একটা রক্তাভ আলোর বিকিরণ ছড়িয়ে যায়, তার পরে ধীরে ধীরে  অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আসলে আকাশ কি বদলায় ? না ! ওই যে কিছু স্বল্পমেয়াদি পার্থিব কিছু বস্তুর আনাগোনায় আমাদের দৃষ্টিকে সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে। যার কোন স্থিতি নেই,  ক্ষনে ক্ষনে যে পরিবর্তনশীল, তাই তো সে মায়াময়। তাদের রূপ দেখে আকাশকে ভুল বোধ হয়। যে জানালা দিয়ে দেখি না কেন আকাশ, আকাশই থাকে। আসলে, আকাশ অখন্ড, সে ঈশ্বরের সাথে একমাত্র তুলনীয়। 

অরুণ ভাবে, মানব ইতিহাসও যেন এই  জানালাগুলির কাহিনীর মতো। কেউ বা তার জানালা খুলছে প্রার্থনার, কেউ জ্ঞানের কেউ আবার প্রেমের। যে শব্দবন্ধ দিয়ে প্রকাশ কর না কেন উত্তর কিন্তু এক - সেই সব জানালার ওপারে বসে থাকা অনন্ত আকাশ। 

উপনিষদ তাই বলেছে - এক সত্য, বহু নাম উচ্চারিত। 

রবীন্দ্রনাথ এই বাণীকে রূপ দিয়েছিলেন তার মানবধর্মে-  "সকল দেশের সকল কালের সকল মানুষের হৃদয়ে এক সত্যেরই প্রকাশ ঘটে। "

একই অঙ্গে বহুরূপ 

অরুণ আবার অতীতে ফিরে যায়।  সে আশ্রমে গুরুর কাছে পড়েছিল , অসুর ও দেবতা আসলে মানুষের অন্তরে নিত্য প্রবাহিত দুই প্রবাহের প্রতীক। 'অসু' শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রাণ। প্রাণ থাকলেই তার বহু রকমের তাড়না থাকবেই আর সেই  তাড়না পূরণের জন্য থাকবে সীমাহীন আকাঙ্খা, আর আকাঙ্খাকে জয় করার জন্য থাকবে কামের সদাই উন্মাদনা। 

অসুরের বাস করে সেই অটুট চক্রযানে, যেখানে কামনা, অহংকার আর তাকে লাভ করার আকাঙ্খা  পূরণ হলে , আবার চাহিদার জন্ম,  আবার প্রথম থেকে শুরু করে, ঠিক যেখানে তারা শেষ করেছিল। ঠিক তার অপর মেরুতে দেবতার বাস। 

সংস্কৃতে দেবতা শব্দটি এসেছে 'দিব্' নামক ধাতু থেকে, যার অর্থ - জ্যোতির্ময়, চৈতন্যের আলোতে উদ্ভাসিত। 'দেবতা' বাইরে থেকে আসা কোন আগুন্তুক নয়, সে একান্তই মনের জগতে বাস করা কতগুলি সুচিন্তনের সমষ্টিগত রূপ। সে অপশক্তিকে শাসন করেন, ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন আর অজ্ঞানীর মনে জ্ঞানের আলোতে সেই ত্রুটিগুলিকে তুলে ধরে তাকে সুস্থ জীবনের গান শোনায়। 

  যুদ্ধের দুটো রূপ। একটা বাহ্যিক অন্যটি অভ্যন্তরীন জগতের।  একটিকে দেখা যায় অন্যটিকে অনুভব করতে হয়। বহুকাল আগে উপনিষদ আমাদের সেটাই শিখিয়েছে। দেবতা ও অসুর নামক যে সদাযুযুধান শক্তির মধ্যে যুদ্ধই মানবচেতনার অন্তর্গত ইতিহাস। সে যুদ্ধ রণক্ষেত্রে নয়, সে যে একান্ত মননের গভীরে অবিরাম অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে। 

