৩৫৩ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - (১০)
৩৫৩ কেন আজ স্বামীজিকে নিয়ে চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা আছে - (১০)
যদি একমত হন, তবে বেশী করে সবার কাছে শেয়ার করুন
স্বামীজীর পত্রাবলী থেকে উদ্ধৃত
২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪
স্বামীজিকে সন্যাসী অপেক্ষা অধিকতর বিপ্লবী হিসাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অক্লান্ত এক সৈনিক হিসাবে বর্ণনা করার যথেষ্ট কারণ আছে। যতই তার রচনার মধ্যে তাঁকে খুঁজতে যাবো, ততই সেই ভান্ডার একে একে উন্মোচিত হবে সেই সব ভাবনার সূত্র।
জনগণকে অন্ধকারে রেখে বিপ্লব কোনকালে সার্থকতা লাভ করেনি -
আজকাল শিল্পক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত শব্দ হচ্ছে 'স্টেটাস রিপোর্ট' বা কাজের অগ্রগতির মানচিত্র তৈরী করা হয়, সেখানে 'টার্গেটের' সাথে কৃতকর্মের মূল্যায়ন খুব সহজেই নির্ণয় করে তার ভিত্তিতে পরবর্তী দিশা নির্ধারণ করা সহজ হয়ে যায়। এই কাজে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে সঠিক ' তথ্য ' সংগ্ৰহ।
তাই স্বামীজিকে দেখি, তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুন না কেন , অনন্তের দিশারী স্বামীজী একই চিত্রপটে সারা ভারতের অগ্রগতি ও অধোগতির মানচিত্রটাকে দেশ থেকে সংগৃহিত সংবাদের ভিত্তিতে আধুনিকীকরণ করে আগামীর বার্তা তার সহকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
এ কিসের ইঙ্গিত -
চিরকালই জনমত গঠনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে খবরের কাগজ। এই খবরের কাগজ বের করার জন্য তিনি তাঁর অনুগামীদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। যেটি সাধারণভাবে একটি বিপ্লবী সংগঠন করে থাকে। দেশবিদেশে স্বামীজির কাজ সম্পর্কে দেশবাসী যাতে ওয়াকিবহাল হতে পারেন, সেটাই হবে একটি পরাধীন দেশের জনগণের আত্মমর্যাদা ও বন্দী আত্মার স্বাধীনতা ফিরিয়ে নিয়ে আসার অন্যতম উপায়। ১৯৫৭ সালে চে গুয়েভারাকে দেখি সিয়েরার জঙ্গলে মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন জনমত গঠনের জন্য, পুরোনো প্রেসের যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে খবরের কাগজ ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে তাদের কার্যের বিবরণ পাঠাতে। আবার পৃথিবীর ইতিহাসে বহু নজির আছে বেতার কেন্দ্রকে বিপ্লবীদের করায়ত্ত করার।
পরিবর্তনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে সাধারণ মানুষের মানসিক পরিমন্ডল গঠন করা, যার উপর ভিত্তি করে মানুষ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারবে, তাঁকে কি করা উচিত। এক কথায় পরিবর্তেনের মানসিক প্রস্তুতি।
ভাব বা আদর্শ বিস্তারের বিকেন্দ্রীকরণ -
সংগঠনের আদর্শকে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন ছোট-বড় কেন্দ্র স্থাপন। ( বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে দেখি ইউনিট কোথাও বা কমিউন প্রতিষ্ঠা করে প্রচারকে জোরদার করতে ) তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো এবং অর্থের দরকার, আর সেই অর্থ তিনি কাজ করে বিদেশ থেকে পাঠাবেন।
আদর্শের একটা অভিমুখ থাকে - যাঁকে অনুসরণ করে দেশবাসী লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায় তাকে পূরণ করার উদ্দেশ্যে।
স্বামীজী মানব সভ্যতার অগ্রগতি এবং অধোগতির কারণগুলি যথার্থ ভাবে অনুধাবন করেছেন বলে, তাঁর বিশ্লেষণগুলি বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিগ্রাহ্য। তাই তাঁর একটি বাক্য রচনার পিছনে অসংখ্য কথার মধ্যে থেকে প্রকৃত নির্যাসটিকে বের করে উপস্থাপন করেন। আত্মবিশ্লেষণ ছিল স্বামীজীর সাহসী পদক্ষেপ। (যেটি কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে লিপিবদ্ধ আছে ) বস্তুর সত্যাসত্য নির্ধারণের ভিত্তি ছিল দ্বান্দ্বিকতা।
জড়কে পরিচালিত করে চৈতন্য, তাই তিনি বলেছেন এক বিশ্বচরাচর পরিচালিত হয় চৈতন্যের শক্তিতে আর সেই শক্তিই হলো ইচ্ছাশক্তি এবং সেটি মানুষের মধ্যে নিদ্রিত অবস্থায় থাকে, তাকে জাগাতে হয়। সেই জাগানোর কাজটি করে চেতনা আর চেতনা জেগে ওঠে জ্ঞানের আলোকে। গুরু রামকৃষ্ণের আলোকে আলোকিত বিবেকানন্দ সর্বদাই সেই কথাটি উল্লেখ করতে কার্পণ্য করতেন না।
উন্নতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, স্বাধীনতাই হচ্ছে সেই শক্তি যে আত্মা বা চৈতন্যকে জাগ্রত করতে সাহায্য করে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে উন্নতির তারতম্যের কারণটি অনুধাবন করে দেখেছেন প্রাচীন ভারত যে আত্মার স্বাধীনতা ধর্মের উত্তরণের জন্য যেমন দিয়েছিলেন, ঠিক তার পাশাপাশি দেহকে নিয়মের নাগপাশে এমন ভাবে বেঁধে রেখেছিলেন, তার ফলে সমাজে আশানুরূপ বিকাশ হলো না।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা আত্মার স্বাধীনতার ধারণাকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো। ঠিক তার পাশাপাশি, দেহকে নিয়মরীতির নাগপাশ দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। যেমন, বর্ণব্যবস্থা, জাতিভেদ, স্পর্শসুচিতা, খাদ্যাভাসের বিধি নিষেধ, নারীর পরাধীনতা - ইত্যাদির মাধ্যমে গোটা সমাজকে একটা কৃত্রিম জালে বেঁধে রেখেছিলো। তার ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন ভাবধারার উন্মেষ ব্যাহত হলো। তার ফলস্বরূপ সমাজ তথা দেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়লো।
অন্যদিকে পাশ্চাত্যের মানুষ দেহ ও মনের যুগলবন্দীতে সমাজকে বাস্তবসম্মত উন্নতির জন্য বিজ্ঞান,প্রযুক্তি, শিল্প, রাষ্ট্রনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে উন্নতির শিখরের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো।
স্বামীজী আসলে যেটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, স্বাধীনতা যেমন থাকবে আত্মার বিকাশে ঠিক তেমনিই থাকবে দেহের বিকাশে। কোন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা যেন এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
পাশ্চাত্য দেশ ধর্মের সামান্যতম উন্নতি করতে হলে সমাজের উন্নতির মধ্যে দিয়ে করতে চায় , আর প্রাচ্য এতটুকু সামাজিক উন্নতি করতে চাইলে, তারা সেটা ধর্মের বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে করতে চায়।
বহমান কাল ধরে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শ বয়ে যাচ্ছে। ভারত অন্তর্মুখী আর পাশ্চাত্য বহির্মুখী। যখনই ভারতে সংস্কারকরা আধুনিকরণ করতে উদ্যোগী হন, তখন তাদের মনে প্রথমেই ধর্মকে নাশ না করে সংস্কারের কোনো উপায় খুঁজে পান না। বৃথা চেষ্টা করে তারা আরো এগোতে বিরত থাকেন। আসলে, গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে গভীর অধ্যবসায়ের অভাব ছিল। এর কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, প্রথমতঃ তারা নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য অসম্পূর্ন পড়াশুনা করেছিলেন, দ্বিতীয়তঃ, তাদের মধ্যে কেউ চেষ্টা করেন নি অন্যান্য সব ধর্মের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যগুলি জানবার।
এখানেই স্বামীজী বলেছেন- হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য হিন্দুধর্মনাশের কোনো প্রয়োজন নেই। ধর্মভাবকে সমমর্যাদা সহকারে সমাজের প্রত্যেকটা স্তরে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহার করা হয়নি বলে সমাজের এই অবস্থা। এই কথাগুলি যে প্রাচীন শাস্ত্র থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটি তিনি প্রমানও দিতে প্রস্তুত। অবশ্যিই সেটি সময়সাপেক্ষ। তাই বর্তমানে সহিষ্ণুতা সহকারে কাজ করাটাই শ্রেয়। নিজের আত্মার দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করাটাই কাম্য।
ক্রমশঃ
ব্লগার- রবীন মজুমদার
তারিখ -২৭/১০/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে।
মন্তব্যসমূহ