৩৫৬ আলো-আঁধারি

৩৫৬ আলো-আঁধারি  


 ছায়ার ভিতর আলো

সকালের শহরটা তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। পুকুরের জলে কুয়াশা গলে পড়ছে, দূরে হালকা ভেজা মাটির গন্ধ। অমৃতা টেবিলের উপর রাখা নোটখানার পাতাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ তার বক্তৃতা — “মনুস্মৃতি ও আধুনিক সমাজে নারী।”

তার স্বামী প্রভাত তখনো খবরের কাগজে চোখ গুঁজে বসে আছে। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। 
“এসব নারীবাদী বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামাও কেন?” — প্রভাতের কণ্ঠে বিরক্তি।
“কারণ আমি দেখি, এখনো মেয়েদের চোখে ভয় থাকে, স্বাধীনতার নাম শুনলেই ওরা পাশ কাটিয়ে যায়,” অমৃতার শান্ত উত্তর।

প্রভাত হেসে উঠল ঠান্ডা স্বরে, “মনু বলেছিলেন, নারীকে রক্ষা করতে হয়। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসা সনাতন ধর্ম। স্বাধীনতা মানে বেহিসেবি জীবন নয়।”

অমৃতা কিছু বলল না। এই “রক্ষা” শব্দটাই তার ভেতরে অদ্ভুত একটা ধ্বনি তোলে—যেন নরম অন্ধকারে  বন্দি ক্রীতদাসীদের একদল পুরুষ নিজেদের স্বার্থে হাত বাড়িয়ে মুক্ত হওয়া খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। 

বক্তৃতা হলে ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করছে। কাবেরী—একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, সামনে সারিতে চোখে মুখে অনন্ত জিজ্ঞাসা ভরা দৃষ্টিতে ডায়াসের দিকে তাকিয়ে আছে। 
অমৃতা মাইক্রোফোনে মুখ রাখল—“মনু বলেছিলেন, পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে, পুত্র রক্ষতি বার্ধক্যে... তাহলে নারী কবে নিজেকে রক্ষা করবে?” হলের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য ঢেউ উঠল। কিছু মুখ অবাক, কিছু বিরক্ত, কিছু চিন্তিত। শেষে অমৃতা বলল—“রক্ষা মানে যদি স্বাধীনতার বিনিময়ে কারাবাস হয়, তবে সে রক্ষার দাম কত বড়?”

বক্তৃতা শেষে কাবেরী ধীরে ধীরে এসে বলল, "ম্যাডাম একটা কথা ছিল ,  আমার বিয়ে ঠিক করেছে বাবা। এখন থেকে কলেজে আসা  বন্ধ।”

অমৃতা চুপ করে তাকিয়ে রইল মেয়েটির মুখে। সেই মুখে সে নিজের কিশোর বয়সের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল—যখন তাকেও একবার বলা হয়েছিল, “তুমি বড় হয়ে উঠেছ আর তোমার পড়াশোনা যথেষ্ট হয়ে গেছে, এবার সংসার ধর্ম পালনের সময়, প্রস্তুত হও ।”

অমৃতা শুধু বলল, “কাবেরী, মনুর বই যত পুরোনোই হোক না কেন, তার প্রয়োজন সেদিনই ফুরিয়ে গেছে, আজ সেই সিক্কা অচল হয়ে গেছে। মানুষ জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবছে। সেইদিন যেটা সংস্কার ছিল আজ সেটির সাথে 'কূ' যুক্ত হয়ে কুসংস্কার হয়ে গেছে। আজকের সমাজ তাকে বহন করতে অপরাগ।  মানুষ এখন নতুন লেখা পড়তে চায়, যা সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ।” 
রাতে বাড়িতে ফিরে প্রভাত বলল, “তুমি এসব কথা বলে নিজের নাম নষ্ট করছো।” 
অমৃতা শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “নাম নয় প্রভাত, আমি খুঁজছি নিজের মুখটা। যেটা সমাজ অনেক আগে ঢেকে দিয়েছে।”

প্রভাত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলে উঠল, “তোমার মুখ, তোমার স্বাধীনতা—সবই আছে। কিন্তু সংসার ভাঙা যাবে না।”

অমৃতা বুঝল, এ কণ্ঠে ভালোবাসা নেই, আছে মালিকানা। সেই রাতের নীরবতায় অমৃতা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। পাড়ার আলো নিভে গেছে, কুকুরের ডাক দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
তার মনে হচ্ছিল— এই যে জানালার বাইরের আলো, তা কি সত্যিই আলোকিত, নাকি আরেকটা ছায়া মাত্র? 

পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সে গেল গ্রন্থাগারে। 
অচিন্ত্যবাবু—বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক, তার সামনে মনুস্মৃতির পুরোনো সংস্করণ খুলে রেখেছিলেন। 
দেখেই বললেন, “এই বইটা আমি পঞ্চাশ বছর ধরে বহন করছি। কিন্তু আজও বুঝলাম না, মনু নারীর রক্ষা চেয়েছিলেন, না বন্দিত্ব?”

অমৃতা ধীরে বলল, “হয়তো তিনি রক্ষাকবচ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই কবচ এখন শিকল  হয়ে গেছে।”

অচিন্ত্যবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “মানুষ নিজের নিরাপত্তার নামে অন্যের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, এটাই ইতিহাসের কৌশল।”

অমৃতা তাকাল জানালার বাইরে— আকাশের এক কোণে হঠাৎ সূর্যের ফালি দেখা গেল, ধীরে ধীরে ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে।

সেই সন্ধ্যায় সে নিজের গবেষণার খাতায় লিখল— “মনুর অনুশাসন মানুষকে নিয়ম শিখিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার ভাষা শেখায়নি।” তার কলম থামল না। কলমের শব্দ যেন ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতরকার নীরবতার সঙ্গে মিশে গেল।

প্রভাত তখন ঘরে ঢুকে বলল,
“তুমি কি লিখছো আবার ওইসব?”
অমৃতা শুধু বলল,
“আমি লিখছি আমার এবং স্ত্রীজাতির মুক্তির ইতিহাস।”

প্রভাত কিছু বলল না।
ঘরে শুধু ছিল কলমের আঁচড় আর জানালার বাইরের হাওয়া—যা ধীরে ধীরে পর্দা নেড়ে অমৃতার মুখে ছুঁয়ে গেল।

রাতের শেষে যখন সে আলো নিভিয়ে ঘুমোতে গেল, মনে হল— আজ কোনো এক অদৃশ্য জায়গায় মনুর ছায়া একটু পাতলা হয়ে গেছে। আর সেই ছায়ার ভিতর দিয়েই হয়তো দেখা যাচ্ছে ক্ষীণ একটা আলোর রেখা— যেখানে শুরু হতে যাচ্ছে তার নতুন জীবন।


 রক্ষার নামেই কারাবাস

সকালটা অন্য রকম ছিল। অমৃতা চোখ মেলেই দেখল জানালার কাচে শিশির জমেছে। সূর্য উঠেছে কিন্তু তার আলো যেন একটু লাজুক—যেন সে জেনে গেছে  পৃথিবীতে এখনো অন্ধকার রয়ে গেছে।

প্রভাত চুপচাপ বসে আছে। টেবিলে রাখা চায়ের কাপ ঠান্ডা।
“আজ কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছো?”—তার প্রশ্নে কণ্ঠে অদ্ভুত এক ধীর শীতলতা।
“হ্যাঁ,” অমৃতা বলল, “আজ কাবেরীর সঙ্গে দেখা করার  আছে।”
“ওই মেয়েটা?” প্রভাতের ভ্রু কুঁচকে গেল, “তুমি ওর জীবনে নাক গলিও না। মেয়েটা নিজের বাবার অধীনে, তিনিই ওর ভালো বোঝে।”

অমৃতা হেসে ফেলল। একরকম নিঃশব্দ হাসি—যার ভেতরে ক্রোধ আর করুণার মিশ্র গন্ধ। “তুমি জানো প্রভাত, রক্ষা মানে কবে যেন ভালোবাসার রূপ হারিয়ে ফেলে। আজকাল মনে হয়—সব পুরুষের হাতেই মনুর এক অদৃশ্য আইনবই লুকিয়ে আছে।”

প্রভাত বলল, “তুমি এখন সমাজ বদলাতে নেমেছো বুঝি?”

“না,” অমৃতা শান্ত স্বরে বলল, “আমি শুধু একটাকে মনে করাতে চাই, নারী কোনো আইন দ্বারা গঠিত প্রাণ নয়—সে মানুষ।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে দেখা হল কাবেরীর সঙ্গে।
মেয়েটার চোখ ফোলা, ঠোঁট শুকনো।
“ম্যাডাম,” কাবেরী বলল, “বাবা গতরাতে মারধর করেছে। বলেছে, ‘তুই এখনো কলেজে কেন যাচ্ছিস?’”
অমৃতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তুমি জানো, আমি ছোটবেলায় খুব পড়তে চাইতাম, আমার বাবাও বলেছিল—‘এইসব পড়াশোনায় মেয়েমানুষের কী দরকার?’ তারপর আমি চুপ করেছিলাম। আজ তুমি কিন্তু  চুপ করো না।”

কাবেরীর চোখে জল টলমল করছে।
“কিন্তু ম্যাডাম, যাব কোথায়?”
অমৃতা বলল,
“যেখানে আত্মসম্মান থাকে, সেখানেই ঘর। বাকিটা শুধু প্রাচীর।”

বিকেলে গ্রন্থাগারে আবার অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি মনুস্মৃতি বন্ধ করে রাখছেন, যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। “আজকাল মনে হয় মনু নিজেও যদি বেঁচে থাকতেন, লজ্জা পেতেন,” বৃদ্ধটি বললেন।
অমৃতা মৃদু হাসল, “লজ্জা নয় অচিন্ত্যবাবু, হয়তো বিস্ময়—নারীরা এখন নিজেরাই নিজেদের ‘রক্ষা’ করছে, কোনো অনুমতি ছাড়াই।”

“তাহলে তুমি কি ভাবো, সমাজ বদলাচ্ছে?”
অচিন্ত্যবাবুর প্রশ্নে অমৃতা থেমে গেল।
“না, সমাজ বদলায় না,” সে বলল, “মানুষ বদলায়। এক একজনের ভেতর আলো জ্বলে উঠলে সমাজ একদিন অন্ধকারে থাকতে পারে না।”

সেই রাতে প্রভাত আর অমৃতার মধ্যে তর্ক বাড়ল।
“তুমি যদি এসব ‘মুক্তির কথা’ বলতে থাকো, একদিন আমার মুখ পুড়বে,” প্রভাত চেঁচিয়ে উঠল।
অমৃতা স্থির কণ্ঠে বলল, “তাহলে মুখ পুড়ুক, তাতে হয়তো মনুর ছায়া একটু তো গলে যাবে।”

প্রভাত থমকে গেল।
এই নারীকে সে আগে দেখেনি—যার চোখে আছে নিঃশব্দ বিদ্রোহের দীপ্তি। তার মনে হল, ঘরের ভেতর একটা অদৃশ্য ঝড় বইছে—যা আর থামানো যাবে না।

পরের দিন সকালে কাবেরী আসে চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা নিয়ে।
“ম্যাডাম, আমি বাবার ঘর ছেড়েছি,” সে বলল।
“কোথায় থাকবে?”
“আপনাদের শহরে একটা মহিলা হোস্টেল আছে—আপনি নাম বলেছিলেন একদিন।”

অমৃতা চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
তার মনে হল, কাবেরী আসলে তার নিজের অতীত, যে আজ তার চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে।

“তুমি কি ভয় পেয়েছো নাকি ?”
“না ম্যাডাম,” কাবেরী বলল, “আপনি বলেছিলেন—রক্ষা মানে কারাবাস নয়।”

অমৃতার চোখ ভিজে উঠল।
সেই মুহূর্তে তার মনে হল—মনুর ছায়া থেকে সত্যিই একটা মেয়ে মুক্তি পেয়েছে।

সন্ধ্যায় আকাশে রঙিন মেঘ। অমৃতা ছাদে দাঁড়িয়ে। দূরে পাখিরা ফিরছে বাসায়, আর সে ভাবছে—
“রক্ষা মানে হয়তো শুধু হাত ধরার নয়, কখনো কখনো ছেড়ে দেওয়াও। আর এই ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেই যে স্বাধীনতা, তা মনু কোনোদিন ভাবতে পারেননি।”

নিচে প্রভাতের চিৎকার শোনা গেল—“চা দেবে না আজ?”
অমৃতা ধীরে ঘুরে বলল,“আজ আমি চা নয়, আলো ঢালছি নিজের জীবনে।”

প্রভাত চুপ করে গেল।
রাত নামল ধীরে ধীরে, কিন্তু অমৃতার চোখে আজ অন্ধকার নয়—এক টুকরো জেগে থাকা আলো।

মনুর ছায়ার নিচে বিদ্রোহ
যেখানে অমৃতার জীবনে শুরু হয় প্রকাশ্য সংঘর্ষ, আর ভেতরে জেগে ওঠে মুক্তির আগুন।

সকালের আলো যেন আজ অন্যরকম। বাতাসে কুয়াশা নেই, কিন্তু ভারি একটা অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পা রাখতেই অমৃতা দেখল কয়েকজন ছাত্রছাত্রী দেয়ালে পোস্টার মারছে—
“অমৃতা ঘোষ – এই সমাজের মুক্ত  চিন্তার প্রচারক!”

তার চোখের পাতা কাঁপল।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সহকর্মী বলল, “আপনার ওই ছাত্রী কাবেরী না? খবরের কাগজে এসেছে—বিয়ে ছেড়ে পালিয়েছে, এখন একটা NGO-তে কাজ করছে।”

অমৃতা চুপ।
অচিন্ত্যবাবু তখন গ্রন্থাগারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললেন, “মনু বলেছিলেন, নারীর স্বাধীনতা সর্বনাশ ডেকে আনে। কিন্তু আমি দেখি, ওটা বাঁচার শুরু।”

অমৃতা মৃদু হাসল।
“সবাই ভয় পাচ্ছে অচিন্ত্যদা। যেন কোনো রোগ ছড়াচ্ছি আমি।”

বৃদ্ধ বললেন,
“যে সমাজে প্রশ্ন করা পাপ, সেখানে চিন্তা করাটাই বিপ্লব।”

দুপুরে অধ্যক্ষ ডেকে পাঠালেন।
“অমৃতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ঝুঁকির মুখে। তুমি ক্লাসে এমন বিষয় তুলছো, যা ছাত্রদের বিদ্রোহী করে তুলছে। কাবেরীর ঘটনার দায়ও তোমার ওপর পড়ছে।”

অমৃতা শান্তভাবে বলল,
“স্যার, আমি কাউকে বিদ্রোহ শেখাইনি। আমি শেখাই চিন্তা করতে। বিদ্রোহ তো চিন্তারই সন্তান।”

অধ্যক্ষের গলা নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ—
“তুমি কিছুদিনের জন্য ছুটি নাও। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক।”

অমৃতা কিছু বলল না।
চুপচাপ ফাইলগুলো গুছিয়ে বেরিয়ে এল। তার মনে হল—এই নীরবতা আসলে এক প্রচণ্ড আওয়াজ, যা কানে নয়, আত্মায় বাজে।

বাড়ি ফিরে প্রভাত বলল,
“তুমি অবশেষে আমার মুখ পুড়িয়েছো। আমার ক্লায়েন্টরা পর্যন্ত বলছে, তোমার বউ নাকি বিপ্লবী হয়েছে।”

অমৃতা জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মুখ পুড়েছে, কিন্তু আমার ভিতর আলো জ্বলছে প্রভাত।”

প্রভাত হাঁ করে তাকাল, “তুমি এখন আলো বাঁচাও!”

অমৃতা হেসে বলল, “না, আমি শুধু ছায়াটা চিনে নিচ্ছি। এতদিন ছায়ার ভেতর বাস করেছি, এবার জানতে ইচ্ছে করছে, আলো আসলে কতটা উজ্জ্বল।”

প্রভাত থমকে গেল। তার চোখে বিভ্রান্তি, রাগ, ভয়—সব মিশে এক অদ্ভুত নীরবতা।
বাইরে মেঘ গর্জে উঠল, হঠাৎ এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল জানলার কাচে।

রাতের বেলা শিবানী ফোন করলেন—
“শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় তোমায় সাসপেন্ড করতে চায়।”

“হয়তো তাই,” অমৃতা শান্ত স্বরে বলল।

“ভয় পাচ্ছো?”

“ভয়? না দিদি, আমি তো এখনই প্রথমবার বেঁচে আছি।”

ফোনের ওপাশে নীরবতা। তারপর শিবানী বললেন,
“তুমি জানো অমৃতা, আমি তোমার বয়সে ভয় পেতাম। কিন্তু আজ তোমায় দেখে মনে হয়, ভয়ও একদিন শ্রদ্ধা করবে মানুষকে।”

বৃষ্টি থেমে গেছে।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অমৃতা অনুভব করল, দূরে কোথাও বজ্রপাতের আলো এক মুহূর্তের জন্য আকাশকে ছিঁড়ে দিল। সেই আলোকচ্ছটায় মনে হল—মনুর ছায়াটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

সে ডেস্কে গিয়ে খাতা খুলে লিখল— “বিদ্রোহ মানে শুধু প্রতিবাদ নয়, বিদ্রোহ মানে নিজের আত্মাকে চিনে নেওয়া। মনুর ছায়া যত ঘন, আমার ভিতরের আলো তত উজ্জ্বল।”

কলমের টুপটাপ শব্দে ঘরের ভেতর এক ধরণের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল।
প্রভাত দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, কিছু বলল না, শুধু দেখছিল।
তার মনে হচ্ছিল—এই মেয়েটি যাকে সে চিনত, সে এখন অন্য কেউ— যেন ছাইয়ের ভিতর থেকে আগুন জন্ম নিয়েছে।

পরদিন সকালে অমৃতা ঠিক করল, সে শহরের সব স্কুলে যাবে—ছেলেমেয়েদের সামনে মনুস্মৃতির গল্প বলবে, কিন্তু এবার নতুনভাবে।
বলবে—“মনু নিয়ম লিখেছিলেন, কিন্তু মানুষ তার মানে বদলাতে পারে।”

কাবেরীর কাছ থেকে খবর এল, সে এখন মেয়েদের স্বনির্ভরতা শেখাচ্ছে।
চিঠির শেষে লিখেছে—“ম্যাডাম, আমি পালাইনি। আমি শুধু আমার জীবনের শুরুটা খুঁজতে বেরিয়েছি।”

অমৃতা চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরল।
তার চোখের কোণে জল জমল, কিন্তু ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি।

রাতের শেষে অমৃতা আকাশের দিকে তাকাল। বজ্রপাত নেই, বৃষ্টি নেই—শুধু নিঃস্তব্ধ আকাশে জ্বলছে নক্ষত্র। সে ফিসফিস করে বলল,“মনু, আমি তোমায় অস্বীকার করছি না, আমি তোমায় পুনর্লিখছি।”

তার চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি— যে দীপ্তি কোনো বিপ্লবের নয়, বরং একজন নারীর অন্তর থেকে শুরু হওয়া আলোর জন্ম।       
ব্লগার- রবীন মজুমদার 
তারিখ -২৯/১০/২৫
ভালো লাগলে শেয়ার করুণ -
rabinujaan.blogspot.com থেকে অন্যান্য ব্লগগুলি পড়া যাবে। 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

(২৬৯) রবি সৃষ্টির বৈচিত্রতা (প্রথম নিবেদন )

(২৩১) মানুষ থেকে নক্ষত্রে উত্তরণ

(২৪২) নারীর একাল ও সেকাল