কঠো উপনিষদ বলেছে—“শ্রেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যং এতৌ।” অর্থাৎ মানুষের সামনে দুটি পথই খোলা আছে - শ্রেয় অর্থাৎ আত্মজ্ঞান ; প্রেয় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সুখ। বিশ্ব সৃষ্টির নিয়মানুসারে দন্দ্ব থাকবেই -কেউ আত্মজ্ঞানকে তার জীবনের পাথেয় করবে , আর অপরজন ইন্দ্রিয়সুখে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে ক্লান্ত হয়ে বিদায় নেবে- এটাই বাস্তব। 

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
“মানুষ আজ বাহিরে জয় করেছে, ভিতরে হেরেছে।”এই হেরে যাওয়া মানুষই আজকের অসুর—জ্ঞান ও যন্ত্রে শক্তিমান, কিন্তু আত্মায় অন্ধ। তার হাতে আছে পরমাণু, কিন্তু হৃদয়ে নেই করুণা; সে জয় করে, কিন্তু জানে না জয় মানে কি।
ঈশ উপনিষদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিদ্যা ও অবিদ্যা উভয়ই প্রয়োজন জীবনের পূর্ণতা আসে যখন প্রাণ ও আত্মা পরস্পরকে ধারণ করে। প্রাণ যদি আত্মার আলো না পায়, সে হয়ে ওঠে উচ্ছৃঙ্খল শক্তি; আর আত্মা যদি প্রাণহীন হয়, তবে সে হয়ে ওঠে নিষ্প্রাণ তত্ত্ব, মরুভূমির মতো শুষ্ক।

রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন—“প্রাণের মধ্যে আত্মা যদি জেগে ওঠে, তবেই সে হয় সঙ্গীত; না হলে কেবল শব্দ।”

অসুর ও দেবতার এই সংঘর্ষ আসলে মানবচেতনার অন্তর্গত বিবর্তন।

অসুর মানে সেই অবচেতন প্রবৃত্তি, যে নিজের সীমা জানে না; দেবতা মানে সেই জাগ্রত চেতনা, যে সীমাকে আলোর দিকে রূপান্তরিত করে। মানুষ প্রতিদিন নিজের মধ্যে এই দুই সত্তার টানাপোড়েনে জর্জরিত— ভোগের হাতছানি, অথচ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা; অন্ধকারের টান, অথচ আলোর পিপাসা। এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সে ধীরে ধীরে চেতনার উচ্চস্তরে উঠতে থাকে—অসুর থেকে দেবতায়, প্রাণ থেকে আত্মায়।

রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম ছিল এই অন্তর্গত যাত্রা—

“যে ঈশ্বরকে বাইরে খুঁজিস, সে ভিতরে লুকানো; তাকে পাওয়ার উপায় হল নিজেকে জানা।” যখন মানুষ নিজের আত্মাকে চিনে ফেলে, তখন সে জানে—ঈশ্বর আলাদা নন, তিনিই আমার অন্তর আত্মা। তখন আকাশের দিকে তাকাতে জানালার প্রয়োজন পড়ে না— কারণ আকাশ তখন আমার ভিতরে, আমার চেতনার নিভৃত প্রদেশে।

অবশেষে মানুষ বুঝতে শেখে—দেবতা ও অসুর দুই-ই আমার ভিতরকার শক্তি;  একজন আলো, অন্যজন ছায়া। আলোকে প্রকাশ করতে হলে ছায়াকেও গ্রহণ করতে হয়।  এই দুইয়ের ঐক্যেই মানুষের পূর্ণতা।
তাই উপনিষদের প্রার্থনা—
“অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্‌গময়।”
অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোয়, মৃত্যুর থেকে অমৃতে নিয়ে চলো। এই আলোকযাত্রাই মানবজীবনের চূড়ান্ত সাধনা। এ যাত্রা বাহিরের নয়—এ অন্তরের। যেখানে মানুষ সমস্ত ভেদ ভুলে অনুভব করে—
রামকৃষ্ণ ও স্বামীজীর ভাষায় বলতে গেলে - "আমি আর আমার ঈশ্বর পৃথক নই।"
যে আকাশের দিকে এতদিন জানালা খুলেছিলাম, সেই আকাশই এখন আমার হৃদয়ের মধ্যে প্রতিফলিত— নীরব, অসীম, ও অনন্ত আলোকময়।


ব্লগার- রবীন মজুমদার 
তারিখ -২৬/১০/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -

rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল